ব্যাটারিশিল্পে রহিমআফরোজ

67

পূর্বদেশ ডেস্ক

সাত বছর বয়সে মা-বাবাকে হারান আবদুর রহিম। কলকাতায় মামার ছোট ব্যবসা ছিল। মামার অফিসেই পিয়নের কাজ নিয়েছিলেন। ১৭ বছর বয়সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে দরজির কাজ শুরু করেন। ছোট একটি কাপড়ের দোকান দিয়েছিলেন। সেই দোকান বিক্রি করে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। এর মধ্যে দেশ ভাগ হলে কলকাতা থেকে তিনি চলে আসেন চট্টগ্রামে।
চট্টগ্রামে এসে আবদুর রহিম পিডব্লিউডিতে পাইপলাইন মেরামতের কাজ করতেন। কাজের সূত্রেই পরিচয় হয় লুকাস ব্যাটারি প্রস্তুতকারক ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তারা তখন বাংলাদেশে পরিবেশক খুঁজছিলেন। কাজটি নিলেন তিনি। আর এ জন্য ১৯৫৮ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি ‘রহিমআফরোজ’ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। চট্টগ্রাম ছেড়ে ১৯৫৯ সালে পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে যান আবদুর রহিম। এ সময় ব্যবসারও প্রসার ঘটতে থাকে। তখন ব্রিটিশ কোম্পানি লুকাসের ব্যাটারির ছিল একচেটিয়া ব্যবসা। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত রহিমআফরোজ কোম্পানি ছিল লুকাস ব্যাটারির একমাত্র পরিবেশক। বিপণন করেছেন অস্ট্রেলিয়ার ডানলপ টায়ারও। ১৯৮০ সালে ব্রিটিশ কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে আবদুর রহিম কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করেন। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ব্যবসা পরিবর্তন না করে নিজেই নতুন করে ব্যাটারি প্রস্তুত শুরু করেন। ১৯৮২ সালে ৬৭ বছর বয়সে মারা যান আবদুর রহিম। এরপর তার তিন সন্তান আফরোজ রহিম, ফিরোজ রহিম ও নিয়াজ রহিম ব্যবসার হাল ধরেন।
আবদুর রহিম কোম্পানি করেছিলেন বড় ছেলে আফরোজ রহিমের নামে। রহিম সবার নামের সঙ্গেই যুক্ত আছে। কোম্পানি গঠনের সময়ে তার একটিই ছেলে ছিল। নিবন্ধনের সময়ে আফরোজের বানানে একটি অতিরিক্ত ‘ও’ বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে কারণে ইংরেজিতে কোম্পানির নাম এখনো ‘জঅঐওগঅঋজঙঙত’।
নিয়াজ রহিমের জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। সেন্ট প্লাসিড স্কুল, বিএএফ শাহীন স্কুল ও নটরডেম কলেজের ছাত্র নিয়াজ রহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮০ সালে আইন শাস্ত্রে স্নাতক সম্মান ও ১৯৮২ সালে কানাডার কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং ম্যানেজমেন্টে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। তিনি বলেন, ‘১৯৮২ সালে বাংলাদেশে তখন গার্মেন্ট ব্যবসা মাত্র এসেছে। আমি ও আমার তিন বন্ধু মিলে তখন ভিভা বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি বায়িং হাউস খুলি। ১৯৮৩ সালে আমার ভাইয়েরা আমাকে বললেন, হয় তুমি আলাদা হও, নয় আমাদের সঙ্গে থাকো। আমাদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত, আলাদা ব্যবসা আমরা করব না। পরিবারের সদস্যদের এখানে একটি ব্যবসা থাকবে আবার একেকজনের ব্যক্তিগত আরেকটি ব্যবসা থাকবে, এ রকম আমরা করব না। আমরা যা করব একসঙ্গে। ১৯৮৫ সালে সিদ্ধান্ত নিলাম যে বায়িং হাউস থেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে যাব। ফলে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা আর বায়িং হাউসে থাকব না। আমরা বেরিয়ে আসব। আমি রহিমআফরোজে ঢুকলাম ১৯৮৪ সালে। শুরুতেই দায়িত্ব নিই ব্যাটারি সেলসের। সারা দেশে ডিলার নিয়োগের প্রক্রিয়া আরম্ভ করি। দুই বছরেই একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করার মতো অবস্থানে আসি। ডিলার নেটওয়ার্ক করার পর থেকেই রহিমআফরোজের ব্যবসার প্রবৃদ্ধি আস্তে আস্তে ভালো হয়েছে।
নিয়াজ রহিম আরও বলেন, আমরা শুরু করেছিলাম প্রায় শূন্য থেকে। ওই সময়ে এই ব্যবসা যারা করতেন, রাস্তা থেকে তারা পুরোনো ব্যাটারি কিনতেন। আমরা তাদের নতুন ব্যাটারিতে নিয়ে আসি। সবাইকে নিয়মকানুন শেখাই। পুরোনো ব্যাটারির দাম প্রায় অর্ধেক। পুরোনো ব্যাটারির অভ্যস্ততা ছেড়ে ক্রেতারা নতুন ব্যাটারি কিনবেন কি না, এই আশঙ্কাও ছিল। গাড়িতে ব্যাটারির প্রয়োজন হয় মূলত স্টার্ট দেওয়ার সময়। একটি দুর্বল ব্যাটারি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলে ইঞ্জিনের ওপর বেশি চাপ পড়ে। আমরা ডিলারদের বলতাম, তোমরা ওদের বোঝাও, যদি নতুন ব্যাটারির জন্য আড়াই বা তিন হাজার টাকা দেয়, তাহলে লাখ টাকার গাড়ি বেঁচে যাবে। স্টার্ট দেওয়া মাত্রই গাড়ি স্টার্ট নেবে। এভাবেই আমাদের বিক্রি বাড়ল। আবার সে সময়ে এক প্রকল্পের আওতায় গ্রামে গ্রামে টেলিভিশন বিতরণ করা হয়েছিল। বিদ্যুৎ না থাকায় টেলিভিশন চালাতে হতো ব্যাটারিতে। ফলে গ্রামেও ব্যাটারির চাহিদা বাড়ল। আমরা ব্যাটারি নিয়ে গ্রামে গেলাম, তাদের ঢাকায় আসতে হতো না।
শুধু গাড়ির ব্যাটারি উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি রহিমআফরোজ গ্রুপ। এরপর শুরু হয় শিল্পে ব্যবহৃত ব্যাটারি উৎপাদনের কাজ। তারা সোলার এনার্জির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাটারি উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়। এই ব্যাটারি ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার জন্য শুধু নয়, বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্যও। তখন শিল্পে ব্যবহারের সব ধরনের ব্যাটারি আমদানি করতে হতো। ৯০ দশকেই রহিমআফরোজ শিল্প খাতের ব্যাটারি উৎপাদন শুরু করে।
সব মিলিয়ে দেশে ব্যাটারিশিল্পের বিপ্লব ঘটেছে রহিমআফরোজ গ্রæপের হাত ধরেই। ১৯৯২ সালে সিঙ্গাপুরে ব্যাটারি রপ্তানি করে নতুন মাইলফলক অর্জন করে তারা। ১৯৯৩ সালে প্রথম আইপিএস চালু করে কোম্পানিটি। সুপারস্টোরের সঙ্গেও দেশবাসীকে পরিচয় করিয়ে দেয় রহিমআফরোজ গ্রুপ।
২০০১ সালে চালু হয় ‘আগোরা’ নামের সুপারস্টোর। নীতিনৈতিকতার দিক থেকেও বিশেষ সুনামের অধিকারী ছিল এই গ্রুপ। ব্যবসায়ের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও রহিমআফরোজ পিছিয়ে নেই। নিয়াজ রহিম বলেন, মূল্যবোধই তাদের ব্যবসায়ের মূলধন। বর্তমানে রহিমআফরোজ গ্রুপের অধীনে চালু আছে ১৫টির বেশি কোম্পানি।
২০১২ সালে বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে রহিমআফরোজে যুক্ত হয়েছেন নিয়াজ রহিমের জ্যেষ্ঠ সন্তান ফারাজ এ রহিম। অন্য ছেলেরাও যুক্ত হয়েছেন। তবে এখন খুব একটা ভালো নেই রহিমআফরোজ গ্রæপ। বিদ্যুৎ প্রকল্পে লোকসান ও করোনার সময়ের ব্যবসা ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। ৭০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্দিনে রহিমআফরোজ গ্রুপ। বিপুল অঙ্কের ব্যাংক ঋত নিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছে। নিয়াজ রহিম নিজেও ২০১৩ সাল থেকে বেশ অসুস্থ। দীর্ঘদিন বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ সময়েও ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে। রহিমআফরোজ ঘুরে দাঁড়াবে-এই প্রত্যাশা এখন সবার।