ভারী বর্ষণে পাহাড়ধসের আশঙ্কা

107

প্রশাসনের উচ্ছেদ অভিযান সত্তে¡ও চট্টগ্রামে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে কয়েক হাজার পরিবার। এতে ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসে ব্যাপক প্রাণহানির আশংকা রয়েছে। জেলা প্রশাসন পাহাড়ে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও প্রভাবশালী দখলদারদের কারণে সম্ভব হচ্ছে না। বর্ষণে গত ১১ বছরে পাহাড় ধসে মারা গেছেন ২৩০ জন। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ৩৬ সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। এদিকে চট্টগ্রামে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের আভাস দিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর। একই সঙ্গে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানিয়েছে। এদিকে গতকাল শনিবার সারাদিন কখনো ভারী আবার কখনো হালকা বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামে। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় লোক ও যান চলাচল ছিল কম। জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, নগরের ১১টি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে প্রায় এক হাজার পরিবারের কয়েক হাজার লোক বাস করছেন। এরমধ্যে নগরীর একে খান মালিকানাধীন পাহাড়ে ১৮৬ পরিবার, ইস্পাহানি পাহাড়ের দক্ষিণ পাশে হারুন খানের পাহাড় ও বায়তুল আমান সোসাইটির কাছে পাহাড়ে ৫টি, কৈবল্যধাম বিশ্ব কলোনি পাহাড়ে (পানির ট্যাংক) ২৭টি, লেকসিটি আবাসিক এলাকার পাহাড়ে ১২টি, আকবর শাহ আবাসিক এলাকার পাহাড়ে ২২টি, পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে সিটি কর্পোরেশন পাহাড়ে ১১টি, ফয়’স লেক আবাসিক এলাকার কাছে পাহাড়ে নয়টি, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট একাডেমির উত্তর পাশে মীর মোহাম্মদ হাসানের মালিকানাধীন পাহাড়ে ৩৮টি, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকাসংলগ্ন পাহাড়ে তিনটি, জালালাবাদ হাউসিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়ে ৩৩টি, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল পাহাড়ে ৩২০টি ও হিলভিউ টাংকি পাহাড়ের পাদদেশে ৪০০ পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। এ ছাড়াও আরো ১৯টি পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস রয়েছে সহস্রাধিক পরিবারের।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানের তুলনায় বাস্তবে বসবাসরত পরিবারের সংখ্যা অনেক বেশি। মতিঝর্ণা, বাটালি হিল, খুলশী, লালখান বাজার, পাহাড়তলী, টাইগার পাস, আমবাগান, বাটালি হিল রেলওয়ে কলোনি, পাহাড়তলী রেল কলোনি, বায়েজিদ বোস্তামি, হিলভিউ টাংকির পাহাড়, হাটহাজারী উপজেলার ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী সিটি কর্পোরেশন ওয়ার্ডের শাহ আমানত কলোনি, জঙ্গল পাহাড়তলী, কাছিয়াঘোনা, লেবু বাগান, ভাটিয়ারীসহ সীতাকুÐের সলিমপুর, লতিফপুর ও রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে লক্ষাধিক মানুষ।
দেখা যায়, লালখান বাজার মতিঝর্ণায় পাহাড়ের পাদদেশে কয়েকশ’ পরিবারের বসবাস। বায়েজিদ বোস্তামি হিলভিউ এলাকায় টাংকি পাহাড়ের পাদদেশে বসতি প্রায় ৮শ’ পরিবারের। টাংকি পাহাড়ের কোলঘেঁষে তাদের বসবাস। সামান্য বৃষ্টিতেই শুরু হয় পাহাড়ধস। তাতে ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যায়। জেলা প্রশাসন থেকে বার বার উচ্ছেদের নোটিশ দিলেও তারা সরে না গিয়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। মতিঝর্ণা এলাকায়ও একই অবস্থা। পাহাড়ের নিচে শত শত পরিবার বসবাস করছে। ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর এমনকি পাকা, আধা পাকা ঘর তৈরি করে বসবাস করছে তারা।
ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে থেকে সরে যেতে মাইকিং :
ভারী বর্ষণ ও ভূমি ধসের আশঙ্কার কথা জানিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সতর্কতা জারির পর পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত লোকজনকে সরে যেতে মাইকিং করেছে জেলা প্রশাসন। ‘মৃত্যুঝুঁকি’ নিয়ে বাস করা এসব লোকজনের জন্য নগরের বিভিন্ন এলাকায় চালু করা হয়েছে ৮টি আশ্রয়কেন্দ্র। প্রস্তুত রাখা হয়েছে পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রীও।
গতকাল শনিবার সকাল থেকে নগরের সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত লোকজনকে সরে যেতে মাইকিং কার্যক্রম শুরু হয়। এসব লোকজনকে সরিয়ে নিতে ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং সরকারি সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন পাহাড়গুলোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরিয়ে নেওয়া লোকজনকে যাতে অসুবিধায় পড়তে না হয়, এ জন্য আকবর শাহ এলাকায় পাহাড়তলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ফয়’স লেক এলাকার ফিরোজ শাহ ই-বøক স্কুল, পলিটেকনিক কলেজ এলাকায় চট্টগ্রাম মডেল হাই স্কুল, জালালাবাদ হাউজিং এলাকায় জালালাবাদ বাজার সংলগ্ন শেড, ট্যাংকির পাহাড় এলাকায় আল হেরা ইসলামিয়া মাদ্রাসা, মিয়ার পাহাড় এলাকায় রৌফাবাদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, মতিঝর্ণা পাহাড় এলাকায় লালখান বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পোড়া কলোনি এলাকায় ছৈয়দাবাদ স্কুলকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছে।
নগরের ৬টি সার্কেলের দায়িত্ব প্রাপ্ত ৬ জন সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার সমন্বয়ে এসব আশ্রয়কেেেন্দ্রর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে আশ্রয় নিতে আসা লোকজনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির মজুদ রাখা হয়েছে।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসের শঙ্কা থাকায় লোকজনকে সরিয়ে নিতে সকাল থেকেই বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। লোকজনকে সরে যেতে মাইকিং করার পাশাপাশি তারা যাতে আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারে এ জন্য ৮টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু এবং পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, কোনো লোক ঝূকিঁপূর্ণভাবে পাহাড়ে বাস করতে পারবে না। তাদেরকে আশ্রয় কেন্দ্র অথবা আত্মীয়-স্বজনের বাসায় চলে আসতে হবে। রাতে কেউ যাতে পাহাড়ে থাকতে না পারে- এ জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর, পাহাড়ের মালিক বা তদারকি সংস্থাকে আমরা অনুরোধ জানিয়েছি। প্রয়োজনে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা সেখানে অভিযান পরিচালনা করবেন। যেকোনো মূল্যে প্রাণহানি ঠেকাতে চাই আমরা।
জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, চট্টগ্রামে ১২ বছরে পাহাড় ধসে মারা গেছেন ২৩০ জন। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ১১ জুন স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এদিন ১২৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখান বাজারের মতিঝর্ণায় পাহাড় ধসে ১১ জন, ২০০৯ ও ২০১০ সালে নগরীর পাহাড়তলী, সিআরবি, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে মারা যান আরো ১৫ জন। ২০১১ সালের ১ জুলাই পাহাড় ধসে একই পরিবারের ৮ জনসহ বাটালি পাহাড়ের রিটেইনিং দেয়াল ধসে ১৯ জন মারা যান। ২০১২ সালে ১৭ জুন নগরীর ফিরোজশাহ কলোনিসহ বিভিন্ন এলাকায় ২০ জন, ২০১৩ সালে পাহাড় ও দেয়াল ধসে ৫ জন, ২০১৪ সালে ১২ জন, ২০১৫ সালে ৬ জন এবং ২০১৭ সালের ২১ মে ২ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময় আরো ১২১ জন পাহাড় ধসে নিহত হন। এরপরও মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে লক্ষাধিক মানুষ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন।
জেলা প্রশাসন কয়েক বছর ধরে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের সরাতে চেষ্টা করেও সফল হচ্ছে না। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালিয়ে ১০ পরিবারকে সরালে আরো ১৫ পরিবার আশ্রয় নেয়। ফলে পরিবারের সংখ্যা কমছে না।
জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের উচ্ছেদে আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রæটি নাই। বছরের প্রতিটি সময়ে তাদের উচ্ছেদে আমাদের অভিযান চলে। এজন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া আছে। গত কয়েকমাস থেকে তাদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। নোটিশও দেয়া হয়েছে।
বিভাগীয় কমিশনার অফিস সূত্রে জানা যায়, পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা রোধে শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৯ জনের প্রাণহানির পর বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২৮টি কারণ চিহ্নিত করে ৩৬টি সুপারিশ প্রণয়ন করলেও তার একটিও বাস্তবায়ন হয়নি।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশের মধ্যে ছিল, পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরতদের উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখা, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করতে পাহাড়ে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত থাকা, নীতিমালা প্রণয়ন, পাহাড়ে কাঁটাতারের ঘেরা দেয়া এবং সামাজিক বনায়নের আওতায় আনা, বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ, পাহাড়ের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা তৈরির অনুমোদন না দেয়া, ৫ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প না করা, উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের জন্য আধুনিক ও উন্নতমানের সরঞ্জামাদি ক্রয় করা। এ ছাড়া পাহাড় ধস এড়াতে এবং পাহাড় ব্যবস্থাপনার সভায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পাহাড় দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ, সরকারি মালিকানাধীন ঝুঁকিপূর্ণ যেসব পাহাড়ে বা পাদদেশের অবৈধ বসতি স্ব স্ব মালিক কর্তৃক উচ্ছেদসহ কমিটির সিদ্ধান্ত এখনো কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। সরকারি পাহাড়গুলোর মালিকানা রয়েছে রেলওয়ে, গণপূর্ত বিভাগ, ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের।
জানা যায়, রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় প্রভাবশালীরা পাহাড়ের পাদদেশে বস্তিঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছে। ভাড়াটিয়ারা সকলে নি¤œআয়ের লোকজন। তাদের কাছ থেকে মাসে এক থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়। জেলা প্রশাসন উচ্ছেদের চেষ্টা করলেও প্রভাবশালীদের কারণে সফল হয় না।
এদিকে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় বরিশাল ও চট্টগ্রামে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। আর অতি ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের সম্ভাবনা রয়েছে বলে সতর্ক করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
অপরদিকে বঙ্গোপসাগরে বায়ুচাপের তারতম্যে ঝোড়ো হাওয়ার জন্য চার সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত বহাল রয়েছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অধিদফতরের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আবদুল হান্নান জানান, লঘুচাপের প্রভাবে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার সৃষ্টি হয়েছে। এতে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সাবধানে চলাচল করতে হবে।