ভাই হত্যার বিচার পেতে করোনায়ও অদম্য লড়াই

733

ছয় বছর আগে চোখের সামনেই বড় ভাইয়ের নির্মম কায়দায় হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ করেন মোহাম্মদ ইকবাল। দেখেন ভাইয়ের মৃত্যু যন্ত্রণার ছটফট অবস্থা। হত্যা মামলার আসামিরা বাঘা বাঘা ক্যাডার। রাঙ্গুনিয়ার রানিরহাট এলাকায় সংঘটিত হয় এ হত্যাযজ্ঞ। ক্যাডারদের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন ইকবালের বড়ভাই জিল্লুর রহমান। মাইজভান্ডারের ভক্ত বলে এলাকায় পরিচিত ছিলেন জিল্লুর ভান্ডারি হিসেবে। ঘটনার পর স্বাভাবিক নিয়মেই হত্যা মামলা হয় রাঙ্গুনিয়া থানায়। কিন্তু মামলার আসামিরা যে শক্তিশালী! তাই মামলা তুলে নিতে আসে ‘হুমকি পরোয়ানা’। তবে ইকবালদের একটাই প্রতিজ্ঞা, ভাই হত্যার বিচার পাওয়া। বিচার পেতে যত কষ্টই করতে হয় হোক। সেই থেকে শুরু হল বিচার পাওয়ার লড়াই। যা থামেনি এখনও। শত প্রতিক‚লতা, রক্তচক্ষু, মৃত্যু হুমকি, সন্তানকে অপহরণের প্রচ্ছন্ন হুমকিতে দমেনি ইকবালরা। নয়ন ভাসিয়ে কান্নাকে বিচার পাওয়ার দায়মুক্তি হিসেবে মানতে কোন মতেই রাজি নন তারা। তাই গেল ছয়টা বছর বিচার পাওয়ার পথেই হেঁটেছেন। বৈশ্বিক সংকট করোনা মহামারির সময়েও প্রবাস থেকে ছুটে এসেছেন ইকবালসহ তিনভাই। সবধরনের আর্থিক সমর্থন যোগিয়েছে সৌদি আরবে থাকা আরেক ভাই। মোটা দাগে বিচার পাওয়ার লড়াইয়ে ছয় বছর ধরে ঘরছাড়া জিল্লুর ভান্ডারির (ভিকটিম) পাঁচভাই আইন আদালতের পথেই হাঁটছেন। এ এক অন্যরকম লড়াই। বিচার পাওয়ার জন্য এত দম চট্টগ্রামে মামলার ক্ষেত্রে বিরল উদাহারণ।
প্রসঙ্গতঃ ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে রানিরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয় গেটের সামনে ভিকটিম জিল্লুর রহমান ভান্ডারিকে আসামিরা এলোপাতাড়ি মারধর ও উপর্যুপরি গুলি করে মারাত্মকভাবে জখম করে। ভিকটিমের ভাই মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন বাবলুকে ঘটনার তিনমাস আগে কাতারে নেন আসামি ইসমাইল প্রকাশ পিস্তল ইসমাইলের ভাই মোহাম্মদ জব্বার। কিন্তু জব্বার বাবলুকে কাতারে পতাকা লাগিয়ে না দেয়ায় বাবলুর সাথে জব্বারের কথা কাটাকাটি হয়। এ অবস্থায় বাবলুর ভিসা বাতিল করে তাকে দেশে পাঠিয়ে দেন জব্বার। এ অবস্থায় একই বছরের ২০ জানুয়ারি রাত ৮টার দিকে ইসমাইলকে রানিরহাট বাজারে পেয়ে ভিকটিম জিল্লুর রহমান ভান্ডারি তার ছোট ভাই বাবলুকে দেশে পাঠানোর কারণ জানতে চান। একইসাথে ভিসা বাবত দেয়া দুইলাখ ৫০ হাজার টাকা ফেরত দিতে বলেন। এসময় তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। পরের দিন রাত সাড়ে ৮টায় আসামিরা রানিরহাট সিএনজি টেক্সি স্টেশনে জিল্লুরকে পেয়ে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে। এক পর্যায়ে তাকে উল্লেখিত প্রাথমিক বিদ্যালয় গেটের সামনে নিয়ে পায়ে গুলি করা হয়। এ ঘটনায় গুরুতর জখম হন জিল্লুর রহমান ভান্ডারি। তাকে প্রথমে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনার পর তার মৃত্যু হয়। হত্যাকান্ডের পর মামলা করেন ভান্ডারির ছোটভাই আজিম উদ্দিন। কিন্তু উপর্যুপরী হুমকির মুখে তিনি বিদেশ পাড়ি জমান। একই পথ ধরেন আজিম উদ্দিন ও মোহাম্মদ ইকবালও। এরই মধ্যে ২০১৭ সালে ইকবালের ৩য় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেকে অস্ত্র ঠেকানো হয় মামলা তুলে নেয়ার জন্য। সেই থেকে রাঙ্গুনিয়ায় আর থাকা হয়নি ওই পরিবারের কারোর (মা ছাড়া)। ভিকটিমের দুইভাই থাকেন সৌদি আরব, তারা হলেন মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও মোহাম্মদ ইকবাল। দুইভাই কাতারে, তারা হলেন আজিম উদ্দিন ও জিয়াউদ্দিন বাবলু। কিন্তু নাছির ছাড়া অন্য তিনভাই সাক্ষ্য দিতে প্রবাস থেকে বারবার ফেরেন দেশে। চট্টগ্রাম আদালত ডাকতেই নির্দিষ্ট সময়ে হাজির হন তারা। আলোচিত ওই মামলার সাক্ষী এ তিনভাই। যেখানে একের পর এক সমন ইস্যু করা হলেও বহু সাক্ষী দিনের পর দিন আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হন না, সেখানে এ তিনভাই ব্যতিক্রম। তাদের কাছে অর্থ নয়, হুমকিও মুখ্য বিষয় নয়। ভাই খুনের মামলার সঠিক বিচার হওয়াই মূল লক্ষ্য।
আদালতের সমন পেয়ে দেশে ফিরে আসা সাক্ষী তিনভাই হলেন কাতার প্রবাসী জিয়াউদ্দিন বাবলু ও মোহাম্মদ আজিম উদ্দিন এবং সৌদি আরব প্রবাসী মো. ইকবাল। সর্বশেষ গত বছরের ২ ফেব্রূয়ারি কাতার থেকে ফিরে চট্টগ্রাম আদালতে সাক্ষ্য দেন জিয়াউদ্দিন বাবলু। সাক্ষ্য দেওয়ার সমন পেয়ে তিনি ২১ জানুয়ারি কাতার মদিনা মোরা থেকে দেশে আসেন। এর আগে ২০১৯ সালের ১৪ আগস্ট কাতার মদিনা মোরা থেকে দেশে আসেন অন্য সাক্ষী মোহাম্মদ আজিম উদ্দিন। তার আগে ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট সৌদি আরবের আবহা কামিজ মোসাইতে এলাকা থেকে দেশে আসেন অপর সাক্ষী মো. ইকবাল।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, মামলার বিচারিক কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য মোহাম্মদ ইকবাল প্রথমে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে দেশে আসেন। অনেক চেষ্টার পরও আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি তখন। এরপর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে আবার দেশে আসেন ইকবাল। চারমাস পরে আবার চলে যান সৌদি আরবে। পরের বছর ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে দেশে আবার আসার পর এ মামলায় ১৩ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়। বিচার শুরু হয় আসামিদের। ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই মামলার প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণের দিনে আদালতেই আসামিদের কড়া হুঙ্কার সাক্ষীদেরকে। এ নিয়ে কোতোয়ালী থানায় দায়ের হয় জিডি। পুলিশ তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেয়ে দায়ের করে মামলা। ওই মামলায়ও আসামি জসিম ও কামাল বর্তমানে বিচারের মুখোমুখি।
এ বিষয়ে প্রবাসী মোহাম্মদ ইকবাল জানান, আদালতেই আমাদেরকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে ওরা মনে করেছিল আমরা ভয়ে পালিয়ে যাব। কিন্তু ভাই হত্যার বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমরা থামছি না।
চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পিপি লোকমান হোসেন বলেন, উচ্চ আদালত থেকে চাঞ্চল্যকর জিল্লুর হত্যা মামলাটি ছয়মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রপক্ষ ও আদালত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার আলোকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিই। এ মামলার বেশ কয়েকজন সাক্ষী বিদেশে থাকেন। কিন্তু আদালত থেকে সমন দেওয়ার পর যথাসময়ে তারা আদালতের নির্দেশে বিদেশ থেকে এসে আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দেন। এটি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যরকম দৃষ্টান্ত। এক প্রশ্নের জবাবে পিপি লোকমান বলেন, অনেক মামলায় সাক্ষীদের সমন দিলেও বছরের পর বছর সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেন না। এ মামলায় প্রবাসী তিনভাই সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
এদিকে সাক্ষ্য গ্রহণ চলাকালীন মামলার বাদী আজিম উদ্দিন আদালতের ডাকে সাড়া দেন। আদালতের সামনে সাক্ষ্যও দেন। কিন্তু পুরো শেষ করতে পারেননি। ভিসা জঠিলতার কারণে তাকে চলে যেতে হয়েছে। ওই সময় বিচারক হিসেবে এ মামলায় দায়িত্ব পালন করছিলেন প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মুন্সি আবদুল মজিদ। সাক্ষ্যগ্রহণও চলতে থাকে। মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য যখন করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগে হাইকোর্ট থেকে আদেশ আসে তখন সৌদি আরব থেকে আবারও দেশে আসেন মোহাম্মদ ইকবাল। ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট এ যাত্রায় দেশে আসার পর করোনার কবলে পড়ে এখনও যাওয়া হয়নি তার। কবে যেতে পারবেন তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। এসময় দেশে আসেন জিয়াউদ্দিন বাবলু। মামলার এজাহার পরীক্ষণ করে তিনি সম্প্রতি চলে যান। কিন্তু ইকবালের ভিসার মেয়াদ পরপর চারবার বাড়ানো হয়েছে শুধু এ মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন করা পর্যন্ত থাকার জন্য। এ পর্যন্ত মামলায় ২৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব সম্পন্ন করেছেন আদালতের বিচারক। গেল ১৫ এপ্রিল আসামিদের পক্ষে সাফাই সাক্ষীর তারিখ নির্ধারিত ছিল। লকডাউনের কারণে সেটা আর হয়নি।
সৌদি প্রবাসী সাক্ষী মো. ইকবাল হোসেন বলেন, বিদেশে চাকরি করতে যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছি দেশের টান কী। আমাদের সামনে জিল্লুর ভান্ডারিকে খুন করা হয়। সেই মামলায় আমরা তিনভাই সাক্ষী। এ মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালনায় এ পর্যন্ত ১৫ লাখের বেশি টাকা খরচ হয়েছে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সৌদি ও কাতার থেকে এসে আমরা চট্টগ্রাম আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছি। আসামিদের কঠোর শাস্তি হলে আমাদের এ ত্যাগ সার্থক হবে।
বর্তমানে মামলাটি চলছে চট্টগ্রাম প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ শেখ ছামিদুল ইসলামের আদালতে। এ ঘটনায় ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি ভিকটিমের ছোট ভাই মোহাম্মদ আজিম উদ্দিন রাঙ্গুনিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করার পর ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর তদন্ত শেষে সিআইডি শহীদুল ইসলাম খোকনকে প্রধান আসামি করে আদালতে চার্জশিট জমা দেন। ২০১৯ সালের ২৮ মে ১৩ আসামির বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়।
এ বিষয়ে মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী সাবেক মহানগর পিপি এডভোকেট আবদুস সাত্তার জানান, এ মামলায় বাদীপক্ষের লোকজন নিজ হাতে এক আসামিকে ধরে পুলিশের হাতে তুলেও দিয়েছে। বিচার পাওয়ার জন্য বাদীপক্ষের এ ধরনের লড়াই বিরল ঘটনা আদালত অঙ্গনে।