ভাষা সংগ্রামী শিল্পী মুর্তজা বশীর বহুমাত্রিক প্রতিভায় অমলিন ভাস্বর

230

বাংলাদেশের চিত্রকলা গগনের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র খসে পড়ল গত ১৫ আগস্ট। শিল্পী মুর্তজা বশীর, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের তুখোড় সংগঠক একুশে ফেব্রæয়ারির ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষদর্শী এবং সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি অধিকার রক্ষার আন্দোলনে তিনি রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধ এবং নব্বইর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও তাঁর ছিল নেতৃত্বস্থানীয় ভ‚মিকা। মুর্তজা বশীরের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট পুরান ঢাকার বেগমবাজার পিয়ারা হাউসে। তাঁর বাবা বহু ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং মা মরগুবা বেগমের ৯ সন্তানের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। তাঁর লেখাপড়ার শুরু ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশনে। এর পর বগুড়া করোনেশন ইনস্টিটিউশন থেকে ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৯ সালে ভর্তি হন ঢাকা গভর্মেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টসে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের মতো খ্যাতিমান শিক্ষকদের খুব ¯েœহ ভাজন ছিলেন মুর্তজা বশীর। উল্লেখ্য, এই আর্ট কলেজের ২য় ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি। তাঁর সতীর্থদের মাঝে ছিলেন শিল্পী কাইযুম চৌধুরী, শিল্পী রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, ইমদাদ হোসেন, হুমায়ুন কাদির, আখতারুজ্জামান, আলী রেজা প্রমুখ। আর তাঁদের সিনিয়র (১ম ব্যাচের) ছিলেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান, বিজন চৌধুরী, রহমান ভুঁইয়া শামসুল কাদির, লোকনাথ রায় প্রমুখ।
ছোটকাল থেকে ছবি আকাঁর ঝোঁক ছিল তার। তবে শিল্পী হবার বাসনায় নয় বরং কমিউনিস্ট পাটির নেতাদের নির্দেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। সেটি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। ১৯৫৪ সালে প্রথম বিভাগ পেয়ে চারুকলায় ¯œাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ড্রইং এর শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। উল্লেখ্য এ সময় ভারতের কলকাতায় আশুতোষ মিউজিয়ামে টিচার্স ট্রেনিং সার্টিফিকেশন কোর্স সমাপ্ত করেন।
তাঁর বাবা প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ ও গবেষক জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁকে নিজ খরচে চারুকলা বিষয় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইতালি পাঠান। ফলে ১৯৫৬-৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি রেনেসাঁসের পীঠস্থান ফ্লোরেন্সের অ্যাকাডেমিয়া দ্য বেল্লেআর্তিতে পড়ার সুযোগ লাভ করেন। ফ্লোরেন্সে থাকাকালীন ওয়াশিংটন ডি সিতে অনুষ্ঠিত ‘নাইন পাকিস্তানী আর্টিস্ট’ শিরোনামে একটি প্রদর্শনীতে তিনি তাঁর আকা ছবি নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭১-৭৩ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের প্যারিসস্থ ইকোলে নেশিওনাল সুপিরিয়র দ্য বোজার্ট ও অ্যাকাদেমি গোয়েৎসে মোজাইক ও ছাপচিত্রে শিক্ষালাভ করেন এই প্রতিভাবান শিল্পী। ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরে তিনি বন্ধুদের অনুরোধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে সহকারি অধ্যাপক পদে যোগ দেন। পরে এই বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ২৫ বছর শিক্ষকতা জীবন শেষে ১৯৯৮ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, অধ্যাপক মুর্তজা বশীর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
