ভাষা-আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু

104

তাতে তাঁর নির্দেশ ছিল, ‘বাংলা ভাষার প্রশ্নে কোনো আপস নেই।’ পরের ঘটনা প্রায় সবারই জানা। একুশের আন্দোলনের সংবাদ শুনে শেখ মুজিব কতোাঁ আশাবাদী হন, তিনি কতোাঁ দূরদর্শী নেতা তার প্রমাণ তাঁর লেখাতেও আছে। সে-কারণে এরপর থেকে ভাষা-সংগ্রামে নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই জেলমুক্ত শেখ মুজিবের ওপর বর্তায়।
এভাবে স্বাধীনতা-সংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পথ দেখিয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষাসংগ্রাম। ভাষাবিজ্ঞানে পরিভাষা মানে সংজ্ঞার্থ শব্দ। যথাযথ পরিভাষা না থাকার কারণেই রাষ্ট্রের সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারে সমস্যা দেখা দিতে পারে; একথা অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রূয়ারি বাংলা একাডেমিতে ভাষণে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পন্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে বঙ্গবন্ধু যে কত আন্তরিক ছিলেন, ওপরের ভাষ্য থেকে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়। অথচ অপ্রিয় হলেও সত্য, তাঁর এ অঙ্গীকার বাস্তবানের সংগ্রাম আজও অসমাপ্ত। বাংলা ভাষায় হিন্দি-ইংরেজি শব্দ মিশে ভাষা দূষিত হচ্ছে ভেবে আমরা আদালতের দ্বারস্থ হই, অন্যদিকে সর্বোচ্চ আদালতে যে বাংলা ব্যবহৃত হয় না সেকথা বেমালুম ভুলে যাই। অথচ ভাষা যে পরিবর্তনশীল ও নদীর স্রোতের মতে প্রবহমান সেকথা বঙ্গবন্ধুর ভাষণেও আছে। ঐদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন : ‘মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যায় না। এর পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয় ব্যবহারের ভিতর দিয়ে। ভাষার গতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না। এই মুক্ত পরিবেশে বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের অতীত ভূমিকা ভুলে স্বাজাত্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলা ভাষাকে গণমুখী ভাষা হিসেবে গড়ে তুলেন।’ ভাষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধি ও স্বচ্ছ ধারণা-ভাবনা পাঠে, তাঁকে একজন ভাষাতাত্ত্বিককের মতোই মনে হয়। বাংলা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসাই তাঁকে ভাষা-ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত আগে মহান ভাষাদিবস উপলক্ষ্যে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আয়োজিত জনসভায় ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন: ‘আজ শহিদ দিবসে শপথ নিতে হবে, যে পর্যন্ত না ৭ কোটি মানুষ তাঁর অধিকার আদায় করতে না পারবে সে পর্যন্ত বাংলার মা-বোনেরা বাংলার ভাইয়েরা আর শহিদ হবে না, গাজী হবে’ । গাজী মানে যুদ্ধজয়ী বীর। এই রূপকের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বিজয়ের বহু পূর্বেই এক বিজয়ী বাঙালি জাতিকে নির্দেশ করেছেন। ৭ই মার্চে তাঁর অবিস্মরণীয় ভাষণের শেষেও তিনি উচ্চারণ করেন: ‘জয় বাংলা’। এখানেও শেখ মুজিব বাংলাদেশ-বাঙালি আর বাংলা ভাষাকে এক শব্দে ধারণ করেন। অন্যভাবে বলা যায় শব্দ তিনটিকে তিনি অবিচ্ছেদ্যরূপে আবিষ্কার করেন। একাত্তরে ‘জয় বাংলা’-কে তিনি বাঙালিকে উদ্দীপিত করবার হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহারের দক্ষতা দেখিয়েছেন। ১৯৭২-র সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। এটাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মূল নায়ক ও স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভাষা-আন্দোলনেরই সুদুর প্রসারী ফলশ্রুতি’। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার এই ধারাবাহিক সংগ্রামের পথ ধরেই এসেছে স্বাধীনতা। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষার অবমাননা-অসম্মানে অসহ্য হয়ে ১৯৭৫-র ১২ মার্চ স্বয়ং রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে আদেশ জারি করতে হয়। এ-আদেশে তিনি লিখেন: ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তাঁর ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথি লিখবেন সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্তে¡ও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেয়া যেতে পারে না।’ আফসোস এ-উচ্ছৃঙ্খলতা থামানোর আগে অকস্মাৎ আগস্টের কালো রাতে (১৫/৮/১৯৭৫) তাঁকেই সরিয়ে দেওয়া হয়। ষড়যন্ত্রকারীরা যে বাংলা ভাষারও শত্রু তার প্রমাণ ১৯৭৫-র ১৫ আগস্ট থেকে নিষিদ্ধ হয় ‘জয় বাংলা’, ‘বেতার’ ‘খোদা হাফেজ’ ইত্যাদি বাংলা ভাষার বহুল ব্যবহৃত শব্দবন্ধ। বাংলাদেশ নাম এবং এর জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনেও শত্রুরা এগিয়েছিল; তবে নানা কারণে সফল হয়নি । বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী আদর্শই আমাদের সাহস যুগিয়েছে। তাই ‘বাংলাদেশ’ নামক এ ভূখন্ডের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই স্বীকার করতে হয়। সুতরাং ভাষাসংগ্রামী শেখ মুজিবকে অস্বীকৃতি-অবমূল্যায়ন মানে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য সর্বোপরি আমাদের জাতিসত্তা ও অস্তিত্বকেই অস্বীকৃতি।
