ব্যাপক ক্ষতির মুখে ১৯ অফডক

167

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ১৯টি আইসিডি বা অফডকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৬১ ভাগ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কমে গেছে। রপ্তানি পণ্যের ভলিউম নেমে এসেছে পাঁচ ভাগের এক ভাগে। এতে গত এক মাসে ৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই পরিস্থিতি চলমান থাকলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে রপ্তানি শিল্পের জন্য অপরিহার্য বন্দর, সেবা প্রদানকারী শিল্প তথা বেসরকারি ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোসমূহকে রক্ষায় বিভিন্ন খাতে প্রায় ৬শ কোটি টাকার অর্থ প্রণোদনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে ডিপো মালিক সমিতি।
এসব প্রণোদনার মধ্যে রয়েছে মার্চ থেকে আগস্ট- এই ছয় মাসের জন্য আইসিডি বা অফডকসমূহের শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতনভাতা প্রদানের জন্য ২৫০ কোটি টাকা নগদ অর্থ প্রদান। ইক্যুইপমেন্ট রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হিসেবে ১৫০ কোটি টাকা নগদ অর্থ প্রদান। ইক্যুইপমেন্ট ও প্রাইম মুভারের জ্বালানি ব্যয় হিসেবে ১৫০ কোটি টাকা নগদ অর্থ প্রদান। বেসরকারি আইসিডিসমূহের বিপরীতে ঋণের সুদহার ৬ শতাংশ নামিয়ে আনা এবং আগামী এক বছরের জন্য সুদ মওকুফ করা। আগামী এক বছর এসব আইসিডিসমূহে এসব ঋণের কিস্তি পরিশোধে চাপ সৃষ্টি না করা। আইসিডিসমূহের কার্যকরী মূলধন এর উপর সুদহার আগামী এক বছরের জন্য ২ শতাংশ হারে ধার্য করা এবং পরবর্তীতে ৬ শতাংশে ধার্য করা। এছাড়া ইক্যুইপমেন্ট ও প্রাইম মুভারের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ব জ্বালানি বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানসমূহ হতে হ্রাসকৃত মূল্যে জ্বালানি (ডিজেল) সরবরাহ করা।
বিকডা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১৯টি আইসিডি বা অফডকসমূহ বর্তমানে দেশের রপ্তানি পণ্যের প্রায় শতভাগ এবং আমদানি পণ্যের প্রায় ২৫ শতাংশ হ্যান্ডল করছে। দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানিমুখি তৈরি পোশাক বেসরকারি এসব আইসিডি বা অফডকসমূহের মাধ্যমে রিসিভিং, ওয়্যারহাউজিং, কনসলিডেশন, স্টাফিং এবং শুল্কায়ন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে কন্টেইনারজাত হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজীকরণের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। এসব আইসিডি বা অফডকসমূহে প্রায় ৮,৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে, যেখানে প্রায় ৩৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে।
কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে এসব অফডকে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ৬১ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। সেই সাথে রপ্তানি পণ্যের ভলিউম পাঁচ ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। ১৯টি ডিপোতে স্বাভাবিক সময় তথা মার্চ মাসে রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার টিইইউএস। আমদানি পণ্যবাহী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩০ হাজার। এসব ডিপোতে মোট ৮৫ হাজার টিইইউএস আমদানি ও রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। কিন্তু এপ্রিল মাসে লেগেছে করোনার ধাক্কা। এই মাসে মাত্র ১০ হাজার টিইইউএস রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৪৫ হাজার টিইইউএস কম। এছাড়া এপ্রিল মাসে আমদানি পণ্যবাহী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ২৩ হাজার টিইইউএস। যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৭ হাজার টিইিইউএস কম। তবে তা আরও কম হতো, যদি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সব ধরনের আমদানি পণ্য অফডকে নিয়ে আসা না হতো। অর্থ্যাৎ ১৯টি ডিপোতে স্বাভাবিক সময়ে যেখানে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যেবাহী কন্টেইনার ৮৫ হাজার টিইইউএস হ্যান্ডলিং হতো সেখানে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং নেমে এসেছে ৩৩ হাজারে। যা মোট কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এর ৬১ ভাগ হ্রাস পেয়েছে।
১৯ টি অফডকের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হলো সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট (এসএপিএল)। এই প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ রপ্তানী পণ্যবাহী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কমেছে বলে জানান জিএম (অপারেশন) মো. মাহিন। তিনি বলেন, এসএপিএল থেকে এককভাবে ৮ হাজার টিইইউএস মত এক্সপোর্ট করতাম। আর এসএপিএল ও ওসিএল এই দুইটি প্রতিষ্ঠান মিলে ১১ হাজার থেকে সাড়ে ১১ হাজার টিইইউএস এক্সপোর্ট করতাম। কিন্ত গত এপ্রিল মাসে আমাদের দুইটি ডিপোতে মাত্র আড়াই হাজার হ্যান্ডলিং হয়েছে।
একইভাবে পুরো বিজনেসের ৮০ শতাংশ কমেছে বলে জানান কেডিএস ডিপোর জিএম (অপারেশন) মেজর (অব.) এনামুল করিম। তিনি বলেন, অন্যান্য সময়ে যে পরিমাণ হতো তা থেকে ৮০ শতাংশ হ্যান্ডলিং কমে গেছে। ক্ষতি যে পরিমাণ হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতনভাতা দেওয়া মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। এখন বেতন কীভাবে দিবো, ভবিষ্যতে কীভাবে চলবে তা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি।
এছাড়া বিএম কন্টেইনার ডিপোর ম্যানেজার (এডমিন) খালেদুর রহমান জানান, মাসে ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টিইইউএস রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হতো। কিন্তু এপ্রিলে মাত্র ১২শ টিইইউএস হ্যান্ডলিং হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোটস অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)’র সচিব রুহুল আমীন বলেন, করোনার কারণে আমাদের ক্ষতি হলো রপ্তানি পণ্যের ৫ ভাগের ১ ভাগ নেমে এসেছে। আমদানি পণ্যও অর্ধেকে নেমে গেছে। যদিও ২৪ তারিখ থেকে সবধরনের আমদানি পণ্যে বন্দর থেকে অফডকে আনার অনুমতি দেওয়ায় কিছুটা রক্ষা হয়েছে। আর আমাদের ১৯টি ডিপোতে মার্চ মাসে ৮৫ হাজার টিইইউএস আমদানি ও রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। তবে এপ্রিল তা ৩৩ হাজার টিইইউএস এ নেমে এসেছে। অর্থ্যাৎ স্বাভাবিক সময়ে আমরা যেখানে ৮৫ হাজার টিইইউএস আমদানি ও রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতাম সেটা ৩৩ হাজার টিইইউএস এ নেমে এসেছে। সেই হিসেবে ৬১ ভাগ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হ্রাস পেয়েছে।
করোনা পরিস্থিতিতে অফডকের মাত্রাতিরিক্ত চার্জ মওকুফ চান শিল্প মালিকরা। এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের মাসে ১২০ কোটি টাকা রেভিনিউ হয়। তা ৬১টি ভাগ কমে গেছে। একমাসে ৭৩ কোটি টাকা নাই হয়ে গেছে। আমরা ডিপো চালাতে পারছি না। ডিপো চালানোর জন্য বিশাল অঙ্কের পরিচালন ব্যয় দরকার হয়। ৬০ শতাংশ রেভিনিউ কমে গেছে, তা পুরোটাই তো লাভ না। আমরা লাভ করি ৫ থেকে ১০ শতাংশ। তাহলে আমরা কোথায় থেকে মওকুফ দিবো। এই পরিস্থিতিতে আমরা নিজেরাই বাঁচতে পারছি না।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোটস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) চেয়ারম্যান নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে দেশের রপ্তানি শিল্পকে বাঁচাতে হবে। দেশের রপ্তানি শিল্পকে বাঁচাতে হলে বেসরকারি বন্দর, সেবা প্রদানকারী আইসিডিসমূহকে বাঁচাতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতি ও জাতীয় অর্থনীতির এই ক্রান্তিলগ্নে বেসরকারি আইসিডিসমূহকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন খাতে প্রায় ৬শ কোটি টাকা প্রণোদনা অতীব জরুরি। দেশের এই চরম সংকটের সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক আমরা জরুরি সেবা হিসেবে অপারেশন কার্যক্রম ২৪ ঘণ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।