মুর্তজা বশীর বেশ রাজনীতি সচেতন ছিলেন এবং বামধারার লোক ছিলেন। ১৯৪৭ সালে তাঁর বাবা ড. শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে অবসর নেবার পর বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ অধ্যক্ষ পদে যোগদান করলে বশীর সেখানে করোনেশন ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। এ বছর ক্লাস নাইনে পড়ার সময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। তাঁর মতে, কমিউনিস্ট পার্টি বা মার্কসবাদের প্রতি প্রবল আকর্ষণের কারণেই তিনি স্ট্যালিন লেনিন, কালর্মাকস, এঙ্গেলস এদের পোর্ট্রেট করতে ইচ্ছে করেন। এরপর অবিভক্ত ভারতের প্রখ্যাত অভিনেতা খলনেতা ইয়াকুব, নায়ক অশোক কুমার প্রমুখের পোর্ট্রেট করেন। তৎকালীন রাজনীতিবিদ যেমন এম এ জিন্নাহ, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বসুর পোর্ট্রটে করেন। ১৯৫০ সালে কমিউনিস্ট পাটির আহŸানে ময়মনসিংহের সুসং দুর্গাপুরের হাজং অধ্যুষিত এলাকা, ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের তেলেঙ্গানা, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কাকদ্বীপে মুক্ত এলাকা দিবস প্রচারাভিযানে রাস্তায় রাস্তায় পোষ্টার লাগাতে গিয়ে পুলিশের হাতে বশীর গ্রেফতার হন। ৫০ সালের ৭ জুন কারাবন্দী হলেও প্রায় পাঁচমাস জেল খেটে অক্টোবরে মুক্তি লাভ করেন তিনি। এ সময় কারাগারে তাঁর সাথে ছিলেন আবদুল্লাহ আল মূতী শরফুদ্দীন, কমরেড আলী আকসাদ ও কৃষক শ্রমিক নেতা মনু মিয়া।
বাংলা ভাষাপ্রেমী মুর্তজা বশীর ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনে ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রসঙ্গত: আমার বাবা ও শিক্ষক মরহুম আবুল কালাম আজাদ ও ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে এতে জড়িত ছিলেন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত জি.এস (১৯৪৯-৫০), তমদ্দুন মজলিসের চট্টগ্রাম শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট, চট্টগ্রাম সিটি স্টুডেন্ট লীগের সেক্রেটারি, মুকুল ফৌজ এর প্রেসিডেন্ট, স্কাউটস এর সেক্রেটারি এরকম গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। চট্টগ্রাম ও ঢাকা দুই স্থানেই ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করতে তিনি শ্রম দিয়েছেন চট্টগ্রামের (চন্দনাইশ) কৃতি সন্তান ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে। ১৯৫২ সালে বি.এ পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে ভাষা আন্দোলন থেকে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন সব কিছুতে তিনি কাজ করেছেন। তাঁর কাছ হতে খুব ছোটকাল থেকে ভাষা আন্দোলন, একুশে ফেব্রæয়ারি ও তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পারি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কে বাবা খুব শ্রদ্ধা করতেন। তাঁকে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁর সন্তানদের বেশ কয়েকজনকেও। বিশেষ করে বড়ছেলে মুহম্মদ তকীয়ুল্লাহ ও ছোট ছেলে শিল্পী মুর্তজা বশীর কে তিনি চিনতেন। তাঁর চিত্রকর্ম তিনি খুব পছন্দ করতেন।
তকীয়ুল্লাহ শুরু থেকেই অধ্যাপক কাসেমের তমদ্দুন মজলিসের কর্মী ছিলেন। মুর্তজা বশীরও তাঁর বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তাঁদের বাবা ড. শহীদুল্লাহ ১৯১৮ সালেই ভারতবর্ষের সাধারণ ভাষা হিসেবে বাংলা’কে নেয়ার জন্য জোর দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে তদানীন্তন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ যখন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাপ্তাহিক কমরেড পত্রিকায় ‘দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবেøমস অফ পাকিস্তান’ শিরোনামে লেখা প্রবন্ধে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জিয়াউদ্দীন এর প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। আবার দৈনিক আজাদ পত্রিকায় (১৭ শ্রাবণ ১৩৫৪) তাঁর লেখা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ প্রবন্ধে তিনি জিয়াউদ্দীনের সুপারিশ গুলোর অসারতা ব্যাখ্যা করেন।
ভাষা আন্দোলনে এ লেখকের বাবার ভ‚মিকা নিয়ে আরো দু’কথা বলতে হয়। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রদের নিয়ে ১৯৪৮ সাল থেকে আবুল কালাম আজাদ তমুদ্দন মজলিস গঠন করে বাংলা ভাষার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছেন। ১৯৫২’র ফেব্রæয়ারির ২১ তারিখ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আহুত দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট কর্মসূচি সফল করতে তিনি চট্টগ্রামে কাজ করছিলেন। ১৯শে ফেব্রæয়ারি হঠাৎ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নির্দেশ পেয়ে তিনি ঢাকার পথে যাত্রা করেন। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র সমাবেশ, বিক্ষোভ কর্মসূচি ও ধর্মঘটে অংশ নেয়ার জন্য। ২০ ফেব্রæয়ারি থেকে ২৪ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতাদের সাথে আবুল কালাম আজাদ ও তাঁর ভাই মোহাম্মদ সোলায়মান (ঢা বি র এমএ র ছাত্র) সকল কার্যক্রমে অংশ নেন। ২১শে ফেব্রæয়ারি ঢা বি র আমতলার ঐতিহাসিক সমাবেশে ও মিছিলে তাঁরা যোগদেন। এ সময় পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে ও বেপরোয়া লাঠি চার্জ শুরু করে। কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দে ছুটাছুটি। তাঁদের পাশেই এক জনের মাথার খুলি উপড়ে রাস্তায় মগজ ছিটকে পড়ে। সে ছিল রফিক। হতাহত হয় আরো কয়েকজন। তাঁরাও পুলিশি হামলার শিকার হন।
আর্ট কলেজের ছাত্র মুর্তজা বশীর বাড়ির মুরব্বীদের কথা না মেনে সেদিন বের হয়ে যান। গন্তর্ব ঢাকা ভার্সিটির দিকে। মিছিলে দেখা হয় বন্ধু কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সাথে, মেডিক্যাল হোস্টেল ব্যারাকের কাছে। হঠাৎ গুলি মিছিলে। একটু দূরে গুলিবিদ্ধ বরকতকে পড়ে থাকতে দেখে অনেকে এগিয়ে আসে। মুর্তজা বশিরও তাদের সাথে ধরাধরি করে বরকতকে নিয়ে যান হাসপাতালে। বরকতের রক্তে লাল হয়ে যায় রুমাল ও তাঁর পাঞ্জাবি। উল্লেখ্য ঐ দিনেই নিমতলি ঢাকা জাদুঘরে ঢাকা আর্ট গ্রæপের দ্বিতীয় চিত্র প্রদর্শনী শুরুর কথা ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ফিরোজ খান নুনের স্ত্রী লেডি ভিকারুন্নেসা নুন ছিলেন উদ্বোধক। তাই বরকত কে হাসপাতালে দিয়ে বশির ছুটে যান সেখানে। গিয়েই সহকর্মীদের ক্ষোভের সাথে জানালেন তাঁরা এ পরিস্থিতিতে কোন মতেই এক্সিবিশন করতে পারেননা। শিল্পী আমিনুল ইসলাম, রশিদ চৌধুরী আবদুর রাজ্জাক সবারই সহমত। বন্ধ হয়ে গেল প্রদর্শনী। এই ভাবে ছাত্র হত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করলেন তাঁরা। ২২, ২৩ ফেব্রæয়ারি ও গুলি চলে ছাত্র জনতার উপর। শিল্পী মুর্তজা বশীর তখন ৩য় বর্ষের ছাত্র, ১৯ বছরের কিশোর। নিজের চোখে দেখেছেন নিরস্ত্র ছাত্র জনতার মিছিলে পুলিশি অ্যাকশন। তাঁর মনের একান্ত অনুভবে দরদ দিয়ে