ভবিষ্যৎ জননীদের জন্য চাই সুষম খাবার

23

দীর্ঘদিন ধরে লোকমুখে প্রচলিত বিশ্বাসযোগ্য কথা বা জনশ্রুতিকে আমরা প্রবাদ বাক্য বলে অভিহিত করি। প্রবাদ বাক্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য খুঁজতে গেলে দেখা যাবে তা মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচারের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। সেই সুদূর অতীত থেকে চলে আসা এ জনশ্রুতিগুলোর বাস্তবতার এতটুকু হেরফের হয়নি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শতভাগ প্রাসঙ্গিক হয়ে পথভোলা মানুষকে দিয়ে যাচ্ছে পথের নিশানা। তেমন একটি প্রবাদ বাক্যের নাম ‘উনা ভাতে দুনা বল’। এ প্রবাদ বাক্যটিতে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো পেট পুরে খাওয়ার চেয়ে একটু কম খাওয়া ভোজনবিলাসী মানুষের জন্যে তো বটেই সব মানুষের জন্য ভালো। এতে করে শরীরে যেমন সহজে কোনো রোগ ব্যাধি বাসা বাঁধতে পারে না তেমনি শরীর থাকে চাঙা, মন থাকে ফুরেফুরে। কাজে কর্মে মন বসে, স্বাভাবিক কর্মস্পৃহা বজায় থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানও তাই বলে। পেট পুরে ঢেকুর তুলে খাওয়ার চেয়ে অন্তত এক মুঠো কম খেলে শরীরে বেশ সতেজতা অনুভূত হয়। বিপরীতে পেট পুরে খেলে কিছুক্ষণের মধ্যে ঝিমুনির ভাব আসে। হাত ও পায়ের নাটবল্টুগুলো আলগা আলগা মনে হয় । ইচ্ছে হয় এই এখুনি বিছানায় গিয়ে শুইয়ে পড়ি।
তবে এ ‘উনা ভাতে দুনা বল’ প্রবাদটি বাড়ন্ত বয়সের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে উপকারের চেয়ে ক্ষতিরই কারণ হয় বেশি। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালীন সময়টায়। এ নিয়ে একটি সুন্দর লিমেরিক এর কথা মনে পড়ছে এ মুহূর্তে। লিমেরিকটি এ রকম-
‘উনা ভাতে দুনা বল এই কথা শুনিয়া
খেতে বসে কম খায় ও বাড়ির চুনিয়া
এইভাবে কম খেয়ে
একদিন দেখে চেয়ে
লাটিমের মতো ঘোরে গোটা এই দুনিয়া’।
আমাদের দেশের মেয়েরা অনুকরণপ্রিয়। বিশেষত টিনএজ মেয়েরা কে কখন কোন দিকে ঝুঁকে পড়ে তা বোঝা মুশকিল। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও অনেকটা তাই। বর্তমানে আমাদের দেশে টিনএজদের মধ্যে স্লিম থাকার প্রবণতা লক্ষ নীয়। আর স্লিম থাকার জন্য তারা যে পদ্ধতি বেছে নিচ্ছে তা মোটের উপর বিপজ্জনক। যে বয়সে ঠিকমতো খাওয়ার কথা সে বয়সে কেউ যদি কম খায় কিংবা স্লিম হওয়ার জন্য খাবার নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে দু’চোখে আঁধার নামাটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়।
সাধারণত ৮ থেকে ৯ বছর বয়সে বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হয়। ১২ থেকে ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত একজন কিশোরী বা টিনএজ মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক নানাভাবে পরিবর্তন ঘটে। এ পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে এ সময় তার জন্য প্রয়োজন সঠিক পুষ্টিসমৃদ্ধ সুষম খাবার। বয়ঃসন্ধিকালীন একজন কিশোরীর খাবারের ব্যাপারে বেশ সচেতন হতে হয়। এ সময় প্রয়োজনীয় পুষ্টি বা খাদ্যের মান সুষম না হলে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। অনেক সময় সঠিক ধারণার অভাবে কোনো কোনো কিশোরীর শারীরিক বৃদ্ধি ঠিকমত হয় না। আবার কেউ হঠাৎ মোটা হয়ে যায়। কেউ ভুগতে থাক এনিমিয়ায়। এনিমিয়া বলতে আমরা বুঝি রক্তস্বল্পতা। মানুষের শরীরে রক্ত তৈরি হওয়ার জন্য আয়রন বা লৌহ নামক খনিজ লবণ একান্ত প্রয়োজন। এ লৌহের ঘাটতি হলে শরীরে রক্ত তৈরি হয় না। ফলে এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা হয়। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে শতকরা সত্তরজন ছেলেমেয়ে এবং গর্ভবতী মহিলা শরীরে লৌহজনিত পুষ্টি উপাদানের অভাবে রক্তস্বল্পতায় ভোগে। রক্তস্বল্পতার কারণে আমাদের দেশের প্রায় ৫৫% মহিলা অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেয়। ফলে এদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করে এবং অন্যান্য অসুখে সহজেই আক্রান্ত হয়। বয়ঃসন্ধিকালীন সময় কারো কারো দেখা দিতে পারে ভিটামিনের অভাবজনিত নানা সমস্যা। কারণ এ সময়টায় একজন কিশোরীর শরীর ও মনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এ পরিবর্তন স্বাভাবিক ঘটনা। তবে এ স্বাভাবিকতার সাথে অনেকে ঠিকমত খাপখাইয়ে নিতে পারে না। তাই এ সময়টায় মা, বড়বোন, ফুফিদের উচিত তাদের ঘরের কিশোরী মেয়েটার বিশেষভাবে যত্ন নেওয়া।
বয়ঃসন্ধিতে মেয়েদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মাসিক হওয়া। মাসিকের ফলে কোনো কোনো মেয়ে রক্তস্বল্পতায় ভুগতে পারে। কারণ মাসিকের দিনগুলোতে একটি মেয়ের এক মিলিগ্রাম করে আয়রন চলে যায়। তাই বাসাবাড়ির কিশোর ছেলেটার চেয়ে কিশোরী মেয়েটির এ সময় প্রচুর আয়রনযুক্ত খাবার খাওয়া প্রয়োজন। একজন কিশোরের যেখানে প্রতিদিন ১১ মিলিগ্রাম আয়রন প্রয়োজন সেখানে একজন কিশোরীর প্রয়োজন ১৫ মিলিগ্রামেরও বেশি আয়রন। এ বাড়তি আয়নের চাহিদা মেটাতে কোনো পরিবারের তেমন কোনো বাড়তি খরচের প্রয়োজন পড়ে না। প্রয়োজন শুধু সচেতনতা। বাড়ির কাছের যে কচু শাক অযতেœ অবহেলায় বেড়ে উঠছে তা হতে পারে আয়রনের ভালো উৎস।প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যোপযোগী কাল কচুশাকে প্রায় ৩৮ মিলিগ্রাম আয়রন রয়েছে। পক্ষান্তরে প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনো খেজুরে রয়েছে মাত্র ৭ মিলিগ্রাম আয়রন। সবুজ শাক সবজিতেও রয়েছে প্রচুর আয়রন। আর যাদের সামর্থ্য আছে তারা তাদের কিশোরী মেয়েটিকে অনায়াসে খাওয়াতে পারেন ডিম, মাংস,কলিজা, নানা ধরনের ফল, বিশেষ করে আনার, বেদানা, খেজুর, সফেদা, কিশমিশ ইত্যাদি।
আজকের কিশোরী আগামীদিনের মা। আমরা জানি একজন সুস্থ, সবল মা-ই পারে একটি সুস্থ,স্বাভাবিক শিশুর জন্ম দিতে। আমাদের দেশে কম ওজনের শিশুর জন্মের জন্য যেসব কারণ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মায়ের অপুষ্টি। লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে গ্রামাঞ্চলে এখনো মেয়েরা অবহেলার শিকার। বাড়ির কিশোর ছেলেটার মতো তারও যে যত্ন পাওয়ার অধিকার আছে তা অনেক পরিবারে স্বীকার্য নয়। অনেকটা অনাদরে অবহেলায় বেড়ে উঠে এক সময় বিবাহযোগ্য হয়ে ওঠে কিশোরী মেয়েটি। তাই কিশোর বয়স থেকেই আমাদের ভবিষ্যৎ মা-দের গড়ে তুলতে হবে সুস্থ ও সবলভাবে।
শারীরিক বৃদ্ধি ও মজবুত হাড়ের জন্য কিশোরীদের প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি দরকার। মজবুত হাড় গঠনের জন্য খেতে হবে দুধ,দুগ্ধজাত খাবার, যেমন দই, পনির, কাটাযুক্ত ছোটোমাছ এবং পাতাওয়ালা সবুজ সবজি ইত্যাদি। শাক পাতার মধ্যে প্রচুর ক্যালসিয়াম আছে ফুলকপি পাতা, কালো কচু শাক, সবুজ কচু শাক ও লাল শাকে। সবজির মধ্যে ক্যালসিয়াম বেশি থাকে ডাটা, মিষ্টি কুমড়োর ফুলে। মাছের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যালসিয়াম আছে চিংড়ি শুটকিতে। এ ছাড়া শুকনো ভেটকি,শুকনো গলদা চিংড়িতেও প্রচুর ক্যালসিয়াম বিদ্যমান। ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটাতে এগুলো সুযোগমতো খাওয়ানো যেতে পারে।
সঠিক বেড়ে উঠা ও পেশি বৃদ্ধির জন্য একজন কিশোরীর দৈনিক ৩৪ গ্রাম আমিষ দরকার। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত এ আমিষের চাহিদা হবে ৪০ গ্রাম। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ডাল জাতীয় খাবার হলো আমিষের উৎস। সামর্থ্য অনুযায়ী যে কোনো পরিবার এ সব উৎস থেকে নিজেদের আমিষের চাহিদা মেটাতে পারে। এর বাইরে কিশোরী মেয়েদের আয়োডিন, জিন্ক ও সালফেট জাতীয় খনিজ পদার্থের চাহিদা বেশি। এ চাহিদা পূরণে খেতে হবে সামুদ্রিক মাছ, সবুজ শাকসবজি ও ফল।
কিশোর বয়সে অনেক কিশোরী হঠাৎ মুটিয়ে যায়। এ অবস্থায় দেখা দিতে পারে নানা হরমোন জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যাগুলোর প্রধান ক’টি হলো মাসিক অনিয়মিত হয়ে পড়া, মুখে লোম গজানো। এ জাতীয় সমস্যা প্রতিরোধে চাই খাবার নিয়ন্ত্রণ। ভাজাপোড়া, মিষ্টিজাতীয় খাবার, ফাস্ট ফুড এবং কোমল পানীয় পরিহার করা গেলে অনেক অসহনীয় ও বিব্রতকর পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব। তবে স্লিম হওয়ার জন্য কোনো রকমের খাবার নিয়ন্ত্রণ উপকারের বদলে অপকারই করে থাকে বেশি। তাই সিøম হওয়ার জন্য কখনো খাবার খাওয়া কমিয়ে দিতে নেই। আমাদের টিনএজ মেয়েরা বা তাদের অভিভাবকেরা বিষয়টা যতবেশি মাথায় রাখবে তারা ততবেশি উপকৃত হবে। দেশ পাবে সুস্থ, সবল, নিরোগ কিশোরী তথা আগামীর জননী।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক