ভাষার মৃত্যু : প্রসঙ্গ চাটগাঁইয়া ভাষা

15

মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন

কবি, গীতিকার ও ‘কথন’ কাÐারি ফারুক হাসান আর নেই- কথাটি বিশ্বাসই করতে পারছিনা। বয়সে আমার চেয়ে ছোট হয়েও আমার পূর্বে পৃথিবী থেকে পরপারে পাড়ি জমাবেন, তা কিভাবে বিশ্বাস করি! তাছাড়া মাসখানেক আগেই তো আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের সামনে তাঁর সাথে আমার দেখা। তিনি দক্ষিণ দিকে আসছিলেন, আমি যাচ্ছিলাম উত্তর দিকে। মুখোমুখি হতেই তিনি থেমে যান, সালাম জানিয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়ান। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট কথা হয় তাঁর সাথে। আমি দীর্ঘদিন থেকে তাঁকে যতটুকু জানি ও চিনি – কম কথা বলার মানুষ তিনি। যতটুকু হয় কথা – বুঝতে বাকি থাকেনা বুকে তাঁর পুত্র হারানোর ব্যথা। উল্লেখ্য, বছর খানেক আগে তাঁর একমাত্র পুত্র সন্তান সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ – ভেঙে দিয়েছে তাঁর সব আশ। এরচেয়ে বেদনার একজন বাবার কাছে কি হতে পারে! আমি সমবেদনা ও সান্ত¡না জানিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিই তাঁর কাছ থেকে। সেই দেখা যে তাঁর সাথে শেষ দেখা হবে, কে জানতো! বিদায় নিলেও একধরনের বিষাদের সুর আমার বুকের বীণায় বাজতেছিলো। তখন কেন জানি রবীন্দ্রনাথের ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতার নিম্নের চরণসমূহ সেই মরণের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলো-
কি গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,
সমস্ত পৃথিবী! চলিতেছি যতদুর
শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর
‘যেতে আমি দিব না তোমায়!’…

এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত্য ছেয়ে
সব চেয়ে পুরাতন কথা, সব চেয়ে
গভীর ক্রন্দন ‘যেতে নাহি দিব।’ হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়!

ফারুক হাসানের সাথে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। তবে কবে কখন কোথায় হয়েছিলো সেই পরিচয়, সেই স্মৃতি এখন স্মরণ করতে পারছিনা। ১৯৭৮ সালে উত্তর পতেঙ্গাস্থ একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে আমার চাকরি হয়েছিলো। থাকতাম ভাষাসৈনিক জনাব বদিউল চৌধুরীর আন্দরকিল্লাস্থ ‘মুনইম’ বোর্ডিং-এ। খেতামও তাঁর বাসায়। এই থাকা ও খাওয়া ছিলো মাগনা, মানে বিনে পয়সায়। তার পেছনে কারণও ছিলো। কারণটা আত্মার আত্মীয়তা। অর্থাৎ আমার বড় দাদু, বিশিষ্ট আলিম, অলিয়ে কামিল ও আরবি-ফারসি কবি মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী (র.)-এর [১৮৮৫-১৯৬০] ভীষণ ভক্ত ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে তাঁর ও তাঁর সহধর্মিণীর অবারিত স্নেহ লাভ করার সৌভাগ্য। আর চাকুরিটা দিয়েছিলেন চৌধুরী সাহেবেরই কাজিন, সাবেক মন্ত্রী নুরুল হক চৌধুরীর (কাট্টলী) সুযোগ্য ভ্রাতুষ্পুত্র জনাব নজমুল হক চৌধুরী। তিনিও ছিলেন বড় দাদুর একান্ত ভক্ত। বিকেলে অফিস ছুটি শেষে আন্দরকিল্লা ফিরে এলে খাওয়া ও ঘুমোতে যাওয়ার আগের সময়টা কাটানোর জন্য নিউমার্কেট, লালদিঘির পাড়, আন্দরকিল্লা, জামালখান প্রভৃতি স্থান নতুন পরিচিত হওয়া প্রিয়জনদের সাথে চষে বেড়াতাম। সে সময় সাহিত্যের সাথে সংশ্লিষ্টদের সাথে ছিলো আমার সানুরাগ সখ্যতা। তখন লালদিঘির পাড়ে মাসে একবার কি দু’বার বসতো ‘রাইমস্টার’ আয়োজিত ছড়ার আড্ডা। আজকের খ্যাতিমান ছড়াকার রহীম শাহ্-এর আমন্ত্রণে সেই আড্ডায় আমি প্রথম যোগ দিয়েছিলাম। তারপর সেই আড্ডায় মাঝে মাঝে যেতাম। মনে পড়ে, প্রথম যে আড্ডাটিতে আমি যোগ দিয়েছিলাম, সেই আড্ডায় রহীম শাহ্ ছাড়াও সুজন বড়ুয়া, আহসান মালেক, উৎপল কান্তি বড়ুয়া প্রমুখকে দেখেছিলাম তারুণ্যের তরঙ্গদোলায় উল্লসিত। ‘রাইমস্টার’ ছাড়াও আরো বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনের আড্ডা বসতো বিভিন্ন জায়গায়। সংগঠনের বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বসতো আড্ডা। সময়ের অভাবে সবকটিতে অংশগ্রহণ করতে অপারগ হলেও বেছে বেছে কোনো কোনোটিতে অংশগ্রহণ করতাম এবং আড্ডার আনন্দে আন্দোলিত হতাম। ফারুক হাসানের সাথে কি আমার তখন পরিচয় হয়েছিলো? মনে পড়ছেনা। অবশ্য আন্দরকিল্লায় আমি বেশিদিন ছিলাম না, মাত্র নয় মাস ছিলাম। তখন না হলেও পরে কখনো যে হয়েছে, তাতে সামান্য সন্দেহ নেই।
আন্দরকিল্লা ছেড়ে আগ্রাবাদের কমার্স কলেজের কাছের একটি মেস কোয়ার্টারে উঠি আমি। কেউ আমার থাকার সেই ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে ছন্দের আনন্দে বলতাম- আগ্রাবাদ মগপুকুর পাড়, বার কোয়ার্টার, রুম নম্বর চার, বলবো কিছু আর? শুনে কেউ হাসতো, কেউ কাশতো। তখন আগ্রাবাদ থাকলেও, অন্তরটা থাকতো আন্দরকিল্লায়। কারণ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতা জগতের প্রায় সকলের বিচরণভূমি ছিলো আন্দরকিল্লা। তাই যখনই সময়-সুযোগ পেতাম, আন্দরকিল্লা চলে যেতাম, আড্ডার আনন্দে মেতে উঠতাম। সেই সময়ের কোনো এক ক্ষণে কোনো এক স্থানে হয়তো ফারুক হাসানের সাথে দেখা হয়েছিলো। তারপর শহরের এখানে ওখানে তাঁর সাথে দেখা হতে থাকে। তখন ফারুক হাসান যেখানেই যেতেন, তাঁর সাথে ছায়ার মতো দেখা যেতো আরেক ছড়াকারকে। তাঁর নাম রমজান আলী মামুন। দুজনের দোস্তি ছিলো দেখার মতো। বছর কয়েক আগে মামুনও আমাদেরকে ছেড়ে চলে যান মৃত্যুর ওপারে।
ফারুক হাসানের সাথে আমার অধিক দেখা হতে থাকে আমার চাকুরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের পর থেকে। কখনো পাহাড়তলীতে ‘প্রতীকী’-র ছড়ার আড্ডায়, কখনো কথাসাহিত্যিক রফিক আনোয়ারের ‘ক্ষণিকা’-য় (চট্টগ্রাম ওয়াসা’র পশ্চিম পাশে), কখনো বিভিন্ন সাহিত্য অনুষ্ঠানে। তাঁর টেরিবাজারস্থ মার্কেটের কোনো এক কক্ষে ‘কথন’-এর আড্ডায়ও কয়েকবার গিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। একবার তো নজরুল-বন্ধু কবি সুফী জুলফিকার হায়দারের ওপর একটি আস্ত প্রবন্ধই পড়ে ফেলেছিলাম। যতটুকু মনে পড়ে, সেই লেখার ওপর চৌধুরী গোলাম রব্বানী, রমজান আলী মামুন এবং আরো কেউ কেউ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ‘কথন’-এর জন্য, দেখা হলে লেখাও চাইতেন। কয়েকটি দিয়েছিলামও। তিনি যতœ করে ছাপিয়েওছিলেন। মোদ্দা কথা, যখন যেখানেই দেখা হতো, তাঁর অকৃত্রিম আন্তরিকতা, বিনয় ও সারল্য আমাকে চুম্বকের মতো টানতো। সেই সাথে তাঁর সাহিত্যিক ইমেজ তো ছিলোই। এত প্রতিভা থাকার পরও তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ ও প্রীতিবৎসল।
তাঁর একটি বিশেষ অবদানের কথা বলা আবশ্যক। অনেক কবি, ছড়াকার, গল্পলেখকের লেখার হাতেখড়ি হয়েছিলো তাঁর সম্পাদিত ‘কথন’-এর কল্যাণে। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন সাহিত্য জগতে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। কবি আসাদ চৌধুরীর অসম্ভব অনুরক্ত ছিলেন তিনি। অনেক অনেক আগে একবার আবৃত্তি সংগঠন ‘ক্বণন’ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তাঁর মুখ থেকে সেই মুগ্ধতার কথা শুনেছিলাম। সেদিন সেই অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে এসেছিলেন কবি আল মাহমুদ, কবি আসাদ চৌধুরী, আবৃত্তিশিল্পী ক্যামেলিয়া মোস্তফা ও নাসিম আহমেদ। বিশিষ্ট আবৃত্তিকার মোস্তাক খন্দকারের আমন্ত্রণে তাঁরা এসেছিলেন।
২০০৫ কি ২০০৬ সালের দিকে হবে, তখন চট্টগ্রামে ক্লেরিহিউ লেখার কল্লোল। কেউ কেউ রক্ষণশীলের মতো গেলো গেলো বলে বিরোধিতা করলেও অনেকে আবার সমর্থনও করেছিলেন। আমি তখন ঢাকার পাক্ষিক ‘পালাবদল’, মাহবুবুল হাসানের ‘ছড়া-পত্রিকা’, মিজানুর রহমান শামীমের ‘প্রতীকী’ ও ফারুক হাসানের ‘কথন’-এ গুচ্ছাকারে ক্লেরিহিউ লিখেছিলাম। পরে সেগুলো দিয়ে ‘ক্লেরিহিউ কাঞ্চন’ নামে একটি পুস্তক প্রকাশেরও পরিকল্পনা ছিলো। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, পরিকল্পনার ‘পরি’ যায় উড়ে, আর ‘কল্পনা’ পড়ে থাকে আঘাত পেয়ে ঝড়ে। ‘কথন’-এ আমার যে ক্লেরিহিউগুচ্ছ প্রকাশিত হয়েছিলো, তার একটি ছিলো ফারুক হাসানকে নিয়ে। সেটি এই-

নাম তাঁর ফারুক হাসান,
লিখেন ছড়া, লিখেন গান।
কথা যদিও বা কম কন,
কাগজের নামটি কথন!

জানি, তিনি এখন চলে গেছেন যে দেশে, সাধ্য নেই যে ফের কথা বলবেন পৃথিবীতে এসে। সত্যিই কি তিনি চলে গেছেন? চলে গেলেও রেখে গেছেন প্রীতি ও স্মৃতি। কান পাতলে এখনো শোনা যাবে কথন, শোনা যাবে তাঁর হৃদয়ের স্পন্দন। সৃষ্টিশীল মানুষের কখনো হয়না মরণ। সৃষ্টিশীল সত্তা তো তার সৃষ্টির মাঝে পায় আরেক নতুন জীবন।

লেখক : সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক