ভুলভ্রান্তিতে ভরা নতুন শিক্ষাক্রম!

61

লিটন দাশ গুপ্ত

নতুন বছর শুরুতেই ১ম শ্রেণি, ৬ষ্ঠ শ্রেণি ও ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমের বেশ কিছু পাঠ্যবই হাতে পেয়েছে। তবে এরই মধ্যে ইলেকট্রনিক, প্রিন্টিং ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে আলোচিত ও সমালোচিত হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রমের ভুলভ্রান্তি নিয়ে। এতে করে অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থী অভিভাবক কিংবা সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ বিষয়টিতে তিল’কে তাল বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ মূল বিষয়টি না বুঝে বা বুঝার চেষ্টা না করে, শোনা কথা বা গুজব নিয়ে আরো কিছু বাড়িয়ে অতিরঞ্জিত করতে থাকে বা প্রচার হতে থাকে। যা কিনা কাকে কান নেয়ার মত অবস্থা! যার প্রেক্ষিতে সংকুচিত সরু ছোট বিষয়টাও অনেক বড় আকারে বেশী করে প্রচারিত ও প্রসারিত হতে থাকে। না, জাতীয় শিক্ষাক্রম-২১ অর্থাৎ নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে একেবারেই ভুলভ্রান্তি হয় নাই, তা কিন্তু বলছিনা। কথা হচ্ছে- ভুল হয়েছে মানে কি ভুল হয়েছে, ভুলটা কি সংশোধন যোগ্য? ভুলের মাত্রাটা সর্বসাধারণ কিংবা রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রভাব পড়ছে কিনা, ভুলটাতে সাম্প্রদায়িক উস্কানি কিংবা ধর্মীয় বিভেদ বা অবমাননা হয়েছে কিনা, কোন ইতিহাস বা রাষ্ট্রীয় দর্শন বিকৃতি হয়েছে কিনা ইত্যাদি দেখতে হবে। কিন্তু নতুন এই শিক্ষাক্রমে তা হয়নি। হয়েছে কি; ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে কয়েকটা বানান ভুল আর সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট’ থেকে তথ্য নিয়ে সংযোজিত হয়েছে।
প্রথমে আসি ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে বানান ভুল বিষয়ে। যা বিভিন্ন মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারিত ও প্রকাশিত হচ্ছে। তার আগে বলে রাখি, শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পূর্বে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে রচনা সম্পাদনা করা প্রয়োজন। কোনক্রমেই কোন প্রকার ছোটখাটো ভুলত্রæটিও থাকা উচিত নয়। কিন্তু তারপরেও অনেক সময় দেখা যায়, বিপুল সংখ্যক পাঠ্যপুস্তকে বিষয়বস্তু সংযোজন বিয়োজন মুদ্রণ প্রক্রিয়ায় দুয়েকটা ভুল থেকে যায়। প্রথম বছরে বা পরীক্ষণ মূলক সংস্করণে এই ধরনের ছোটখাটো বানান ভুল, দৃষ্টির অগোচরে থেকে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পরের বছর নানা ধরনের পরিমার্জন করা হলে পাঠ্যবইয়ের এই ধরনের ভুল বা অসংগতি সংশোধন করা যায়। তারপরেও অতি উৎসাহী একটি মহল অতিমাত্রায় সরব হয়েছে। যেমন- জনৈক ব্যক্তি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় লিখেছেন, ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে অনেক অনেক ভুল! তিনি নাকি ৬ষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে ৪৮ টি ভুল পেয়েছেন, আরো বিশ্লেষণ করলে ভুলের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। এবার আসি তিনি যে ভুলগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন, তার কয়েকটি এই রকম। যেমন- বইটির পিছনে কভার পেইজে ইংরেজিতে বাংলাদেশের অফিসিয়াল নাম লেখা আছে, দ্য পিউপিলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। এখানে পিউপিলস এর এপোসট্রফি (’) প্রিন্টিং মিস্টেকের কারণে সঠিক জায়গায় পড়েনি। তিনি এমন প্রিন্টিং মিস্টেককেও ভুল হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এছাড়া বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় কেন-কেনো, পড়-পড়ো, যে কোন- যেকোন, নিচে-নিচে, বৈশিষ্ট্যবলী-বৈশিষ্ট্যগুলো, এছাড়া-তাছাড়া ইত্যাদিকে ভুলের সংখ্যার মধ্যে গণনা করা হয়েছে এবং ভুল হিসাবে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। শুধু তা নয়, যেখানে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অন্যতম ধর্ম নিরপেক্ষতা বাদ দেয়া হয়েছে, সেখানে ঐ লেখক ৬ষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের ১০৬ পৃষ্ঠায় একটি চিঠি শুরুতে আসসালামু আলাইকুম উল্লেখ করায়, মুসলিম শিক্ষার্থী বাদে অন্য ধর্মের শিক্ষার্থী কিভাবে গ্রহণ করবে বলে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন!
বইয়ে কিছু বানান ভুল রয়েছে কথাটা ঠিক আছে। তবে উল্লেখিত এই রকম বিষয়বস্তুর মুদ্রণজনিত ত্রæটি বা দুয়েকটা ভুলকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করাটা শুদ্ধনীতি বলা যায় কিনা, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়।
এইতো গেল ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে ভুল হবার ব্যাখ্যা। এবার আসি সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই বিজ্ঞান বিষয়ে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী সপ্তম শ্রেণিতে দুটি বিজ্ঞান বই রয়েছে। একটি অনুশীলন পাঠ, অন্যটি অনুসন্ধানী পাঠ। এখানে অনুসন্ধানী পাঠের প্রথম অধ্যায়ের ৩য় পৃষ্ঠায় লেখার শুরুতে উপস্থাপন করা হয়েছে জীববৈচিত্র্য কী। এরপর অধ্যায়টিতে লেখা রয়েছে, ‘জীববৈচিত্র্য বা বায়োডায়ভারসিটি শব্দ দ্বারা পৃথিবীতে জীবনের বিপুল বৈচিত্র্য বর্ণনা করা হয়। জীববৈচিত্র্য বলতে উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীবসহ সকল জীবের মধ্যে বিদ্যমান বৈচিত্র্যকে বোঝায়। পৃথিবীতে ঠিক কত সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন জীব আছে, তা নিশ্চিত করে এখানো আমাদের জানা নেই। তবে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন যে, প্রায় ৮-১৪ মিলিয়ন (৮০ থেকে ১৪০ লক্ষ) বিভিন্ন প্রজাতির জীব এই পৃথিবীতে রয়েছে। কারও কারও ধারণা মতে সংখ্যাটি আরো বেশী। তবে সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, এসব জীবের বেশির ভাগই আমাদের অজানা। এখনো পর্যন্ত মাত্র ১.২ মিলিয়ন (১২ লক্ষ) প্রজাতি শনাক্ত এবং বর্ণনা করা হয়েছে। যার অধিকাংশই পোকামাকড়। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, কোটি কোটি অন্যান্য জীব এখনো আমাদের কাছে রহস্যময় অজানা।”
কত সুন্দর ও প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু; কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে ইন্টারনেট থেকে হুবহু কপি-পেস্ট করে উপস্থাপন করা হয়েছে। আবার দেখলাম এই ভুলের দায় স্বীকার করে রচনা ও সম্পাদনার সাথে সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান বিবৃতি দিয়েছেন।
কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, বিদেশি সাহিত্য বা তথ্য বঙ্গানুবাদ করে শিক্ষার্থীদের কি পড়তে নেই! বিদেশি ভাষা থেকে ভাষান্তর করে এই লেখা পাঠ্যপুস্তকে সংযোজিত হয়েছে, এর আগেও এমন অনুবাদ লেখা ছিল। তাহলে এটাকে কি ভুল বলা যাবে? প্রশ্ন থেকে যায়। হয়ত এখানে উৎস বা সূত্র হিসাবে ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্তির বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি, যা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এর জন্যে কি দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ লেখক সম্পাদককে চৌর্যবৃত্তি করা বলা যাবে!
আমাদের দেশে শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা হলে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, বিশেষ করে শিক্ষক শিক্ষার্থী বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবেন, কিভাবে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়া ফলপ্রসু করা যায়। শিক্ষার্থীদের সামনে কিভাবে উপস্থাপন করলে বোধগম্য হবে, শিখন কার্যক্রম সহজ হবে ইত্যাদি। আবার অন্যদিকে আরেক শ্রেণির মানুষ আছে, যারা অপেক্ষায় থাকে নতুন শিক্ষাক্রম কখন আসবে, কোন প্রকার ভুল পাওয়া যায় কিনা, কিংবা কোন বিষয়বস্তুকে বিতর্কিত করা যায় কিনা! অনেকটা অর্থবছর শেষে জুন মাসের জাতীয় বাজেটের মত! সরকারি দল বাজেট পেশ করার আগেই বিরোধী দল ভাবতে থাকে কিভাবে বাজেটের নেতিবাচক দিক উপস্থাপন করা যায়!
২০২৩ সালে অর্থাৎ চলতি বছর পরিবর্তিত ও নতুন শিক্ষাক্রম প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে; ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণি এবং ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে; আর ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে বাস্তবায়ন হবে। ওই এক শ্রেণির মানুষ তীর্থের কাক হয়ে অপেক্ষায় আছে, আসন্ন শ্রেণিসমূহে নতুন শিক্ষাক্রমে কি কি বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা যায়!
নবম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রম আসবে আগামীবছর ২০২৪ সালে। বর্তমানে চলমান পুরাতন শিক্ষাক্রমের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও গণহত্যাবিষয়ক অংশের প্রথম লাইনে লেখা হয়েছিল, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন গণহত্যা ও ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে।’ প্রকৃতপক্ষে এখানে হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট নামক তাÐব শুরু করেছিল। এনসিটিবি ২০১২ সালের চলমান শিক্ষাক্রমে নতুনভাবে কয়েকটি সংশোধনী দিয়েছে। আর এই ধরনের পুরানো ভুলগুলো নিয়ে সরব হয়েছে এবং নতুন শিক্ষাক্রমের সাথে মিশিয়ে দিয়েছে এক শ্রেণির মানুষ।
উল্লেখ্য, পাঠ্যবইয়ে ভুল হয়নি এখানে তা বলছি না। আমিও চাই বোর্ডের বই অতিমাত্রায় সতর্কতার সাথে ছাপা হোক। আমাদের সময় শিক্ষক শিক্ষার্থী বা অভিভাবকের মধ্যে প্রচলিত একটি ধারণা ছিল, যে কোন শব্দ বাক্য এমনকি যতিচিহ্ন ভুল মনে হলে, পাঠ্যবইয়ের সহযোগিতা নেয়া হত। কারণ সকলে মনে করত পাঠ্যবইয়ে শতভাগ সঠিক। আমিও চাই সেই পুরানো বিশ্বাস আবার ফিরে আসুক। কিন্তু কথা হচ্ছে, সামান্য ভুল ছোটখাটো ত্রæটি বিচ্যুতি বড় করে উপস্থাপন করে রাজনৈতিক ইস্যু বানানোর চেষ্টা করা উচিত নয়।

লেখক : শিক্ষক ও সাহিত্যিক