ভাটিয়ারিতে রাতের আঁধারে রয়েল বার্ড কেটে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা

17

দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে ভাটিয়ারী ইউনিয়নের সাগর উপক‚লে পড়ে থাকা “রয়েল বার্ড” জাহাজটি রাঁতের আধারে কেটে নিয়ে যাচ্ছেন উপজেলার ভাটিয়ারি এলাকার সংর্ঘবদ্ধ চোর চক্র। আর এই কাজে সহযোগিতা করছেন ভাটিয়ারি ইউনিয়ন পরিষদের প্রভাবশালী এক ইউপি সদস্য। গভীর রাতে সংর্ঘবদ্ধ চোর চক্র জাহাজে কাটিংয়ের কাজ শুরু করে ভোর রাত পর্যন্ত কাটিং কাজ কর ভাটিয়ারি উত্তর বাজার মুসার ডিপোতে নিয়ে আসে। এরপর ডিপো থেকে বাজার মূল্য স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে।
জানা যায়,উপজেলার ভাটিয়ারি সাগর উপক‚লে আটকে পড়া ২৬ বছর আগের ৩২৫০ টনের রয়েল বার্ড জাহাজটি পড়ে রয়েছে সাগরের তীঁরে। অনুরূপ আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যাওয়া টাইটানিক জাহাজের ন্যায় হয়েছে ‘রয়েল বার্ড’ জাহাজটি। নানা ধরণের প্রাকৃতিক শেওলা ও অন্যান্য সাগরের জীব বৈচিত্র্য ঘিরে রয়েছে এই জাহাজটিতে। এ যেন এক স্থির দানব। ২০২০ ও ২১ইং সালের প্রথম দিকে লৌহার চাহিদা ছিল না দেশে। বছরের মাঝামাঝি লৌহার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রি-রোলিং ও অটো রি-রোলিং মিল্সগুলোতে উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। এতে পুরাতন জাহাজের স্ক্র্যাপগুলোর দাম লাপিয়ে লাপিয়ে দ্বিগুন হয়ে যায়। স্ক্র্যাপের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ার কারণে রয়েল বার্ড জাহাজটির মালামাল (লৌহা) প্রতি রাতেই চোরচক্রের লিডার বাদশা ও তার দলবল নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার মালামাল তার বানানো পাইবার বোট দিয়ে কেটে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
পানামা পতাকাবাহী ক্যাপ্টেন ইমাম আনোয়ারের মালিকানাধীন রয়েল বার্ড জাহাজটি আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত গম নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। আমদানিকৃত গমগুলো পঁচা হওয়ায় এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঘোষিত মামলা বহাল থাকায় জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে রাখে। রয়েল বার্ড জাহাজটিকে বহির্নোঙ্গরে থাকা অবস্থায় ‘এম ভি এনাজের ইউসডম’ জাহাজের সাথে সংঘর্ষে জাহাজের তলা ফুটা হয়ে যায়। এতে জাহাজটি অবকাঠামোগতভাবে অকেজোঁ হয়ে পড়ে এবং দুইটি ইঞ্জিন থেকে একটি ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। দুর্ঘটনায়কবলিত রয়েল বার্ডের মালিক ইমাম হোসেন হাইকোর্টে ক্ষতিপূরণের জন্য এমভি এনাজের ইউসডম জাহাজের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
এ দিকে বর্ষা মৌসুমে সাগর উত্তাল থাকায় জাহাজের ক্যাপ্টেন ও ক্রুরা শত চেষ্টা করেও জাহাজটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারায় জাহাজে থাকা ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে একটি আবেদন করেন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজটি স্থানীয় উপকূলে বিচিং করার জন্য অনুমতি প্রদান করে। অনুমতি পেয়ে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম গম বোঝাই রয়েল বার্ড জাহাজটি ২১ জুলাই ১৯৯৫ ইং তারিখে সীতাকুÐের ভাটিয়ারী উপকূলে কুতুব সাহেবের মালিকানাধীন পদ্মা শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে পশ্চিমে সাগরের উপক‚লে নোঙ্গর করে। পদ্মা শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ড ভাড়ায় নেয় মাহাবুব (প্রকাশ রয়েল বার্ড মাহাবুব)। পদ্মা শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে রয়েল বার্ড জাহাজটি আটকে পড়ায় মাহাবুবের ক্রয়কৃত অন্য জাহাজগুলো বিচিং বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। যেহেতু রয়েল বার্ড জাহাজটি তাদের ইয়ার্ডে ছিল তার পরিপেক্ষিতে জাহাজের মালিক ইমাম আনোয়ার তাদেরকে আশ্বস্থ করেন জাহাজটি বিক্রির জন্য এবং রয়েল বার্ড বিøসিং তিন মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জাহাজে থাকা ক্যাপ্টেন ও ক্রুর বেতন নির্ধারিত সময়ে দিতে না পারায় মালিক ইমাম আনোয়ারের অনুরোধে মাহাবুব থেকে ২৫ লক্ষ টাকা অগ্রিম নিয়ে কর্মরত ক্যাপ্টেন ও ক্রুরদের বিদায় করে।
অপরদিকে দুর্ঘটনাকবলিত ‘রয়েল বার্ড’ জাহাজের মালিক মালিক ইমাম আনোয়ার হাইকোর্টে দায়েরকৃত মামলার ক্ষতিপূরণ বাবদ জরিমানা ৮ কোটি টাকা পায়। ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে ইমাম আনোয়ার লাপাত্তা হয়ে যায়। এরপর বিপাকে পড়েন জাহাজটির দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম এবং ইয়ার্ড মালিক মাহবুব।
ভাটিয়ারী ইউনিয়নের উপক‚ল এলাকায় বসবাসকারি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবক জানান, সম্প্রতি স্ক্র্যাপ লোহার দাম বৃদ্ধি হওয়ায় সংঘবদ্ধ চোর চক্রটি সন্ধ্যার পর থেকে প্রস্ততি নিয়ে অক্সিজেন, এলপি গ্যাসের বোতল ও জাহাজ কাটিংয়ের বিভিন্ন সরঞ্জাম সাথে নিয়ে রাতভর বড় বড় তেরপাল দিয়ে ঘুরে সারারাত জাহাজের ভিতরে কাটিং করে। জাহাজের কাটিং করা লোহার টুকরোগুলো ভোররাতে জাহাজ থেকে নামিয়ে ভোররাতেই ভাটিয়ারি উত্তর বাজার মুসার ডিপোতে ট্রাকে করেগ নিয়ে যায়। এরপর স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ীদের কাছে বাজার দরে বিক্রি করে।
সম্প্রতি জাহাজের পেছনে পিতলের পাখা যার মূল্য অর্ধ কোটি টাকার বেশি সেটি চোর চক্রের প্রধান বাদশা কেটে নিয়ে যান।
এ সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কোস্টগার্ড বাদশাসহ চোর চক্রের ১৬ জনকে আটক করে। থানায় মামলা পরবর্তী চোর চক্রের ১৬ সদস্যকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করেন এবং কোস্টগার্ডের সদস্যরা জাহাজের মূল্যবান পিতলের পাখাটি উদ্ধার করে পাশের একটি ইয়ার্ডে রেখে আসেন।
রয়েল বার্ড জাহাজের ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম বলেন, ‘পানামা পতাকাবাহী আমেরিকা থেকে আমদানীকৃত পঁচা গমধারী জাহাজটি (রয়েল বার্ড) বন্দরে বহিনোঙ্গরে ছিল। এতে জাহাজের মালিক ইমাম আনোয়ারের অনুরোধে আমি জাহাজের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব গ্রহণ করি। আকস্মিক দুর্ঘটনার কারণে উপকূলে বিচিং পর্যন্ত আমার প্রায় ৮৭ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। রয়েল বার্ডের মালিক ইমাম আনোয়ার ও হাজী সিরাজউদ্দৌলার সাথে দ্ব›দ্ব সৃষ্টি হওয়ায় এখন আমার প্রাপ্য টাকা আমি বুঝে পাচ্ছি না। বর্তমানে জাহাজটি ভাটিয়ারীর উপকূলে রাখা আছে। মালিকও ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে লাপাত্তা রয়েছেন’।
ইয়ার্ডের মালিক মাহাবুব বলেন, ‘ভাটিয়ারী সাগর উপকূলে কুবুতউদ্দিনের মালিকানাধীন পদ্মা শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ডটি আমরা ভাড়ায় নিই। রয়েল বার্ড জাহজটি আটকে যাওয়ায় আমাদের ক্রয়কৃত জাহাজগুলো বিচিং করে কাটা সম্ভব হচ্ছে না। আটকে যাওয়া রয়েল বার্ড জাহাজটি ইয়ার্ড থেকে সরানোর কথা বললে মালিক পক্ষ হাইকোর্টের মামলা নিষ্পত্তি হলে আমাদের কাছে কম দামে বিক্রি করবে বলে আশস্থ করেন। আটকে যাওয়ার তিন মাস পর দায়িত্বে থাকা জাহাজের ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম ও ক্রুরদের বেতন বাবদ ২৫ লক্ষ টাকা আমার কাজ থেকে ধার নেন। দুঃখের বিষয় ইয়ার্ডের ভাড়া বাবদ কোনো টাকা তো পেলাম না। এখন শুনতেছি হাইকোর্ট থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৮ কোটি টাকা পাওয়ার পর রয়েল বার্ড জাহাজের মালিক ইমাম আনোয়ারও লাপাত্তা রয়েছেন’।
সীতাকুণ্ড মডেল থানার ওসি মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘রয়েল বার্ড জাহাজটি সম্পর্কে আমি অবগত নই। তবে আপনাদের কাছ থেকে শুনার পর আমি বিস্তারিত খবর নিব। যে কোনো একটা পক্ষ তো এখানে অবশ্যই থাকবে। এত কোটি টাকার জাহাজ কেন চোর চক্র কাটবে’।