ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকবে আরও কয়েকদিন জলজট যানজটে নাকাল নগরবাসী

87

জলজট, যানজট ও কাদায় নাকাল নগরবাসী। ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নগরীর বেশিরভাগ এলাকা এখনো পানির নিচে। বিশেষ করে বিমানবন্দর সড়কের অবস্থা ভয়াবহ। টানা বর্ষণের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়িতে দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। পানি-কাদায় একাকার হয়ে গেছে নগরীর অধিকাংশ সড়ক।
তিনদিন ধরে চলছে টানা বর্ষণ। বর্ষণ ও জোয়ারের কারণে নগরীর বেশিরভাগ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধতা হয়নি এমন এলাকা খুব কমই আছে। মুরাদপুর থেকে বিমানবন্দর সড়কে পানি আর পানি।
ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকায় গতকাল মঙ্গলবারও নগরীর বিভিন্ন নিচু এলাকায় ছিল হাঁটু থেকে কোমর পানি। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, বাদুরতলা, প্রবর্তক মোড়, দুই নম্বর গেইট, অলঙ্কার, পাহাড়তলী, চকবাজার, মেহেদিবাগ, অক্সিজেন মোড়, মুরাদপুর, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, বহদ্দারহাট, পাঁচলাইশ, শুলকবহর, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, বাকলিয়া, হালিশহরসহ নগরীর বড় অংশজুড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ফ্লাইওভারের উপরেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে টানা ভারি বৃষ্টিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ১০৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আরও কয়েকদিন ভারি বর্ষণ হতে পারে।
সহকারী আবহাওয়াবিদ প্রদীপ কান্তি ধর বলেন, ভারি বর্ষণের কারণে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা রয়েছে।
জানা যায়, জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও এই প্রকল্পের কোনো সুফল গত কয়েকদিনে দৃশ্যমান হয়নি। মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে নগরীর খালগুলো থেকে মাটি তোলার কাজ শেষ করা যায়নি। দখলদারদের উচ্ছেদ করার কার্যক্রম চলছে। আগামী বছর সুফল পাওয়া যাবে। সিডিএ’র কাজে তেমন কোনো সুফল আসেনি এ পর্যন্ত।
তার উপর বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এবারের বর্ষায় সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা হিসেবে দেখা দিয়েছে খোঁড়া রাস্তা আর গর্তে জমে থাকা পানি। ওয়াসার খোঁড়ে রাখা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় রিকশা-ট্যাক্সি উল্টে অহরহ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন যাত্রীরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর অধিকাংশ সড়কই খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে। পানির পাইপলাইন বসানোর নামে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি তারা। বর্ষণের কারণে খোঁড়া সড়কগুলো কাদায় একাকার হয়ে আছে। পাঁচলাইশ মোড় সংলগ্ন পিঠাঘর থেকে কাতালগঞ্জ মোড় পর্যন্ত সড়কের একপাশ কাদায় ভর্তি হয়ে গেছে। চকবাজার গোলজার মোড় থেকে সামান্য যেতেই দেখা যায়, রাস্তার উপর পড়ে আছে স্কেভেটর। কেয়ারি ইলিশিয়াম মার্কেটের সামনে থেকে চট্টগ্রাম কলেজের হোস্টেল গেট পর্যন্ত সড়কের একপাশেও ছিল অতিরিক্ত বালিমিশ্রিত কাদা। এছাড়া শহরের অন্যান্য অংশে যেখানে খোঁড়া হয়েছে সেখানেও ছিল করুণ অবস্থা।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইঞ্জিনিয়ার আলী আশরাফ বলেন, উন্নয়ন পরিকল্পিত নয় বলেই নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কাটা স্থান বর্ষার আগে ভরাট করে দিলে এই সমস্যা হত না। বর্ষায় কাজ বন্ধ রাখলেও তেমন একটা সমস্যা হত না।
গতকাল সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয় বিমানবন্দর সড়কে। পানিতে ডুবে কার্যত অচল হয়ে পড়ে বিমানবন্দর অভিমুখী দু’টি সড়ক। একারণে কয়েকজন যাত্রী ফ্লাইটও মিস করেছেন।