আকঁতে শুরু করেন একুশের এইসব ঘটনা চিত্র। হাসপাতালে মারা যায় বরকত। বশীর সেই করুণ স্মৃতি আজীবন ধরে রেখেছিলেন। তাঁর একুশের প্রথম চিত্রকর্মটি লিনোকোটে। এটির দুটি ভার্সন করেন তিনি। প্রথমটির নাম দেন ‘রক্তাক্ত একুশে’-ইংরেজিতে ইষড়ড়ফু ২১ংঃ। ১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষ্যে বর্ধমান হাউসে অনুষ্ঠিত (২৩-২৬ এপ্রিল) চিত্র ও আলোকচিত্র প্রর্দশনীতে এটি প্রথম প্রর্দশিত হয়। আর দ্বিতীয়টি ১৯৫৩ সালের মার্চে পুঁথিপত্র প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ও হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রæয়ারি’ সংকলনে ছাপা হয়। এশিয়াটিক সোসাইটির মতে তাঁর “রক্তাক্ত একুশে” ছবিটি ভাষা আন্দোলনের উপর আঁকা প্রথম ছবি হিসেবে স্বীকৃত। একুশের এই প্রথম বইটির জন্য মুর্তজা বশীর পাঁচটি স্কেচ করেছিলেন। এগুলোর মূল্যায়ন তাঁর ভাষায়- “যদিও শিল্পগুণে সেগুলোর কোনো শৈল্পিক মান না থাকলেও প্রত্যক্ষ ভাবে দেখা ঘটনাগুলোর ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে অমূল্য হবে বলে আমার ধারণা।” একুশে ফেব্রæয়ারি স্মরণে তিনি আও বেশ কয়েকটি ড্রয়িং করেন। এর একটি ১৯৭১ সালের ফেব্রæয়ারির জহির রায়হান সম্পাদিত ‘দ্য এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় এবং অন্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের ‘সোনার হরিণ চাই’ চটি পত্রিকায় ছাপা হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মহান মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী মুর্তজা বশরের অগ্রণী অবদান ছিল। ৭ই মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কালজয়ী ভাষণ দেয়ার কিছুদিন পর (১৭ মার্চ) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বাহাদুর শাহ্ পার্ক পর্যন্ত মুর্তজা বশির ও কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্ব বাংলাদেশ চারু ও কারুশিল্পী সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে দীর্ঘ মিছিল হয়। তাঁরা দু’জনেই ছিলেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম আহŸায়ক। শাসকের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে সংগঠিত এই মিছিলে সামনের চারটি মেয়ের হাতে চারটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল স্বা-ধী-ন-তা। সে মিছিলে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন ‘আমি লাল রং দিয়ে অনেক ছবি একেঁছি। কিন্তু রক্তের মতো লাল কখন ও আকিঁনি’। আর মুর্তজা বশির বলেছিলেন- ‘বর্তমানে যে অবস্থা সেখানে একজন শিল্পী বসে থাকতে পারেনা’। উল্লেখ্য সে সময় পাকিস্তান, ইরান, তার্কি (আরসিটি) এ তিনটি দেশে একটি চিত্র প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল। যেখানে তাঁরও অংশগ্রহণের কথা। তিনি সেটা প্রত্যাখান করেছিলেন। অবজারভার পত্রিকায় এক বিবৃতিতে তিনি বলেন তার দেশে যে রক্তপাত হচ্ছে তার প্রতিবাদে তিনি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করবেন না। শুধু তাই নয় পূর্ব বাংলার যে সব লোক সরকার থেকে বিভিন্ন খেতাব পেয়েছেন তা বর্জন করার আহবান জানিয়ে ছিলেন তিনি।
চিত্রকলা হলো অতি উচ্চমার্গের সৃজনশীল শিল্পকর্ম। ব্যক্তির সুন্দর মনের সুপ্ত অনুভূতির নিঃশব্দ প্রকাশ ঘটে এতে। বাহ্যিক দৃষ্টিশক্তি নয়, বরং অন্তর্দৃষ্টির সু² নির্যাস এক কাব্যময় রূপ পরিগ্রহ করে। মুর্তজা বশীরের আধুনিক শিল্পরীতি তথা বাস্তবতার যৌক্তিক উপস্থাপনায় তাঁর অন্তর্দৃষ্টির উন্মেষ সবাইকে প্রাণিত করে। তাঁর প্রকৃতিপ্রেম, ইতিহাস সচেতনতা, স্বদেশ- স্বজাতির প্রতি গভীর মমত্ববোধের পাশাপাশি ধর্মীয় অনুভ‚তি, মানবিকতা তাঁকে এক অন্যন্য আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। মূর্ত ও বিমূর্ততার মিশ্রণ তাঁকে দ্বৈতসত্তার শিল্পী হিসেবে বোদ্ধামহলের শ্রদ্ধা ভালবাসা লাভে সমর্থ করেছে। প্রতীকি হলেও বিমূর্ত চিত্রমালায় ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের সঠিক রূপটি ফুটিয়ে তুলতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর দেয়াল সিরিজ, এপিটাফ সিরিজ, পাখা সিরিজ, কালেমা ত্যায়িবা ইত্যাদি চিত্রকর্ম উল্লেখ করার মত যোগ্য। তিনি চলচিত্রও নির্মাণ করেছেন। দেশ বিদেশের দূলর্ভ সব ডাকটিকেট সংগ্রহ করেছেন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের অটোগ্রাফ, দুলর্ভ বইপত্র, প্রাচীন মুদ্রা ইত্যাদি সাগ্রহে সংগ্রহ করেছেন। চট্টগ্রাম ভার্সিটির লাইব্রেরিতে রক্ষিত ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ক এমনসব দুর্লভ বই তিনি অধ্যয়ন করেছেন যেগুলো কেউ ধরেও দেখেনি। ১৯৮৯-৯৩ সালে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জার্ণাল অফ দ্য নিউমিসম্যাটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’তে প্রাক মোগল যুগ তথা বাংলার সুলতানি আমলের মুদ্রা বিষয়ে তাঁর ছয়টি মূল্যবান গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাঁকে নিয়ে “নার্সিসাসে” প্রজাপতি” বইটি লিখেছেন মিরাজুল ইসলাম যা ২ ফেব্রæয়ারি ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়।
মুর্তজা বশীর শুধু একজন চিত্রশিল্পীই নন। তিনি একাধারে শিল্পকলার শিক্ষক, গবেষক, কবি, গল্পকার, উপন্যাসিক, চলচিত্র নির্মাতা ও মুদ্রা বিশারদ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ গুলো হলোঃ গল্প- ‘কাঁচের পাখির গান’ ও ‘গল্প সমগ্র’। কাব্য- ‘ত্রসরেণু’, ‘তোমাকেই শুধু’, ‘এসো ফিরে অনসূয়া’, ‘টাটকা রক্তের ক্ষীণ রেখা’ যার ইংরেজি ভাষান্তর ঋৎবংয ইষড়ড়ফ ঋধরহঃ খরহব এবং সাদা এলিজি। উপন্যাস-‘আলট্রামেরিন’, ‘মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যা’, ‘অমিত্রাক্ষর’। নির্বাচিত রচনা- ‘মূর্ত ও বিমূর্ত’, ‘আমার জীবন ও অন্যান্য’। তাঁর একমাত্র গবেষণাগ্রন্থ ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’ ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। চারুকলায় তাঁর অবদানের জন্য মুর্তজা বশীর ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮০ সালে একুশে পদক, ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমি পদক পেয়েছেন।
২০১৭ সালে স্ত্রী আমেনা বশীর মারা গেলে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি। তাঁদের তিন সন্তান। দুই মেয়ে মুনীরা বশীর ও মুনিজা বশীর। এক ছেলে মেহরাজ বশীর যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। শিল্পী মুর্তজা বশীর অনেকদিন থেকে ফুসফুস, কিডনি, ও হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছিলেন। রাজধানীর এভার কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। সেখানে তাঁর শেষ পরীক্ষার রিপোর্টে করোনা পজিটিভ এসেছিল। ১৫ আগস্ট সকাল ৯টা ১০মিনিটে মারা যান তিনি। ১৭ আগস্ট তাঁর ৮৯তম জন্মদিন পালন করার কথা। তাঁর বড় মেয়ে মুনিরা বশীরের নিজহাতে তৈরি কেক কেটে অনাড়ম্বরভাবেই দিনটি পালন করতেন তিনি তাঁর ফার্মগেট মনিপুরী পাড়ার শেলটেক মণিহার আবাসনের ফ্ল্যাটে। কিন্তু তাঁর দু’দিন আগেই চলে গেলেন নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। ইংরেজি দৈনিক ঞযব উধরষু ঝঃধৎ পত্রিকায় ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট তাঁর জন্মদিনে ঔধযধহমরৎ অষড়স এর নেয়া তাঁর সাক্ষাৎকার ভিত্তিক লেখা (ঞধষব ড়ভ ধ নঁঃঃবৎভষু সধহ: অ পড়হাবৎংধঃরড়হ রিঃয গঁৎঃধুধ ইধযংরৎ ড়হ যরং ৮৬ঃয নরৎঃযফধু)-র শেষ ঢ়ধৎধ টি আমার পড়তে ইচ্ছা করছে- “ঈড়সসবহঃরহম ড়হ যরং ৎবধপযরহম ঃযব ৮৬ ুবধৎ সধৎশ, ঃযব ড়পঃড়মবহধৎরধহ ধৎঃরংঃ, পঁৎৎবহঃষু ংঁভভবৎরহম ভৎড়স ফরধনবঃবং ধহফ ড়ঃযবৎ ড়ষফ ধমব পড়সঢ়ষরপধঃরড়হং, ংধুং,” ঞযরং ুবধৎ ও ধস মড়রহম ঃড় পবষবনৎধঃব সু ৮৬ঃয নরৎঃযফধু,” ফধৎশষু ধফফরহম “গু ভধঃযবৎ ফরবফ ধভঃবৎ ঃযৎবব ফধুং পবষবনৎধঃরহম যরং ৮৬ঃয নরৎঃযফধু. ঞযব বধৎঃয রং ংসধষষ ধহফ ড়ঁৎ ষরভব রং ংযড়ৎঃ, নঁঃ রঃ রং যিধঃ বি ফড় রিঃয রঃ ঃযধঃ সধঃঃবৎং রহ ঃযব বহফ” প্রসঙ্গত: তাঁর পিতা প্রখ্যাত মনিষী ও গবেষক ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই পরলোক গমন করেন।
আমার বাবা আবুল কালাম আজাদ ভাষা সৈনিক ছিলেন। তাই তাঁর সহকর্মী ভাষা সৈনিকদের মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করে। ২০০০ মালের ১১ এপ্রিল দুপুর ১:৩০ মিনিটে আমার বাবা আমার কোলেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। সর্বশেষ গত ৭ জুলাই হারাই আমার মমতাময়ী মা শিক্ষাসেবী মমতাজ বেগমকেও। গত ১৪ আগস্ট তাঁর চেহলাম উপলক্ষ্যে কুরআন খতম, মিলাদ, ফাতেহা ও দোহা মাহফিলের আয়োজন করি। এর পরদিন ১৫ আগস্ট ভাষা আন্দোলনের আরেক সাহসী সৈনিক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শোকাবহ শাহাদাত দিবসে আমরা হারালাম অদম্য পরিশ্রমী গুণী শিল্পী ভাষাসংগ্রামী মুর্তজা বশিরকে। তাঁর প্রিয় চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর সাথে পাল্লা দিয়ে বিরানব্বই বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু চার বছর আগেই নিষ্ঠুর মহামারি কোভিড ১৯ এর কবলে পড়ে ধরাশায়ী হলেন। তাঁর মৃত্যুতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। ভাষা সংগ্রামী শিল্পী মুর্তজা বশীরের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
* নদীর মতো বহমান- মুর্তজা বশীর, প্রথম আলো প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বিশেষ সংখ্যা, ৭ নভেম্বর ২০১৪।
* ভাষা আন্দোলন ছিল অস্তিত্বের লড়াইঃ মুর্তজা বশীর বললেন, সমকাল, অমর একুশে ফেব্রæয়ারি ২০১৩।
* সব ছবি দেখে তুমি থমকে দাড়াও না মুর্তজা বশীর- যুগান্তর সাহিত্য ২৯ নভেম্বর ২০১৯।
* আমি সংগ্রাম মুখর জীবন চেয়েছিলাম: শিল্পা মুর্তজা বশীর। সাক্ষাৎকার- আহমেদ মুনীরদ্দিন। দেশ রূপান্তর ১৫ মার্চ ২০১৯।
* মূর্ত বিমূর্ততায় দ্বৈতসত্তা- আক্তারুজ্জামান সিনবাদ। জনকণ্ঠ সাহিত্য, ১৮ নভেম্বর ২০১৬।
* মুর্তজা বশীর-সঙ্গ ও নৈঃসঙ্গ্য: আবুল মনসুর- শিল্পসাহিত্য, প্রথমআলো, ২১ আগস্ট ২০১৫।
* যা কিছু এঁকেছি সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই- মুর্তজা বশীর। সাক্ষাৎকার- মোহাম্মদ আসাদ, যুগান্তর সাহিত্য ৫ জুলাই ২০১৯
* একুশের সৈনিক মুর্তজা বশীর- লুসিফার লায়লা। খোলা হাওয়া, দৈনিক আজাদী, ১২ মার্চ ২০১৯।
* অন্য মর্তুজা বশীর: নিজাম বিশ্বাস, সাহিত্য সাময়িকী, প্রথম আলো, ৬ এপ্রিল ২০১২।
* ভাষা আন্দোলনের চিত্রকর্ম: মুর্তজা বশীর। অমর একুশে, প্রথম আলো, ২১ ফেব্রæয়ারি ২০১২।
* একুশের চিত্রভাষ্যকার- নাসির আলী মামুন। অমর একুশে, প্রথম আলো, ২১ ফেব্রæয়ারি ২০১২।
* মুর্তজা বশীর। আমার জীবন ও অন্যান্য-জাকিয়া রহমান ঋতা। শিল্পসাহিত্য, সুপ্রভাত, বাংলাদেশ ১৯ জুন ২০১৫।
* মার্চ ১৯৫৩, প্রথম সংকলন- কাইয়ুম চৌধুরী। অমর একুশে বিশেষ সংখ্যা, প্রথম আলো, ২১ ফেব্রæয়ারি ২০১২।
লেখক : শিক্ষক, কবি ও ভাষা আন্দোলন গবেষক