ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ কি বর্জন করা হবে?

95

ভারতের বতর্মান স্ব-রাষ্ট্রমন্ত্রী বি.জে.পি’র সর্বভারতীয় সভাপতি এবং ভারতের বর্তমান রাজনীতিতে দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব অমিত শাহ সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন বর্তমানে ভারতে বসবাসরত হিন্দু উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের বিনা কাগজপত্রে নাগরিকত্ব দেয়া হবে। শুধু একটি স্ব-ঘোষণা পত্রে বলতে হবে তাঁরা কবে এসেছেন। এজন্য তাঁদের কোন প্রমাণপত্র বা নথি দিতে হবে না। পশ্চিম বঙ্গ থেকে নির্বাচিত লোকসভা সদস্য শান্তানু ঠাকুরের সাথে আলোচনায় সম্প্রতি তাঁকে স্ব-রাষ্ট্রমন্ত্রী একথা জানিয়েছেন, তিনি আরও বলেছেন হিন্দুদের জন্য ভয়ের কোন কারণ নেই। শুধু স্ব-ঘোষিত পত্রে তাদেরকে লিখতে হবে তারা কখন ভারতে এসেছেন। এই আবেদনটুকু পেলেই তাঁদেরকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে। সে উদ্দেশ্যে অচিরেই ভারতীয় পার্লামেন্টে আনা হচ্ছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল।
আসামের জন্য যে নাগরিকত্ব বিল বা এন. আর. সি. অনুমোদিত হয়েছে ভয়ানক বিতর্কমূলক হওয়াতে তা প্রত্যাখ্যান করা হবে। স্ব-রাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্প্রতি বিভিন্ন বক্তব্য থেকে তা পরিষ্কার হয়েছে যে তিনি গত নভেম্বর মাসের ২০ তারিখ ভারতের রাজ্য সভার বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, সারা ভারত বর্ষে যখন এন.আর.সি. অনুষ্ঠিত হবে তখন আবার নতুন করে আসামে এন.আর.সি. অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেছেন যে আসামে সুপ্রিম কোর্টের এক আদেশ অনুযায়ী এন.আর.সি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, গত আগস্ট মাসের ৩১ তারিখে আসামে এন.আর.সি. সর্বশেষ প্রকাশিত হয়, তাতে আসামের ১৯ লক্ষের মত অধিবাসী এন.আর.সির লিস্ট থেকে বাদ পড়ে যায়। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে এই এন.আর.সির কাজ শেষ করতে চার বৎসরের মত সময় লেগেছে এবং সর্বমোট খরচ হয়েছে ১৬০০ কোটি ভারতীয় রূপি। এখন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুসারে এই মহামূল্যবান এন.আর.সি. বাস্তবায়ন না করে তা সমাধিস্থ করবেন। আসামের এই এন.আর.সি. পক্ষের বিপক্ষের বা সরকারের কাউকেও সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হয়নাই। এই ব্যাপারে যে বড় অংকের রূপি জলে গেছে তা দিয়ে বড় একটি উন্নয়ন প্রকল্প অতি সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো। এন.আর. সির ব্যাপারে অমিত শাহ এই বক্তব্য রাজ্য সভায় দেওয়ার পরক্ষণেই আসামের অর্থমন্ত্রী এবং বি.জে.পির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হেমন্ত শরমা রাজ্য সভায় এক বক্তৃতায় আসামে বর্তমান এন.আর.সি প্রত্যাখানের কারণগুলি রাজ্য সভায় সবিস্তারে পেশ করেছেন। এর পরিবর্তে তিনি সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী নূতন করে এন. আর. সির দাবি উত্থাপন করেছেন এবং সাথে সাথে পুনর্বার আসামেও এন.আর.সি. অনুষ্ঠানের দাবি করেছেন। অমিত শাহ এবং আসামের অর্থমন্ত্রীর একই দিনে রাজ্য সভায় একই ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার মধ্যে সিঃসন্দেহে হে গুরুত্ব রয়েছে এবং তা নিসন্দেহে পূর্ব-পরিকল্পিত। কাজেই এই দাবি যে বর্তমান বি.জে.পি. সরকারের অধিক বুদ্ধি সম্পন্ন দাবি এব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকতেই পারেনা। এখন প্রশ্ন হলো ভারতীয় স্ব-রাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র আমলাদের আপত্তি। আমলাদের মত হলো আগামী ২০২১ সালে ভারতের লোকসংখ্যা গণনা শুরু হবে, কাজেই লোকসংখ্যা গণনা শেষ হওয়ার আগে সারা ভারতে এন.আর.সি. অনুষ্ঠিত হওয়ার কোন প্রশ্নœই উঠেনা। ভারতীয় আমলারা সাধারণত এত বেশী অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যে শুধু ভারতের স্বাধীনতার স্থপতিরা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁরা ছাড়া পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীনরা আমলাদের সিদ্ধান্তের খুব একটা বাইরে যাওয়ার দৃষ্টান্ত খুব কমই রয়েছে। ইহা ছাড়ও ভারতীয় স্ব-রাষ্ট্রমন্ত্রীর অমিত শাহের সারা ভারতব্যাপী এন.আর.সি. অনুষ্ঠানের ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রবল ঝড় উঠেছে এবং এই প্রতিবাদ সারা ভারতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী, সি.পি.আই.এম শাসিত কেরালা সরকারের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী এবং বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা অনন্ত শর্মা সারা ভারত ব্যাপী এন.আর.সি. অনুষ্ঠানের ভারতীয় স্ব-রাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কংগ্রেস নেতা আনন্দ শর্মা বলেছেন ভারতের বর্তমান আইনে সারা দেশ ব্যাপী এন.আর.সি. অনুষ্ঠানের কোন বিধান নেই। কাজেই সারা ভারতব্যাপী এন.আর.সি. অনুষ্ঠান করা একটি শাসনতন্ত্র বিরোধী কাজ বলে গণ্য হবে। আসামে ১৬০০ কোটি রুপি খরচ করে যে এন.আর.সি. নামে লংকাকাÐ ঘটানো হয়েছে, সারা ভারত ব্যাপী তথাকথিত এন.আর.সি. অনুষ্ঠিত হলে ভারতের সার্বভৌমত্বই মহা-সংকটের সম্মুখীন হবে।
