ভাষার মাস বইয়ের মাস

10

আহমেদ মনসুর

‘শোনেন হুজুর/ বাঘের জাত এই বাঙালিরা/ জান দিতে ডরায় না তারা/ তাদের দাবি বাংলা ভাষা/ আদায় করে নেবে তাই।’
ফেব্রæয়ারি মাস, ভাষার মাস, বাঙালির প্রাণের মাস। এ মাসে রফিক, সালামের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো মায়ের ভাষা বাংলা। সারাবিশ্বে বাংলা ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা আজ ২৭ কোটি। ভাষাভাষী লোকের সংখ্যার দিক বিবেচনায় বাংলার স্থান বিশ্বে পঞ্চম।
প্রতিবছর এ ভাষায় রচিত হয় হাজার হাজার বই। কোনটা গল্পের, কোনটা কবিতার, কোনটা প্রবন্ধের, কোনটা উপন্যাসের, কোনটা ছড়ার, আর কোনটা গবেষণার। বইগুলো নিয়ে বসে মেলা। প্রাণের বইমেলা। চারদিকে কত ঘ্রাণ। নতুন বইয়ের মনমাতানো সমধুর ঘ্রাণ।
রফিক, সালামের রক্তে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো যে ভাষা, বইগুলো সে ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। বাঙালিকে করে ঋদ্ধ। বইয়ের সাথে যারা বাধে ঘর তাদের আত্মা হয় পরিশুদ্ধ। দীর্ঘদিন ধরে এখানে ‘মানুষের মতো মানুষ হও’ বলে মুরব্বিরা দোয়া করেন, কিন্তু তা কি করে হবো সে-পথ কেউ বাতলিয়ে দেন না। আমি বলি- বই পড়ুন, তাতে মানুষের মতো মানুষ হবেন কিনা জানি না, অমানুষ অন্তত হবেন না তার গ্যারান্টি দিতে পারি।
‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’ এ কথাও গুণীরা বলে গিয়েছেন অনেককাল আগে। সে কথার সূত্র ধরেই বলতে চাই- বই কিনুন, পড়ুন। বই পড়লে আপনি কি এই আপনি থাকবেন? থাকবেন না। আপনি আপনার চেয়ে অনেক সুন্দর, অনেক বিভাময়, বড় স্বপ্নে, বড় ভালোবাসায় আর মূল্যবোধে ভরা একজন মানুষ হয়ে যাবেন।
আমি অবশ্য বলবো না আপনি আয়ের যে অংশে সংসার চালান তার সবটুকু দিয়ে বই কিনুন। আগে আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে, মৃতদের বইয়ে কি কাজ? বিনোদনে কিংবা অযথা কিছু খরচ থাকে সকলের, যদি পারেন তার থেকে কিছু বাচিয়ে বই কিনুন। নানাখানে খরচ করে লোকে ঠকে, এখানে বিনিয়োগ করে অন্তত কেউ ঠকে না।
বাঙালি ঈদ, পূজা, পার্বণে নতুন জামা-কাপড়, সাজ-সরঞ্জামসহ আরো নানাকিছু কিনতে নির্দিষ্ট পরিমাণে বাজেট বরাদ্দ রাখে, হাত খুলে খরচ করে। যদিও এর জন্য সবাই উৎসব বোনাস পেয়ে খাকে। বছর ঘুরে মাসব্যাপী বইমেলা আসে। হাজারো নতুন বইয়ের ঘ্রাণে ম-ম করে চারদিক। বই মানে আলো। একবার পড়ে এর সারবস্তু রপ্ত করলে পথ দেখায় আজীবন। জামা-কাপড় অতিপরিধানে মলিন হয়, বইয়ের জ্ঞান অতিচর্চায় আলো বিচ্ছুরণ ঘটায়। সরকারের কাছে দাবি রাখি বইয়ের মাসে সামান্য হলেও বই বোনাস প্রদান করা হোক। বইয়ের সাথে যোগ বৃদ্ধি পেলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মিত হবে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজে মানুষ রাষ্ট্রের জন্য বোঝা না হয়ে পরিণত হবে সম্পদে।
কাজেই সকলের প্রতি নিবেদন- বইমেলায় আসুন, বই কিনুন।
বইমেলা কী এবং কেনই বা আসবেন এখানে: তাহলে সংক্ষেপে এর ইতিবৃত্ত একটু বলি, শুনুন- ‘গ্রন্থমেলা’ বা ‘বইমেলা’ এমনই একটি উৎসব যেখানে মিলিত হন পাঠক, লেখক, প্রকাশক আর সংস্কৃতিমনা সকল মানুষেরা। এ অঞ্চলে তেমনই একটি মেলার সূত্রপাত ঘটেছিল গত শতাব্দীর মধ্য ষাটের দশকে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজন করেছিল সে মেলা। তবে বড় পরিসরে গ্রন্থমেলা বলতে যা বুঝায় তা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে। মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে। চলেছিল ২০ ডিসেম্বর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সেখানে অসংখ্য মানুষ জমায়েত হয়েছিল। বাঁধভাঙা জোয়ারের মত উচ্ছ¡াস আর উদ্দীপনা নিয়ে মেলা প্রাঙ্গণ মুখরিত করে রেখেছিল তারা। সেদিনের সেই মেলায় অংশ নিয়েছিল সকল প্রকাশকের পাশাপাশি ভারতের ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ব্রিটিশ কাউন্সিল আর আমেরিকার দূতাবাস।
সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথম গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। সেবার মেলাটি বসেছিল আর্ট কাউন্সিল ভবনে। সরকার এর জন্য বরাদ্দ রেখেছিল ১ লাখ টাকা। মেলা চলেছিল ১৪ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত। এতে দেশের ১৯ টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আর ৬ টি বিদেশি দূতাবাস যোগ দিয়েছিল।
বাংলা একাডেমিকে কেন্দ্র করে যে মেলা এখন সমৃদ্ধি পেয়েছে সেটির সাথে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে একটি নাম শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা। এর সূত্রপাত ঘটেছিল ১৯৭২ সালে, অনানুষ্ঠিকভাবে। মুক্তধারার শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতার প্রকাশিত বইসহ সদ্য প্রকাশিত অন্যান্য বইগুলো বাংলা একাডেমির মাঠে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। এর দেখাদেখি ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি তাদের নিজস¦ বইগুলো হ্রাসকৃত মূল্যে বিক্রির জন্য ১৫ ফেব্রæয়ারি থেকে ২১ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত একটি মেলার আয়োজন করে। এতে এসে যোগ দিয়েছিল মুক্তধারা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সসহ আরো কেউ কেউ। ১৯৭৪ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে ঢাকার কিছু প্রকাশক বাংলা একাডেমির পূর্বদিকের দেয়াল ঘেঁষে তাদের পছন্দমত কিছু স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এই আয়োজনটি বাংলা একাডেমির নিজস্ব তত্ত¡াবধানে না হলেও স্টল তৈরির অনুমতি দিয়ে বিশেষ অবদান রেখেছিল। এই প্রথম বইমেলার জন্য স্টল নির্মাণের সংস্কৃতি চালু হয়। ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি কিছুটা সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসে। একাডেমির মূল মাঠে স্টল নির্মাণ করার ব্যবস্থা করে দেয় প্রকাশকদের। এভাবে প্রকাশকদের ব্যবস্থাপনায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা চলতে থাকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত।
১৯৭৯ সালে শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা অন্যান্যদের নিয়ে একুশে ফেব্রæয়ারিকে কেন্দ্র করে আনুষ্ঠানিকভাবে বইমেলা আয়োজন করার জন্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কাছে অনুরোধ রাখেন। এ উপলক্ষ্যে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র একটি বিশেষ সভা ডাকে। সে সভায় ৭ ফেব্রæয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে বইমেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। মেলার নামকরণ করা হয় ‘একুশে গ্রন্থমেলা’। মূল উদ্যোক্তা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র হলেও সহযোগিতায় রাখা হয় বাংলা একাডেমি আর প্রকাশকদের।
১৯৮২ সালে এই মেলার মূল উদ্যোক্তা হিসেবে দায়িত্ব নেয় বাংলা একাডেমি আর সহযোগিতায় থাকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক বিক্রেতা সমিতি।
১৯৮৪ সালে এই মেলার নতুন নামকরণ করে রাখা হল ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। প্রয়োজন মনে না করায় মেলা থেকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাদ দেয়া হয় আর মেলার জন্য উপযোগি করে বাংলা একাডেমির মাঠ সংস্কার করা হয়। সে থেকে বৃহৎ কলেবরে নবোদ্যমে বাংলা একাডেমির তত্ত¡াবধানে অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হতে থাকে।
এত সমৃদ্ধ যে বইমেলার ইতিহাস, যার কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে আগের তুলনায় আরো অনেক বেশি, যেখানে চলে আলোর মিছিল, উন্মোচিত জ্ঞানের দরজা, সে-মেলায় যাওয়া আমাদের কর্তব্য নয় কি?
ফেব্রæয়ারি মাস এলে চট্টগ্রামেও বসে বইমেলার আসর। একই সময়ে আগে দুই তিনটা বইমেলা হতো। লেখক-পাঠকেরা বিভ্রান্ত হতেন। এর অবসান হলো। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাননীয় মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের আন্তরিকতায় গতবছর থেকে চট্টগ্রামে একটি মাত্র বইমেলা হচ্ছে। সম্মিলিতভাবে আয়োজিত এ-মেলায় চট্টগ্রামের সকল প্রকাশনী সংস্থাসহ অংশ নিচ্ছে ঢাকার অনেকগুলো প্রকাশনী সংস্থা। এম.এ. আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম ময়দানে ১০ হতে ২৯ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত চলবে এ মেলা। আমাদের প্রত্যাশা- চট্টগ্রামের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে এ-মেলা হয়ে উঠবে জমজমাট, প্রাণবন্ত।

লেখক : সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক