বড় ভূমিকম্পে বড় ক্ষতির ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম

28

তুষার দেব

চট্টগ্রাম মহানগরীসহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হলে তাতে ধ্বংসযজ্ঞের ঝুঁকিই বেশি দেখছেন ভূ-তত্ত্ববিদরা। ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি কিংবা এ ধরনের দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় ১৩টি সংস্থা বিদ্যমান থাকলেও এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে কারিগরি সক্ষমতার ঘাটতির পাশাপাশি পারস্পরিক সমন্বয়েরও অভাব রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ভূমিকম্পজনিত সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় এখন থেকেই সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন তারা।
বিগত প্রায় দেড় দশক ধরে দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরে ভূমিকম্পের তাৎক্ষণিক গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকা ভূ-তত্ত্ববিদ মো. মমিনুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, চলতি বছরের সর্বশেষ গত তিন মাসেই দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অন্তত সাত দফা ভূমিকম্প হয়েছে। তার আগে গত ২৯ মে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত একদিনেই উপর্যূপরি চার দফা ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। ওই ভূকম্পনের উৎপত্তিস্থল সিলেটের জৈন্তাপুর ও এর আশপাশে ছিল। গতকাল শুক্রবার ভোররাত পাঁচটা ৪৫ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে অনুভ‚ত হওয়া ছয় দশমিক দুই মাত্রার ভ‚মিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে তিনশ’ ৩৯ কিলোমিটার দূরে প্রতিবেশি মিয়ানমারের চিন রাজ্যের ফালাম এলাকার ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। এটির কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩২ দশমিক আট কিলোমিটার গভীরে। মিয়ানমারের প্লেট বাউন্ডারি লাইনে একটি মাইক্রোপ্লেটের কাছাকাছি ‘সেগিং ফল্টে’ এ ভূমিকম্প হয়েছে। ওই অঞ্চল অতি ভূমিকম্পপ্রবণ। কিছুদিন আগেও একই জায়গায় ভূমিকম্প হয়েছিল। এ ফল্ট লাইনে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের শঙ্কা রয়েছে।
খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তত্ত¡াবধানে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) আওতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত¡বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. এএসএম মাকসুদ কামালের নেতৃত্বে দেশে প্রথমবারের মত এ সংক্রান্ত ডিজিটাল জরিপের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ওই জরিপ প্রতিবেদনে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এক লাখ ৮০ হাজার ভবনের মধ্যে এক লাখ ৪২ হাজার আবাসিক-ব্যবসা-বাণিজ্যিক ভবনকে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, রিখটার স্কেলে সাত থেকে আট মাত্রার মধ্যে ভূমিকম্প সংঘটিত হলে সেসব ভবন কম-বেশি ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হতে পারে। নগরীতে শতকরা ৭৮ ভাগ ভবন ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড এবং সিডিএ’র অনুমোদিত নক্শা লঙ্ঘন করে অপরিকল্পিত ও ত্রূটিপূর্ণভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। জরিপে আরও দেখা গেছে, নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে এক হাজার ৩৩টি বিদ্যালয় ভবন রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত সাতশ’ ৪১টি উচ্চ মাত্রার সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। কমপক্ষে ২৭টি হাসপাতাল ও ১৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, একটিতেও ভূমিকম্প প্রতিরোধক কোনও ব্যবস্থাই নেই।
অপরদিকে ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকেও ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রাম ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এ কারণে যে, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে ভূগর্ভস্থ যে তিনটি ফল্ট লাইন আছে সেখান থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব খুবই কম। যেখানে আট দশমিক পাঁচ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হলে মারাত্মক ক্ষতি হবে। এতে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংসসহ কয়েক লাখ লোকের প্রাণহানিরও আশঙ্কা আছে। অনেক সরকারি স্থাপনাসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু ভবন ভূমিকম্প সহনীয়ভাবে তৈরি করা হয়নি।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক উপাচার্য ও ভূ-তত্ত্ববিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম পূর্বদেশকে বলেন, চট্টগ্রামে দেশেও প্রধান সমুদ্রবন্দর, জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও একাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ চট্টগ্রামের দেড় লক্ষাধিক স্থাপনা ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন বন্ধ করার পদ্ধতি থাকলেও আমাদের দেশে তা নেই। ভূমিকম্পের কারণে বৈদ্যুতিক ও গ্যাস লাইন ভেঙে পড়লে শর্টসার্কিটের মাধ্যমে আগুন লেগে যেতে পারে। দেশের অন্যতম তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারী; যেটি চট্টগ্রাম বন্দরের পাশে অবস্থিত। সেখানে ভূমিকম্প হলে ট্যাংক ফেটে আগুন ধরে এটিসহ পুরো চট্টগ্রাম বন্দর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাছাড়া দুর্যোগ সামলানোর প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সরঞ্জামেরও অপর্যাপ্ততা রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক নিউটন দাশ পূর্বদেশকে বলেন, নাগরিকদের অসেচতনতা ও বিধিবিধান অনুসরণে অনভ্যস্ততার কারণে নগরে অপরিকল্পিতভাবে ভূমিকম্প প্রতিরোধক প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়াই বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। শহরের অভ্যন্তরে যোগাযোগ নেটওয়ার্কও পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়নি। তাতে যে কোনও দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার কাজও অত্যন্ত দুরুহ ও সময়সাপেক্ষ হবে। ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগে শহরের সড়ক নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হলে আশপাশে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করা কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল এবং প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতিরও অপর্যাপ্ততা রয়েছে। ফলে অতীতেও বিভিন্ন দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার অভিযান পরিচালনায় হিমশিম খেতে হয়েছে।
উল্লেখ্য, গ্লোবাল আর্থকোয়েক মডেলে রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা চার দশমিক নয় মাত্রার হলে সেটিকে ‘মৃদু’ ভূমিকম্প বলা হয়। কম্পনের মাত্রা পাঁচ থেকে পাঁচ দশমিক নয় হলে ‘মাঝারি’ আর ছয় থেকে উপরের দিকে হলে সেটি ‘উচ্চ’ মাত্রার ভূমিকম্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।