ব্র্যাক : যেভাবে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এনজিও

51

সিলেটের শাল্লায় যুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি জনপদের মানুষজনের জন্য ত্রাণ সহায়তা দিতে কাজ শুরু করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিটি বা ব্র্যাকের। তবে ১৯৭৩ সালে যখন পুরোদস্তুর উন্নয়ন সংস্থা হিসাবে ব্র্যাক কার্যক্রম শুরু করে, তখন তার নামের বিস্তারিত পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি। তবে সংক্ষিপ্ত নাম ব্র্যাকই থাকে।
গত মঙ্গলবার সেই সংগঠনের চেয়ারম্যান পদ থেকে অবসর নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তবে তিনি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ার এমেরিটাস হিসাবে থাকবেন।
যেভাবে শুরু : গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, সেই সময় যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের অনেক কাজ ছিল।
সরকারের পাশাপাশি তখন ব্র্যাকের মতো আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানটি উন্নয়নমূলক কাজে এগিয়ে আসে।
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফজলে হাসান আবেদ স্বাধীনতার আগে বিদেশি একটি সংস্থায় চাকরি করতেন। কিন্তু সত্তরের ভয়াবহ দুর্যোগ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর মানুষজনের যে দুর্ভোগ হয়, সেটি দেখে নিজে থেকে করার তাগিদ বোধ করেন।
সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের সময় আরো কয়েকজনের সঙ্গে মিলে ‘হেলপ’ নামের একটি সংগঠন তৈরি করেন, যারা ভোলার মনপুরা দ্বীপে কাজ করেন। সেখানে তারা ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে রিলিফ দেয়া, ঘরবাড়ি তৈরি করে দেয়ার কাজ করেন। সেখানকার মানুষের দুর্দশা দেখে তার মনে বড় পরিবর্তন আসে।
স্বাধীনতার পর বিদেশি কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্যার ফজলে হাসান আবেদ বাংলাদেশে এসে উন্নয়নমূলক কাজ শুরু করেন বলে জানিয়েছেন আফসান চৌধুরী।
তিনি বলেন, তখন ভারত থেকে অনেক পরিবার ফেরত আসছিল। একদিন ফজলে হাসান আবেদ দেখছিলেন, এই যে মানুষ দেশে আসছে, কিন্তু যুদ্ধে তাদের সমস্ত কিছু হারিয়ে গেছে। তিনি তখন তাদের উন্নয়নে কাজ শুরু করলেন। সেই যে শুরু করলেন, আর পিছু ফেরা হলো না।
সেখানেই প্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন এসিস্ট্যান্ট কমিটি বা ব্র্যাকের। যুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষজনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন করতে তারা কাজ শুরু করেন। বাড়ি বিক্রির ১৬,০০০ পাউন্ড আর কয়েকজন বন্ধুর দেয়া টাকা দিয়ে তাদের কর্মকান্ড শুরু হয়।
সিলেটের শাল্লার স্থানীয় তরুণদের সম্পৃক্ত করে প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের তালিকা করা হয়। এরপর তাদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করা হয়।
প্রথম কমিটির সদস্যরা : সে সময় ব্র্যাকের সাত সদস্যের গভর্নিং বোর্ডের সদস্যরা ছিলেন কবি বেগম সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, কাজী ফজলুর রহমান, আকবর কবির, ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, এর আর হোসেন এবং ফজলে হাসান আবেদ।
কবি সুফিয়া কামাল হলেন ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারম্যান। নির্বাহী পরিচালক হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ফজলে হাসান আবেদ। ১৯৮০ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ব্র্যাকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ হুমায়ুন কবির। ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ফজলে হাসান আবেদ।
উন্নতির শুরু : বাড়ি বিক্রি আর জমানো অর্থ দিয়ে কাজ শুরু করলেও, এরপরে বিদেশি দাতা সংস্থা অক্সফাম-জিবির সহায়তা পায় ব্র্যাক। একটি সাক্ষাৎকারে ফজলে হাসান আবেদ বলেছেন, ১৯৭২ সালের দিকে অক্সফাম-জিবি প্রায় দুই লক্ষ পাউন্ড দিয়েছিল। সেই অর্থ দিয়ে ব্র্যাক অনেকগুলো প্রকল্প নেয়। পরবর্তীতে আরো কিছু বিদেশি সংস্থার সহায়তা পাওয়া যায়। ১৯৭৪ সালের দিকে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করে ব্র্যাক।
গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, ক্ষুদ্রঋণের বড় সুবিধা হলো, এই নিম্নবিত্ত মানুষগুলো তখন পুঁজি পেলো কিছু করার জন্য। ব্র্যাক প্রথম দিকে দুইটি কার্যক্রম গুরুত্বের সঙ্গে শুরু করলো। একটি হচ্ছে বয়স্কদের শিক্ষার পাশাপাশি গ্রামে শিশু-তরুণদের শিক্ষা দেয়ার কার্যক্রম শুরু করলো। দ্বিতীয়ত, নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করলো।
আফসান চৌধুরী বলছেন, গ্রামের সঙ্গে পার্টনারশিপ তৈরি করলো, গ্রামের মানুষের ভূমিকা প্রথমে ছিল। সে সময় আন্তর্জাতিকভাবে যে ত্রাণ এসেছে, সেটা ভালোভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, এনজিওদের হাতে সেটা হয়েছে। সে সময় বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় অংশটি আসতো বিদেশি ঋণ বা অনুদান থেকে। আশির দশকের দিক থেকে ব্র্যাক চিন্তা করতে শুরু করলো, আমরা বিদেশি টাকার ওপর নির্ভর করে সারাজীবন চলতে পারবো না। তখন তারা নির্ভরশীলতা তৈরি করতে শুরু করলো।
একসময় ক্ষুদ্রঋণ ও নানা উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে ব্র্যাক কাজ করলেও আস্তে আস্তে তাদের নানা সহযোগী প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। ১৯৭৮ সালে জন্ম হয় ব্র্যাকের অন্যতম ব্যবসা সফল সহযোগী প্রতিষ্ঠান আড়ং, যেখানে তৃণমূল নারীদের হাতে তৈরি নানা পণ্য বিক্রি হয়। পর্যায়ক্রমে কোল্ড স্টোরেজ, পাস্তুরিকৃত দুধ ও দুগ্ধজাতীয় পণ্যের ব্যবসা, উচ্চশিক্ষা, বিনিয়োগ, ও ব্যাংক।
আফসান চৌধুরী বলেন, ব্র্যাক ঋণ দিচ্ছে, মানুষ উৎপাদন করছে, কিন্তু সেটার বাজারজাত করতে পারছে না। মেয়েরা কাপড় তৈরি করছে, কিন্তু বিক্রি করতে পারছে না। তখন ব্র্যাক বিকল্প চিন্তা করতে শুরু করলো। যেমন কৃষকের কাছ থেকে আলু কিনে নিচ্ছে, কিন্তু রাখবে কোথায়? তখন তারা কোল্ড স্টোরেজ করলো। ঋণ নিয়ে মানুষ গরু কিনে দুধ বিক্রি করতে পারছে না। ব্র্যাক দুধ কিনে নিচ্ছে, সেটার জন্য চিলিং সেন্টার করতে হচ্ছে। নারীদের তৈরি পণ্য বিক্রি করার জন্য তারা আউটলেট তৈরি করলো। মানুষকে শুধু সক্ষম করলেই চলবে না, তাকে আত্মনির্ভরশীল করতে হলে নিয়মিত রুজির ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক করতে হবে। অন্যদের চেয়ে ব্র্যাক সেটা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে আর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা করেছে। সে কারণেই তারা দ্রæত এগিয়ে যেতে পেরেছে।
ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের ১২টি দেশে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম রয়েছে। বিশ্বের অন্যতম বড় বেসরকারি সংস্থা বলে মনে করা হয় সংস্থাটিকে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি ১১ কোটি ৩০লাখ মানুষকে সেবা দিচ্ছে। কর্মী সংখ্যা রয়েছে ৯০ হাজার ৬৯৩জন।
দেশের বাইরে কাজ করার জন্য তৈরি হয়েছে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের। ২০০২ সালে আফগানিস্তানে কাজ করার মাধ্যমে দেশের বাইরে কর্মকান্ড শুরু হয়।
বাংলাদেশ ছাড়াও কাজ করছে মিয়ানমার, নেপাল, রোয়ান্ডা, হাইতি, উগান্ডা, তানজানিয়া, লাইবেরিয়া, সাউথ সুদান, সিয়েরা লিওন, আফগানিস্তান ও ফিলিপিন্সে।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ একটি চিঠিতে লিখেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে ব্র্যাক, সেটাই তার প্রত্যাশা। প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪৭ বছরের কীভাবে এই পর্যায়ে এলো ব্র্যাক?
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডির) জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান হিসাবে ব্র্যাক ও সেসময়ের আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের পেছনে বড় কারণ হলো, যুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে সে সময় যে ঐতিহাসিক চাহিদা তৈরি হয়েছি, সেটা তারা সার্থকভাবে পূরণ করেছে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতাত্তোর পরিস্থিতিতে দুঃস্থ মানুষকে সেবা দেয়ার মতো অবস্থা রাষ্ট্রের ছিল না। সেটা তারা পূরণ করেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, শ্রমবাজারে নারদেীর অংশগ্রহণের হার খুব কম ছিল। ব্র্যাক সেখানে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। সর্বোপরি ফজলে হাসান আবেদের চিন্তা, দর্শন ও অনুপ্রেরণা ব্র্যাকের লক্ষ ও উদ্দেশ্যে পূরণে ভূমিকা রেখেছে।
আফসান চৌধুরী বলেন, আশির দশকে ডায়রিয়া মোকাবিলায় মানুষের বাড়ি বাড়ি দিয়ে লবণ আর গুড় দিয়ে স্যালাইন বানানোর একটি প্রকল্প নেয়। সেটা করতে গিয়ে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে আবার গ্রামের মানুষের অনেক কাছাকাছি চলে যায়।