বি.জে.পি. যখন নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন তখন ভারতের মাথাপিছু আয় ১০ শতাংশের উপরেই ছিল। বর্তমানে তা ৪.৪৫ শতাংশে নেমে এসেছে। কাজেই ভারতের বড় বড় অর্থনীতিবিদরা মনে করেন নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে ভারতের অর্থনীতিকে ৫ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে নিয়ে যাওয়ার যে প্রতিশ্রূতি দিয়েছিলেন তা কোন দিন বাস্তবায়িত হবেনা।
বিশেষ করে আসামের ব্যাপারটাই ছিল ভিন্নরকমের। কয়েক শতাব্দীব্যাপী দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বহু দেশ থেকে, যেমন মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়া ইত্যাদি দেশের মানুষ আসামে এসে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছিল। কাজেই আসামের লোক এন.আর.সির দাবি করার পিছনে একটি ঐতিহাসিক কারণ ছিল এবং তাঁরা কোন অবস্থাতেই ধর্মের ভিত্তিতে এন.আর.সির দাবি করে নাই। বর্তমানে অনুষ্ঠিত এন.আর.সির পর অসমীদের যে অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা হয়েছে, ভবিষ্যতে এন.আর.সির নাম শুনলেই তাদের মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক থাকার কথা নয়। আসামে যে এন.আর.সি. অনুষ্ঠিত হয়েছে তা কোন ধর্মের ভিত্তিতে হয় নাই। কিন্তু বর্তমান বিজেপি সরকার যে উদ্যোগ নিতে প্রয়াস পাচ্ছেন তা হলো ধর্মভিত্তিক অর্থাৎ অ-মুসলিম অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই উদ্যোগ। কাজেই এই উদ্যোগে সম্পূর্ণ উত্তর পূর্ব ভারতে তীব্র প্রতিবাদের সৃষ্টি হবে। এরই মধ্যেই এই এলাকায় অশান্ত পরিবেশ দেখা দিয়েছে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিতভাবে বিচক্ষণ এবং সাহসী। সম্প্রতি নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক সভায় গত ৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেছেন যে দক্ষিণ এশিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘু মনোভাব থেকে সরে যাওয়া উচিত। তাঁর মতে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জাতিগত ও ভাষাগত বিভিন্নতা আমাদের গ্রহণ করা উচিত। তাঁর মতে শতাব্দী পর শতাব্দী ধরেই বহুত্ববাদই দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি হিসাবে বিরাজ করছে। এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যেই বন্ধুত্বের নিশ্চয়তা দিয়ে পারস্পরিক লাভবান হয়েছে।
আজকে যদি ভারত পূর্বের অবস্থানকে অস্বীকার করে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করতে চায়, পাকিস্তান যেমন মুসলিম দেশ হিসাবে আগে থেকেই ঘোষণা দিয়েছে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের শুরুতেই রাষ্ট্রের চারটি মৌলিক স্তম্ভের মধ্যে, ধর্ম নিরপেক্ষতা অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ হিসাবে ঘোষিত হয়েছিল। ভারতের বহুত্ববাদের যদি পরিবর্তন ঘটে, তখন বাংলাদেশকে এক নাজুক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে।
১৯৫০ সালের ফেব্রæয়ারি মাসের ৫ তারিখ লোকসভার অধিবেশনে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু বলেছিলেন-There can be no doubt that India and Pakistan, situated as they are geographically and otherwise and with their historical background, cannot carry on forever as enemies,. If they do, catastrophe after catastrophe will follow; either they will wipe each other or one will wipe the other and suffer the consequences, which is unthinkable.অর্থাৎ এখানে কোন সন্দেহ নাই যে ভারত এবং পাকিস্তান ভূগৌলিকভাবে, অন্যভাবে এবং ঐতিহাসিক পটভূমিকা বিবেচনায় আনলে বলা যায় তারা চিরদিন উভয় উভয়ের শত্রæ হিসাবে থাকতে পারেনা। তারা যদি তাই করে তাহলে উভয়ের উপর প্রলয়ের পর প্রলয় ঘটতে থাকবে, তারা হয়তো একে অপরকে ধ্বংস করে দিবে এবং উভয়েই ইহার ফলে ভুগবে যা চিন্তাও করা যায়না।
নেহেরু উপরোক্ত বিবৃতি দেওয়ার সময় ভারত ও পাকিস্তান কারও হাতে আণবিক অস্ত্র ছিলনা এখন উভয়ের কাছে আণবিক অস্ত্র। আনবিক অস্ত্রধারী দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে সোভিয়েট ইউনিয়নের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ বলেছিলেন। A war between the two would almost certainly end in mutual defeat. অর্থাৎ ‘দুজনের এক সাথে পরাজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হবে।’ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কোন যুদ্ধ হলে যেহেতু উভয়ের কাছে আণবিক অস্ত্র রয়েছে এবং সে অস্ত্র যদি ব্যবহৃত হয় তাহলে বাংলাদেশ বিনাদোষে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।