ভুমিকম্প আগাম জানান দিয়ে আসে না, প্রয়োজন সতর্কতা

33

তুরস্কের মতো ভূমিকম্পপ্রবণ একটি দেশে ভবন নির্মাণের সময় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত নীতিমালা না মানার পরও জরিমানা দিয়ে ‘ক্ষমা’ পাওয়ার সুযোগ বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে সতর্ক করে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। চার বছর যেতে না যেতেই প্রকৌশলীদের সেই আশঙ্কা সঠিক প্রমাণিত হলো। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির অবস্থানের কারণে আগামীতে মাঝারি মাত্রার এমনকি উচ্চমাত্রার ভুমিকম্প আঘাত হানার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ত্রিদেশীয় অঞ্চলের ভূতাত্তি¡ক গঠন, বৈশিষ্ট্য অনুসারে এর অবস্থানকে পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্প বলয়ের মধ্যে ধরা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ এবং এর আশপাশের অঞ্চলে ভ‚মিকম্প হওয়ার মতো প্লট বাউন্ডারি বা ফাটল রেখা সক্রিয় রয়েছে, যার ফলে যেকোনো সময়ে দেশে ৮ থেকে ৯ মাত্রারও ভূমিকম্প হতে পারে। ইন্দো-বার্মা-হিমালয়ান, ইউরেশীয় একাধিক ভ‚-স্তর ফাটলের লাইন বিস্তৃত থাকায় এবং এর সঞ্চালনের ফলে বাংলাদেশ এবং এর আশপাশের এলাকায় ভূমিকম্প বলয়টি বিশ্বের অন্যতম ক্রিয়াশীল বলে বিবেচিত। এসব অঞ্চলের বারবার মৃদু, মাঝারি এবং কখনো এরও অধিক মাত্রার কম্পনের কারণে ভূ-ফাটলরেখাগুলো ক্রমশ শিথিল ও নাজুক রূপ নিয়েছে, যা আগামীতে শক্তিশালী ভূমিকম্প ঘটাতে পারে। চট্টগ্রামে স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত করে ১৭৬২ খ্রিষ্টাব্দের ২ এপ্রিল বিকেল ৫টায়। ৪ মিনিট স্থায়ী ভূমিকম্পের সময় কামান গর্জনের মতো ১৫টি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছিল। ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটির প্রভাবে সীতাকুণ্ডে দুটি আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল। কক্সবাজারের কাছে কয়েক শ মানুষকে নিয়ে একটি দ্বীপ সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে গিয়েছিল। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক পাহাড় ফেটে চৌচির হয় এবং পুকুর-দিঘি সমতলভূমিতে পরিণত হয়। কর্ণফুলী নদীর পানিতে চট্টগ্রাম শহর ১০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছিল। শহরের অনেক জায়গায় বিশাল গভীর ফাটল ও খাদের সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় আরও ১১ বার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। শহরে মাটির এবং ইটের তৈরি সব ঘরবাড়ি ভূপাতিত হয়েছিল। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল চট্টগ্রামে হলেও এর প্রভাবে সমগ্র বাংলা কেঁপে উঠেছিল। বেশ কয়েকটি নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল।
দেশের বর্তমান প্রযুক্তিগত অবস্থা ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য অপ্রতুল। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ এবং এর পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে একেবারে সচেতন নয়। বিশেষ করে হাসপাতাল ও ফায়ার সার্ভিসসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো ভুমিকম্পপ্রতিরোধী করে গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। এ মুহূর্তে অধিক ভুমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা ভবনগুলোকে দ্রুত রিট্রোফিটিং করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ভবনকে ভূমিকম্প সহনীয় করে তুলতে প্রস্তাবিত ২০০৬ সালের বিল্ডিং কোডের সঠিক প্রয়োগ আজও দেশে বাস্তবায়িত হয়নি। বিল্ডিং কোড মেনে বাড়িঘর নির্মাণের নিশ্চয়তা বিধানে যথাযথ কর্তৃপক্ষের তদারকি নেই। ভবন মালিকদের বাড়িঘর নির্মাণ, নগর পরিকল্পনাবিদদের ডিজাইনে বিল্ডিং কোড মেনে ভূমিকম্প সহনীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবন নির্মাণের ব্যাপারে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। সময়ের প্রয়োজনের নির্মাণবিধি সংস্কারের জন্য বিশেষ স্থায়ী কমিটি গঠন করা আবশ্যক। অফিস আদালতে কর্মরত ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভুমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরি। ভুমিকম্প আগাম জানান দিয়ে আসে না এবং তা প্রতিরোধও সম্ভব নয়, তবে জনসচেতনতা, সতর্কতা ও ভূমিকম্প মোকাবিলার সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ এবং সক্ষমতা অর্জন প্রাণহানি হ্রাস ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারে।