ব্র্যান্ড ভ্যালু: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত

78

উন্নত দেশের আলো জ্বলমলে শপিংমলগুলোর জারা, এইচ এন্ড এম, ইউনিক্লো, গ্যাপ ইত্যাদি বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড শপগুলোতে কাপড়ের গায়ে Made in Bangladesh ট্যাগ দেখলেই একজন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সবসময় গর্ব অনুভব করি। বিশ্বখ্যাত এসব নামিদামি ব্র্যান্ডের জিনিস বাংলাদেশে আমরা বানাই। তার পরও আমরা এত গরিব কেন আর যারা আমাদের দিয়ে এসব বানায় তারাই বা এত ধনী কেন? এটার একটি উত্তর হতে পারে ব্র্যান্ড ভ্যালু। বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিয়ত কাপড় নেয়া জারা ব্র্যান্ডের মালিক আমান্সিও ওর্তেগা পৃথিবীর পঞ্চম ধনী, যার সম্পদের মূল্য ৭০ বিলিয়ন ডলার। একটি জারার জামার দাম হয়তো ৩ হাজার টাকা, সেটার মধ্যে আমরা হয়তো পাই ১০-২০ টাকা আর সেটার খরচ হয়তো ৩০০ টাকা। রহিম মিয়ার কষ্টের কফির দাম ৩০ টাকা আর সেই একই কফি স্টারবাকসে গেলে হবে ৩০০ টাকা।
ব্র্যান্ডের এমনই ভ্যালু। প্রসঙ্গত, পাশের দেশের রিলায়েন্স কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু কত জানেন? মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলার, বাংলায় ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো। আর কোকা-কোলার ক্ষেত্রে সেটা ৩৬ বিলিয়ন ডলার, অ্যাপলের সেটা ২০৫ বিলিয়ন ডলার। ভাবা যায়, মাত্র একটি কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু দিয়ে কয়টা পদ্মা সেতু, কয়টা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনা বানানো যায়? ব্র্যান্ডের এসব ভ্যালু আমরা বুঝি না, আর বুঝি না বলেই এত বছর গার্মেন্ট শিল্পে এক্সপোর্ট লিডিং পজিশনে থাকার পরও একটি বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড দাঁড় করাতে পারলাম না! ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইবিএ থেকে শুরু করে নর্থ সাউথ, ব্র্যাকসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্র্যান্ডিং নিয়ে পড়ানো হয়। প্রতি বছর এত এত মানুষ মার্কেটিং, ব্র্যান্ডিং শিখছে আর সেটার বাস্তবিক প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই না। আমি জানি, একটি ব্র্যান্ড দাঁড করানোর জন্য অনেক চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়, অনেক বাধা আসে, কিন্তু তাই বলে আমরা একটি কোম্পানিও অন্তত আঞ্চলিক ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড়াবে না? এটার পেছনের কারণ হিসেবে আমার মনে হয় আমাদের কোম্পানিগুলোর আকাক্সক্ষা কম অথবা বিশ্ব ব্র্যান্ডের দাম বুঝি না অথবা আসলেই আমাদের মেধা কিংবা দক্ষতার অভাব রয়েছে। আমি জানি আমাদের কিছু কোম্পানি বিদেশে ওষুধ, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস রফতানি করছে, কিন্তু এটার পরিমাণের সঙ্গে ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’র তুলনা করা বোকামি ছাড়া কিছুই না।
চামড়া, পোশাক শিল্প ও ওষুধ শিল্প-অন্তত এ তিনটি খাতে আমাদের বিশ্বমানের কিছু ব্র্যান্ডেড কোম্পানি থাকা উচিত ছিল। প্রসঙ্গত, একটি উদাহরণ দিই। জাপানের মাদার হাউজ একটি পরিচিত ব্র্যান্ড। এর উদ্যোক্তা একটি জাপানি মেয়ে পড়াশোনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে ব্র্যাকে সমাজসেবামূলক কাজ করতে এসেছিল। সেখান থেকে সম্ভাবনা দেখে নিজের মেধা আর শ্রম কাজে লাগিয়ে আজ বিশ্ববিখ্যাত চামড়া শিল্পের ব্র্যান্ড গড়ে তুলল। একটি ভিনদেশি কম বয়সী মেয়ে যদি আমাদের সম্পদ ব্যবহার করে বিশ্বমানের ব্র্যান্ড বানাতে পারে, আমরা কী করলাম, আমাদের বড় বড় কোম্পানি কী করছে?
করণীয় কী?
১. একটি কোম্পানি কখনো অনেক সেক্টরে বিশ্ববিখ্যাত হতে পারে না। পাশাপাশি ক্রেতাও ঠিক বুঝতে পারে না কোম্পানিটির আসল ব্যবসা কী। স্বাভাবিকভাবেই এমন করে ক্রেতার মনে জায়গা করে নিতে পারে না। মার্কেটিংয়ের ভাষায় যাকে আমরা পজিশনিং বলি। যেমন ধরুন একটি সুস্বাদু পিত্জা কোম্পানি একই নামে টয়লেট পেপার বানানো শুরু করল অথবা কোকা-কোলা কোম্পানি কাল একই নাম দিয়ে জুতা বানাতে লাগল, আপনি কি সেটা কিনবেন? তাই বহুদিকে হাত না বাড়িয়ে অন্তত একটি কিংবা কয়েকটি খাতে ক্রমাগত চেষ্টা করা উচিত। এটা করলে কোম্পানির গবেষণা কার্যক্রম, মনোনিবেশ, শক্তিমত্তা এক্সপার্টাইজ বৃদ্ধি পাবে এবং একটা সময়ের পরে জাতীয়, আঞ্চলিক, রিজিওনাল করতে করতে একদিন বিশ্বমঞ্চে আমাদেরই কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে যাবে।
২. ধরে নিলাম এবিসি একটি খুব বড় দেশীয় প্রতিষ্ঠান। আটা-ময়দা থেকে শুরু করে খাট-পালঙ্ক, ইট-পাথর সব খাতে তাদের বিনিয়োগ। তাতে ১ হাজার থেকে ২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে ঠিকই কিন্তু জাতীয় সামগ্রিক অর্থনীতিতে খুব একটা লাভবান কিন্তু হওয়া যাচ্ছে না। আমি মনে করি, বড় বড় কোম্পানির উচিত এসব খাত থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে মাঝারি কিংবা ছোট কোম্পানিগুলোকে সুযোগ করে দেয়া। তাতে আমাদের আরো অনেক কোম্পানি গড়ে উঠবে, আর বড় বড় কোম্পানি বিশ্বমানের ব্র্যান্ডিংয়ে মনোনিবেশ করবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বড় কোম্পানিগুলোর আর্থিক দাপট অথবা পেশি শক্তির কারণে ছোট কোম্পানিগুলো মাঝারি, মাঝারি কোম্পানিগুলো বড় হতে পারছে না। আর যে কর্মসংস্থানের যুক্তি, সেটা মাঝারি কিংবা ছোট কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করলেই হয়ে যাবে।
৩. একটি ভিশন ও পরিকল্পনা থাকতে হবে। কাস্টমার প্রকৃতপক্ষে কী চায়, কীভাবে সেটা পূরণ করা যায়, মার্কেট সম্ভাবনা কেমন- এসব যাচাই-বাছাই করে একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড দাঁড় করানোর লক্ষ্যে এগিয়ে গেলে একটি সময় পরে ছোটখাটো ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবেই। আর দেশি কোম্পানির জন্য কাজটা কিছুটা হলেও সহজ বলে আমি মনে করি। প্রথমত, আমাদের মজুরি খরচ অনেক কম। দ্বিতীয়ত, দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী আজ প্রবাসে। একটু গুণগত মান ঠিক রেখে ভালো সার্ভিস দিতে পারলে প্রবাসী বাঙালিরা নিজ নিজ দেশে দেশীয় কোম্পানির পণ্য কিনবে, এমনকি সঙ্গে করে বিদেশিদের কাছে পরিচয় করিয়ে গর্ব বোধ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
৪. নিজের সামর্থ্যের ওপর যদি আস্থা না থাকে তাহলে কপি করেও কিন্তু বিশ্বমঞ্চে ব্র্যান্ডিং করা যায়। সেক্ষেত্রে জাপান ও চীনের কিছু বিশ্বখ্যাত কোম্পানির দিকে তাকালে কিন্তু সহজেই আমরা সেটা দেখতে পাই। কথিত আছে চীনের আলিবাবা আমেরিকার অ্যামাজন থেকে প্রাথমিক ধারণা নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। হালের তড়ড়স থেকে ধারণা নিয়ে রিলায়েন্স ভারতে তাদের নিজস্ব কনফারেন্স অ্যাপ ঔরড়গববঃ তৈরি করে ফেলে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নামিদামি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে পার্টনারশিপে শুরু করে তাদের কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করা যেতে পারে। অন্য কোম্পানির সঙ্গে লাইসেন্সিং করে কীভাবে জগত্খ্যাত হওয়া যায়, জাপানের সনি কোম্পানির কাছ থেকে সেটা আমরা শিখতে পারি।
৫. যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে এবং অবশ্যই একটি কোম্পানির নিয়মিত নিজস্ব গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত করতে হবে। কেউ কোনো দিন ভেবেছিলেন নকিয়ার মতো কোম্পানির আজ এই অবস্থা হবে? কিংবা ইয়াহু সবার আগে এবং সবচেয়ে বেশি মার্কেট শেয়ার থাকার পরও আজ মৃতপ্রায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি কোম্পানির টিকে থাকাই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। তাই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ১০-১৫ বছর চলতে পারলেই একটা মোটামুটি মানের ব্র্যান্ড দাঁডিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। পাশাপাশি সততা, আস্থা অর্জন করতে হবে। আমাদের দেশের অনেক কোম্পানির নামেই অসৎ কার্যক্রম কিংবা ঋণ পরিশোধের মতো ঘটনা শোনা যায়। এসব করে হয়তো দেশের মাটিতে টিকে থাকা যায় কিন্তু কাঁটাতার ডিঙানো যায় না।
আজকের এই বাংলাদেশ গড়ার পেছনে প্রাইভেট সেক্টরের বড় বড় কোম্পানির অবদানের শেষ নেই। কিন্তু সুযোগ যেহেতু বিশ্বায়নের কিংবা বিশ্বমঞ্চের, সেখানে আমরা কেন জাতীয় পর্যায়ে পড়ে থাকব। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে বলতে চাই পতপত উড়ুক না আমার দেশের পতাকা আর পণ্য ‘Bangladeshi Brand’ ইমেজ নিয়ে সারা বিশ্বে।

লেখক: সিনিয়র লেকচারার, স্কুল অফ বিজনেস
ইউনিভার্সিটি অফ ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি চট্টগ্রাম (ইউসিটিসি)