জানা যায়, ভারি বৃষ্টিতে পানি জমে এবং উন্নয়নকাজের জন্য খোঁড়া গর্তের কারণে সড়কগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে এই অচলাবস্থা। এ দুই সড়কের প্রতি কিলোমিটার পার হতে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে। এতে এসব পয়েন্টের দুইপাশে শত শত গাড়ির জট তৈরি হয়।
নগরী থেকে দু’টি সড়ক ধরে বিমানবন্দরে যাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি সিমেন্ট ক্রসিং থেকে রুবি সিমেন্টের দিকে, আরেকটি কাটগড়-পতেঙ্গা হয়ে বিমানবন্দর।
রুবি সিমেন্টের সামনের সড়কটির একাংশ সোমবার সকালে গলা পানিতে তলিয়ে যায়। যা মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ সড়ক দিয়ে অটোরিকশা, টেম্পু, প্রাইভেট কারসহ ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচল এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। বাস-ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চললেও গতি খুবই কম।
এছাড়া পতেঙ্গা থানার সামনে দিয়ে কাটগড় সড়কটিতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ চলছে। সড়কের এক-তৃতীয়াংশ দখলে নিয়েছে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রæপ। ৮/৯ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন অংশে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। এসব গর্তে পানি জমে আছে। এ সড়ক দিয়েও ছোট যানবাহন চলাচল এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়।
সিএমপি বন্দর ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার তারেক আহম্মেদ বলেন, রুবি সিমেন্ট এলাকায় সড়কটি কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে। তাছাড়া সড়কের উপর বড় বড় গর্ত। যার কারণে যান চলাচল করতে সমস্যা হচ্ছে।
এ দু’সড়কে পানির কারণে বিমান যাত্রীরা বিপাকে পড়েন। চার-পাঁচ ঘণ্টা আগে রওয়ানা দিয়েও বিমানবন্দরে পৌঁছাতে না পারায় বেশ কয়েকজন ফ্লাইট মিস করেছেন।
এদিকে জলজটের কারণে তীব্র যানজট দেখা দেয় নগরজুড়ে। বিশেষ করে বিমানবন্দর সড়কে ভয়াবহ যানজট দেখা দেয়। রুবি সিমেন্ট এলাকা থেকে ১০ কিলোমিটার জুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়। এসময় কয়েকটি সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যেসব সড়ক দিয়ে যানবাহন চলছিল, পানি মাড়িয়ে চলতে গিয়ে সেগুলোর গতিও শ্লথ হয়ে যায়। এতে পুরো নগরজুড়েই যানজট সৃষ্টি হয়। বহদ্দারহাট থেকে টাইগারপাস পর্যন্ত সড়কেও ছিল তীব্র যানজট।
উত্তর বিভাগের টিআই (প্রশাসন) মো. মহিউদ্দিন খান জানান, আমাদের টিআই, সার্জেন্টরা যানজট নিরসনে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। সড়কে পানি উঠায় যান চলাচলের গতি সীমিত ছিল। তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী ছিল না। দায়িত্বরতরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন যানজট নিরসনে।
টানা বর্ষণ ও জলজটের কারণে নগরীর ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরাও আসতে পারছেন না। অর্ধেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট বন্ধ ছিল। যেগুলো খোলা সেগুলোতেও বিকিকিনি ছিল না।
জানা যায়, ভারী বর্ষণে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। বেশ কিছু দোকান-গুদামে পানি প্রবেশ করে পণ্য নষ্ট হয়েছে বলে জানা গেছে। খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ বাজার, আমির মার্কেট, আসাদগঞ্জ, শুটকিপট্টি এবং কোরবানিগঞ্জের অনেক দোকানে পানি প্রবেশ করেছে। ফলে পেঁয়াজ, রসুন, আদা এবং মসলাসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্য পানিতে ভিজে যায়। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পানিতে এখানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক দোকানে পানিও প্রবেশ করেছে। মালামাল নষ্ট হয়েছে।
এছাড়া নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার, হকার্স মার্কেট, শপিং কমপ্লেক্সসহ শতাধিক মার্কেটে এবং মার্কেটের সামনে পানি উঠায় ব্যবসা-বাণিজ্য এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। দোকান পাটও খুলেনি ব্যবসায়ীরা।