ব্যবসায়ীকে মেয়রের সড়ক ‘উপহার’!

75

বাঁশখালী পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের আস্করিয়া পাড়া ও ৮নং ওয়ার্ডের আদর্শগ্রামের উন্নয়নে নেয়া হয় যৌথ প্রকল্প। তিন লক্ষ ৮৮ হাজার ৫৪২ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পে আস্করিয়া পাড়ায় মোস্তফা আলী কোং সড়ক আরসিসি ও আদর্শগ্রামে মসজিদের ঘাটলা নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে সড়কের কাজ শেষ হলেও ঘাটলা নির্মাণ এখনো হয়নি। এ প্রকল্পে মসজিদের ঘাটলার গুরুত্ব থাকলেও মোস্তফা আলী কোং বাড়ির প্রায় শত মিটার দৈর্ঘ্য ও ছয় ফুট প্রস্থের সড়কটির আরসিসিকরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এলাকাবাসী। এটি মেয়রের ‘উপহার’ বলেও মন্তব্য করেন কেউ কেউ।
এলাকাবাসী জানান, মৎস্য ব্যবসায়ী মোস্তফা আলী এক সময় বিএনপি করলেও এখন নিজেকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয় দেন। এক সময় বোটের মাঝি থাকলেও এখন কয়েকটি বোটের মালিক। ধর্নাঢ্য ব্যক্তি হওয়ায় এ ব্যবসায়ীর সাথে পৌর মেয়র শেখ সেলিমুল হক চৌধুরীর দারুন সখ্যতা। যে কারণে যাতায়াত সুবিধায় মোস্তফা আলীর বাড়ির সড়কটি সরকারি টাকায় আরসিসি করে দেন মেয়র। আশপাশের পুরো এলাকা উন্নয়নের আওতায় না আসলেও শুধুমাত্র মোস্তফা আলীর বাড়ির সড়কটি পাকা করায় এলাকাবাসীকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। কখনো জরুরি প্রয়োজনে মোস্তফা আলীর বাড়ির সড়ক ও পুকুর পাড় বেয়ে চলাচল করতে চাইলে বাধা দেয়া হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, বাঁশখালী থানার পাশ ঘেঁষে পশ্চিমে যাওয়া সড়কটির বেহাল দশা। এ সড়ক বেয়ে এক কিলোমিটার গেলেই আস্করিয়া নোয়া পাড়া। এ পাড়ায় ১৫০টির মতো বাড়ি আছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় সড়ক হয়েই এ পাড়ার বাসিন্দারা যাতায়াত করেন। আস্করিয়া পাড়া প্রধান সড়কসহ অলিগলির সড়কগুলো বিশালাকার গর্তে ভরপুর থাকলেও উন্নয়নের ছোঁয়া দেখা যায় মোস্তফা আলীর বাড়ির সামনে। সীমানা প্রাচীরে ঘেরা আলিশান বাড়ির সামনের সড়কটি আরসিসি ঢালাই পাকাকরণ করা হয়েছে। মোস্তফা আলীর কোং সড়কটি এলাকাবাসীর কোন কাজে আসে নাই। মোস্তফা আলীর বাড়ির সড়কটি বেয়ে যাওয়া যায় পুকুরে। পুকুরের পাশেই মোস্তফা আলীর নিকটাত্মীয়দের বসবাস। পুকুরের ছোট পাড় ঘেষে গেলেই আরো দুটি বাড়ি। যার একটি মোস্তফার বোনের আরেকটি অন্যজনের।
মোস্তফা আলীর চাচাতো ভাই আব্দুল গফুরসহ আরো কয়েকজন বলেন, ‘মোস্তফা আলীর ঘর পর্যন্ত সড়কটি পৌরসভা থেকে পাকা করা হয়েছে। যদিও সড়কটি আমরাই মাটি দিয়ে ভরাট করেছি। এ সড়কটি নোয়া পাড়ার কেউ ব্যবহার করেন না।
আস্করিয়া পাড়ার বাসিন্দা আবুল বশর পূর্বদেশকে বলেন, নোয়া পাড়ার ১২০টি পরিবার আছে। তাদের চলাচলের রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। অথচ মোস্তফা আলীকে সুবিধা দিতে পাকা রাস্তা করা হয়েছে। মহিলা কমিশনারের বাড়ির রাস্তাও করা হয়েছে। অনেক বছর ধরে আস্করিয়া পাড়া সড়কের কাজ হচ্ছে না। শুধু নিজেদের বাড়ির সড়কের কাজ করছে।
ঠিকাদারি কাজে যুক্ত থাকা আশরাফ আলী বলেন, ‘শাহাজাদা আকতারের মালিকানাধীন আকতার এন্ড কোং লাইসেন্স ব্যবহার করে আমি কাজটি করেছি। কাজের শিডিউলে যা আছে তাই কাজ করা হয়েছে। বরাদ্দ যা দেয়া হয়েছে তার লেস অংশ বাদ দিয়ে বাকি টাকার কাজ করা হয়েছে। কমিশনাররা যে সড়ক টেন্ডারে তুলেছে আমরা দরপত্র জমা দিয়ে তা পেয়েছি। কার ঘর আছে, কার ঘর নাই তা দেখার বিষয় আমার না। আমি টেন্ডার দাখিল করে কাজ পেয়েছি।’
স্থানীয় মহিলা কাউন্সিলর নার্গিস আক্তার পূর্বদেশকে বলেন, তিন ওয়ার্ড মিলে বরাদ্দ পেয়েছি তিন লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। নতুন পাড়ায় আরসিসি ও আদর্শগ্রামের ঘাটলা নির্মাণে এ টাকা বরাদ্দ দিয়েছি। মোস্তফা আলীর বাড়ির সড়কটি সবাই ব্যবহার করে। এজন্য সড়কটিতে বরাদ্দ দিয়েছি।
বাড়ির মালিক মোস্তফা আলী বলেন, আমি রাস্তা করি নাই। পৌরসভা থেকে এটি করা হয়েছে। মেয়র নির্বাচনে উনার পক্ষে থাকায় উনি এ সড়কটি করে দিয়েছেন। সবাই রাস্তাটি ব্যবহার করে। এটি নোয়া পাড়ার রাস্তা। নোয়া পাড়ার রাস্তাতো অন্যটি এমন প্রশ্নে তিনি নানা যুক্তি দিয়ে বলেন, এ সড়কটি ধরে অনেকেই চলাচল করেন। পরে নিজে ছোটকাল থেকে আওয়ামী লীগ করছেন বলেও দাবি করেন।
বাঁশখালী পৌরসভার মেয়র শেখ সেলিমুল হক চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘কাউন্সিলররা প্রকল্প দিয়েছে। সেখানে ২০/৪০টি বাড়ি আছে। তাদের যাতায়াতের সুবিধার্থে সড়কটি করে দিয়েছি। মোস্তফা কোন টাকা দেয়নি। মোস্তফা আলী পার্টির জন্য অনেক টাকা খরচ করেন। আওয়ামী লীগের সকল সভা-সমাবেশে আস্করিয়া পাড়ায় মোস্তফা আলী খরচ করেন। আমি উন্নয়নের মধ্যেই আছি। আমাকে ৬/৭মাস সময় দাও সব রাস্তাঘাট ঠিক হয়ে যাবে। সরকার ফান্ড না দিলে আমার করার কিছু নাই। গত দেড় বছরে ৭৫ লক্ষ টাকা পেয়েছি। ১৪ কোটি টাকার বাজেট হয়েছে কিন্তু ফান্ড পাচ্ছি কম।’
তবে পৌরসভা বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘মোস্তফা আলীর রাজনৈতিক আদর্শ কি আস্করিয়া পাড়ার সবাই জানে। এক সময় বিএনপি করলেও তিনি এখন নতুন আওয়ামী লীগ।’
অনিয়মের তদন্ত শুরু আজ : বাঁশখালী পৌরসভার মেয়রের বিরুদ্ধে পরিষদের মাসিক সভায় কাউন্সিলরগনের মতামত গ্রহণ না করা, টেন্ডারে অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ নিয়োগ প্রদান, ঘুষ গ্রহণ ও মহিলা কর্মচারীদের সাথে অনৈতিক ব্যবহারসহ ১২টি অভিযোগের তদন্ত শুরু হচ্ছে আজ। সকাল ১০টায় পৌরসভা কার্যালয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি তদন্ত শুনানি করবেন। শুনানিতে দুই পক্ষকেই উপস্থিত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পৌরসভার প্যানেল মেয়র দেলোয়ার হোসেন, কাউন্সিলর দিলীপ চক্রবর্ত্তী, নজরুল কবির সিকদার ও বাবলা কুমার দাশ দুর্নীতি দমন কমিশন, জেলা প্রশাসক কার্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে এ অভিযোগ প্রদান করেন।
অভিযোগ তদন্তের বিষয়ে পৌরমেয়র শেখ সেলিমুল হক চৌধুরী বলেন, ‘স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক নিয়মিত পরিদর্শনে যাচ্ছেন। শুধু পৌরসভায় নয় ইউএনও অফিস, চাম্বল ও সরল ইউনিয়ন পরিষদেও যাবেন তিনি। আমরা স্থানীয় সরকারের অধীনে হওয়ায় তিনি আসছেন।’