সমকালীন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিও স্বীকার করেন যে, বাংলাদেশের পরবর্তীকালের ইতিহাস বিবেচনায় নিলে ভাষা আন্দোলনেও বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা আজ আরেকটু গুরুত্বসহকারে আলোচনার দাবি রাখে। আজও ভাষা-আন্দোলন নিয়ে লেখা বইপত্রে পাই বঙ্গবন্ধু বিরোধিতা। যেমন -বদরুদ্দীন উমর লিখেন, ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রধান হলেও তখনো পর্যস্ত তার সাংগঠনিক শক্তি তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না এবং কর্মী সংখ্যাও ছিল অল্প।’ বাক্যটিই দ্বিমুখি কথার; প্রধান বিরোধী দল অথচ সাংগঠনিক শক্তি নেই, এ কীভাবে হয়? হয় কারণ এখানে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব বিরোধিতা আছে। তাই আতিপ্রগতিবাদী সাফাইও মেলে: ‘উমর নিজে বামপন্থী ধারার প্রগতিশীল রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকলেও ইতিহাসের স্বার্থে নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছেন।’ এই নিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরাই বাংলা ভাষার প্রতি সবচেয়ে নির্মম-নিষ্ঠুর। কখনো কর্পোরেট স্বার্থে, কখনো ধর্মীয় দোহাই দিয়ে এরা বাংলাদেশে বাংলা ভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষার মর্যাদাকে বড় করে দেখাতে উদগ্রীব। এই সুবিধাবাদী নব্য মহাজন, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও তাদের মদদদাতাদের নিয়ন্ত্রণে চলে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি উন্নসিকতা এবং বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি লিপ্সা-লুলুপতা। বাহান্নতে এদের পূর্বপুরুষেরা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মিথ্যে বিবৃতি প্রচার করেছে। শেখ মুজিব তা ছুড়ে ফেলে সত্য উন্মোচন করেন। এদের বিপরীতে মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের (বিশেষত বঙ্গবন্ধুর) রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় মধ্যবিত্তের গণসংশ্লিষ্টতা একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল বলেই ভাষা-আন্দোলন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক একটি আধুনিক রাষ্ট্রের বিকাশের ধারাটি এমন পরিপক্বতার সঙ্গে বিকশিত হতে পেরেছিল। বাংলা ভাষার সংগ্রামের সাথে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে ওঠা ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের সম্পর্ক তাই অবিচ্ছেদ্য।
ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর কর্মকান্ড অবলোকন করলে বোঝা যায় ধীরে ধীরে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির সংগ্রাম থেকে বাঙালি কেন ও কীভাবে স্বাধীনতার সংগ্রামে এসে উপনীত হয়েছে এবং স্বাধীন বাঙালি জাতিতে উন্নীত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু বাংলা ভাষার একনিষ্ট সেবক হিসেবে বাংলা ভাষার উন্নয়ন বিকাশে ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের সফল, সার্থক ও যোগ্য নেতা ছিলেন বলেই ভাষাসংগ্রামের সারথী তাঁকে হতে হয়। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই দেশের প্রতি তার ভালোবাসা থাকবে তা অবিশ্বাস্য। ভাষার দাবি তাঁর কাছে যেমন বাঁচার দাবি, ভাষার সংগ্রামও তাঁর কাছে বাঁচার সংগ্রাম। সুতরাং শেখ মুজিবের স্বপ্নের বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাঁর ভাষার সংগ্রামকেই সচল রাখতে হবে। অথচ মুক্তি-সংগ্রামের পঞ্চাশ বছরে এসেও আমরা সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে পারিনি। প্রতিবেশি চীন, জাপান, কোরিয়াসহ বহু দেশ মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার সব দরজা খুলে দিয়েছে, তবু অর্থনীতিতে তাঁরা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। আমাদের বহু ভাষাবিদ ও বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তাঁদের উৎসাহ দিতে হবে যেন বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। এতে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চশিক্ষা, গবেষণাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার বাড়ানো দরকার। সর্বোপরি সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার করতে পারলে আমরাও বিশ্বে নিজেদের আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো। মিশ্র অর্থনীতির এই যুগে বিদেশগামীদের বিদেশী ভাষা জানা প্রয়োজন। তবে চমস্কীয় বিশ্বব্যাকরণের তত্ত্ব অনুসারে মাতৃভাষা ভালোভাবে রপ্ত করতে পারলে যেকোনো ভাষা শেখা কোনো ব্যাপার না; যেহেতু সকল ভাষার মৌলিক কাঠামো একই। সুতরাং জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে এই প্রত্যাশা-বাঙালির মাতৃভাষা আপন গতিতে বিস্তার লাভ করুক, সর্বস্তরে প্রবেশাধিকার পাক। অন্তত বাংলাদেশে অর্থ উপার্জনের অবলম্বন হোক বাংলা ভাষা।