ব্যক্তিস্বার্থে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়

28

 

চলতি জুলাই অতিক্রান্তে শোকের মাস আগস্টে করোনা তৃতীয় তরঙ্গের চূড়ান্ত আঘাতের পূর্বাভাস যারপরনাই বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর হৃদয় গভীরে প্রচন্ড উদ্বেগ-উৎকন্ঠা তৈরি করেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রমতে তিন-চারগুন সংক্রমণ বিস্তারের বার্তায় রচিত হচ্ছে দুর্বিষহ দুরাশার চিত্র। পুরোবিশ্ব ব্যবস্থায় করোনার অবনিতশীল পরিস্থিতি সামষ্টিক আর্থ-সামাজিক ও জীবন-জীবিকার সামগ্রিক সচলতায় কি ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে পারে; তা সহজেই অনুমেয়। পর্যুদস্ত এই ধরিত্রীর করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল সংশ্লিষ্ট জীবনধারার প্রতিটি খাতকে বিধ্বস্ত করার অনুভূত দৃশ্যপটে কল্পনাতীত ভীতির সঞ্চার ইতিমধ্যেই প্রতিফলিত হচ্ছে। সমগ্র জনগোষ্ঠীকে নূন্যতম টিকা প্রয়োগে ব্যর্থ হলে এর ভয়াবহতা চৌহদ্দিবিহীন তান্ডবে ভয়ঙ্কর রূপ পরিগ্রহ করবে- নিঃসন্দেহে তা বলা যায়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে; এত ঘটনা-দুর্ঘটনা-জনদুর্ভোগ-মৃত্যুর মিছিলও দানবরূপী মানব সন্তানদের দৃষ্টিভঙ্গিতে তেমন কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অর্থ-ক্ষমতা-আধিপত্য-ঘুষ-দুর্নীতি-কদাচার-পাপাচার-প্রতারণা-জালিয়াতির নানামুখী দুর্বৃত্তায়নে ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির কূটকৌশল অবলম্বন ও অধিকতর সমাজবিধ্বংসী বেপরোয়া মনোভাব সর্বত্রই দৃশ্যমান।
লোভ-লালসা, স্বজন-বন্ধুপ্রীতি, তদবির-লবিং-ম্যানেজ অপসংস্কৃতির আড়ালে উচ্চ থেকে নি¤œ পর্যন্ত শিক্ষা-বাণিজ্য-ভূমি-হাসপাতাল-ব্যাংক-গণমাধ্যমসহ সমুদয় সামাজিক- রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ধনসম্পদ-প্রতিপত্তিকে অতিশয় সুদৃঢ় করার ব্যক্তি বিশেষের সীমাহীন কুপ্রবৃত্তি সভ্য সমাজ অত্যন্ত ঘৃণার সাথে অবলোকন করছে। সমস্ত কিছু গিলে খাওয়ার এই অসম প্রবণতা ও ঘৃণ্য পন্থার দৃষ্টান্ত নির্মাণ প্রতিহত করারা লক্ষ্যে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অন্যথায় ব্যর্থতার দায়ে আগামী প্রজন্মের কাঠগড়ায় আমাদের অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ক্ষেত্রে সত্য-সুন্দর-কল্যাণ-আনন্দের অনুষঙ্গগুলো যথার্থ পরিচর্যা এবং চলমান পরিস্থিতির উত্তরণে পরিপূর্ণ অনুধাবনের বিষয়টি গুরত্ব সহকারে বিবেচ্য হওয়া অতীব জরুরী। বিরাজিত প্রতিকূল সমস্যাসমূহ যথাযথ উপলব্ধিতে আনা না হলে অতিমারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর অত্যাসন্ন চ্যালেঞ্জসমূহ পুরোবিশ্বকে লন্ড ভন্ড করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাসঙ্গিকতায় মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথপরিক্রমায় জাতিকে পরিচালনা করা সময়ের জোর দাবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সার্বিক উন্নয়ন ও করোনা অতিমারীসহ নানাবিধ দুর্যোগ-দুর্ভোগ ব্যবস্থাপনায় সার্থক এবং সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় আদর্শের মৌলিক স্তম্ভগুলোকে শক্তিমান করার বলিষ্ট উদ্যোগ অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। এর ব্যতিক্রম ফলশ্রæতির অনিবার্য পরিণতি দেশকে অন্ধকারের গহŸরে কোন পর্যায়ে নিমজ্জিত করবে তার প্রায়োগিক বিশ্লেষণ ও প্রাক্কলন নির্ধারণ করার সময় মনে হয় দ্রæত পেরিয়ে যাচ্ছে।
আগস্ট মাসের করুণ অবগাহন বিশ্বব্যাপী বাঙালির হৃদয় গভীরে নিগূঢ় সানাইয়ের সুরের মতো শুধু আর্তনাদের অনুরণন সৃষ্টি করে না, বেদনাহত মানবিক চেতনায় প্রতিশোধ পরায়নতা নির্বাণ করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্নকে সমধিক অত্যুজ্জ্বল করে তুলে। শোকে মুহ্যমান জাতি সভ্যতার নিকৃষ্টতম কলঙ্কের উপমা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর শাহাদৎ বরণের নির্মম অধ্যায়কে অপ্রতিরোধ্য শক্তির দুর্ভেদ্য দেওয়াল নির্মাণে কঠিন ব্রত গ্রহণ করে থাকে। ১০ জানায়ারি ১৯৭২ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে দিল্লিতে ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ যাওয়ার পথে আমি আপনাদের মহতী দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ কারণে যে আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, যিনি কেবল মানুষের নয় মানবতারও নেতা, তাঁর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার নূন্যতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারবো। এই অভিযাত্রা সমাপ্ত করতে আপনারা সবাই নিরলস পরিশ্রম করেছেন এবং বীরোচিত ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায় অভিযাত্রা।’
উল্লেখ্য ভাষণে তিনি আরও বলেন, ‘অবশেষে আমি নয় মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাঙলায় ফিরে যাচ্ছি। এ নয় মাসে আমার দেশের মানুষ শতাব্দীর পথ পাড়ি দিয়েছে। আমাকে যখন আমার মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিলো, তখন তারা কেঁদেছিলো; আমাকে যখন বন্দী করে রাখা হয়েছিলো, তখন তারা যুদ্ধ করেছিলো আর আজ যখন আমি তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি, তখন তারা বিজয়ী। আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের নিযুত বিজয়ী হাসির রৌদ্রকরে। আমাদের বিজয়কে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করার যে বিরাট কাজ এখন আমাদের সামনে, তাতে যোগ দেয়ার জন্য আমি ফিরে যাচ্ছি আমার মানুষের কাছে। আমি ফিরে যাচ্ছি আমার হৃদয়ে কারও জন্য কোনো বিদ্বেষ নিয়ে নয়, বরং এ পরিতৃপ্তি নিয়ে যে অবশেষে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, অপ্রকৃতিস্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃতিস্থতার, ভীরুতার বিরুদ্ধে সাহসীকতার, অবিচারের বিরুদ্ধে সুবিচারের এবং অশুভের বিরুদ্ধে শুভের বিজয় হয়েছে।’ মানব সভ্যতার যুক্তি-জ্ঞান নির্ভর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সুমহান অর্জন হিসেবে শুধু স্বাধীনতাকে বাচনিক মহিমান্বিত নয়; কার্যকর অর্থবহ করার উদ্দেশ্যসমূহ বঙ্গবন্ধুর এই অমূল্য ভাষণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
বিশ্বস্বীকৃত সত্য ভারতীয় নেতাদের পরামর্শে ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে শুধু ভারতকে বিভক্ত করেন নি, বাংলাকেও দ্বিখন্ডিত করে ব্রিটিশ বেনিয়ারা তাদের স্বদেশ ভূমি ইংল্যান্ডে ফিরে যায়। প্রায় হাজার মাইলের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলার সমগ্র নাগরিককে উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে পাকিস্তান সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে নির্যাতন, নিপীড়ন, বৈষম্যের পরাকাষ্ঠায় নিপতিত হতে হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পিছনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতৃবৃন্দের বিশাল অবদানের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করা। কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলার মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছিল তারা নতুন এক আন্তঃ ঔপনিবেশিক বেড়াজালে কুৎসিত চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের অপশাসনে বন্দী হয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর লিখিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে ২০৯ পৃষ্টায় বঙ্গবন্ধুর অন্তরের কথাগুলোর মহত্ত¡ অনুসন্ধান তৎকালীন সময়ের এবং বর্তমানেও কতবেশি প্রাসঙ্গিক তার বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। আজ দুইশত বৎসর পরে আমরা স্বাধীন হয়েছি। সামান্য হলেও কিছুটা আন্দোলনও করেছি স্বাধীনতার জন্য। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস আজ আমাকে ও আমার সহকর্মীদের বছরের পর বছর জেল খাটতে হচ্ছে। আরও কতকাল খাটতে হয়, কেইবা জানে? একেই কি বলে স্বাধীনতা? ভয় আমি পাই না, আর মনও শক্ত হয়েছে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই পাকিস্তানই করতে হবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম।’
বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ববাংলা গণমানুষের কাতরতা ও যন্ত্রণাদগ্ধ বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে কতটুকু এবং কিভাবে নানামুখী প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তাঁর বক্তব্য থেকে তা অতি সহজবোধ্য । তিনি বলেছেন, “গোপালগঞ্জ মহকুমার যে কেউ আসে, তাদের এক প্রশ্ন, ‘আপনাকে কেন জেলে নেয়? আপনিই তো আমাদের পাকিস্তানের কথা শুনিয়েছেন’ আবার বলে, ‘কত কথা বলেছিলেন, পাকিস্তান হলে কত উন্নতি হবে। জনগণ সুখে থাকবে, অত্যাচার জুলুম থাকবে না। চাউলের দাম কত বেড়ে গেছে।’ কি উত্তর দেব! এরা সাধারণ মানুষ। কি করে এদের বোঝাব! গ্রামের অনেক মাতবর শ্রেণীর লোক আছেন, যারা বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। কথা খুব সুন্দরভাবে বলতে পারেন। এক কথায় তো বোঝানোও যায় না। পাকিস্তান খারাপ না, পাকিস্তান তো আমাদেরই দেশ। যাদের হাতে ইংরেজ ক্ষমতা দিয়ে গেছে তারা জনগণের কি করে উন্নতি করা যাবে সেদিকে ক্ষমতাসীনদের খেয়াল নাই।’ এতসব নিপীড়ন-নিবর্তনের কুৎসিত কর্মকৌশল অচিরেই বাঙালি বোধগম্য হয়। নির্মম বৈষম্যের প্রারম্ভেই রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে নিয়ে তাদের কদর্য ষড়যন্ত্র উম্মোচিত হলে পূর্ব বাংলার মানুষ তা রুখে দিতে প্রতিরোধ-আন্দোলন-ত্যাগের নতুন ধারায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-কর্ণফুলির অববাহিকায় সুদীর্ঘ লালিত ও প্রাণস্পন্দনে পরিশীলিত হাজার বছরের ভাষা-কৃষ্টি-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির প্রতি নূন্যতম অবজ্ঞা বাঙালি জাতি মেনে নেয় নি। আবহমান বাংলার শ্বাশত ও সাবলীল মৌলিকত্তে¡ কুঠারাঘাত করার সকল অপচেষ্টা নস্যাৎ করার জন্য দৃঢ়চেতা বাঙালি জাতি সাগর-মহাসাগরের উত্তাল তরঙ্গের মতো গর্জে উঠেছিল। ১৯৫২ সালের মহান আত্মবিসর্জনের স্বাক্ষরে গ্রন্থিত করেছিল মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার বিশ্বে অতুলনীয় গৌরবদীপ্ত ইতিহাস। ধারাবাহিকতায় প্রবাহমান অন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নবতর উম্মেষ রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রধান অনুষঙ্গ স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হয়। মূলত: বঙ্গভঙ্গের আড়ালে সম্পূর্ণ দু’টি ভিন্ন ভাষাভাষী-মতাদর্শের জনগোষ্ঠীকে ব্রিটিশরা তাদের শাসন-শোষণের চিরস্থায়ী করার যে অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল; তা অচিরেই ব্যর্থতার পরিহাসে পর্যবসিত হয়। ‘জয় বাংলা’ ¯েøাগানে উজ্জীবিত বাঙালি জাতি মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য গাঁথায় বিশ্বমানচিত্রে লাল-সবুজের পতাকার বাংলাদেশকে প্রাণ-বিসর্জনের সর্বোচ্চ মাত্রিকতায় অধিষ্ঠিত করে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে নাজেহাল এবং জাতির পুনর্গঠনে নিষ্ঠুর অন্তরায় সৃষ্টির হীন কর্মযজ্ঞ পরিচালিত করে। ৬ ফেব্রæয়ারি ১৯৭২ সাল প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে কলকাতা ব্রিগেড ময়দানে বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের তিনটা আদর্শ ছিল, সে আদর্শ এ সভ্য জগতে চলতে পারে না। কী ছিল তাদের আদর্শ? ভাগ করেছে দুটো দেশ হয়েছে। তাদের একমাত্র স্লোগান ছিল, ‘সব নেতা এ খতমে মে হায়। কাশ্মীর কো ফতে করনে পড়ে গা, হিন্দু হামারা দুশমন হায়।’ আর কোন ¯েøাগান নাই, আর কোন আদর্শ নাই, মানুষ না খেয়ে মরছে তার কথা বলবে না। কতোটা মানুষ পথের ভিখারী হচ্ছে তার কথা বলবে না। দুঃখী মানুষের গায়ে কাপড় নাই তার কথা বলবে না। হিন্দুস্থান আমার দুশমন। হিন্দুস্থান কেন আমার দুশমন হবে? ভারতবর্ষ কেন আমার দুশমন হবে? তারা তো আমার ভাই। তাদের সঙ্গে নিয়ে আমরা ভাই হিসেবে বাস করবো।…….আমরা ঘোষণা করেছি আমার দেশ স্বাধীন। তুমি কোন জায়গার মাতবর হয়ে পড়লা, তুমি বলছো সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়! বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। তোমার ক্ষমতা নাই বাংলার স্বাধীনতা হরণ করার। বিনা অস্ত্রে যদি আমার বাংলার মানুষ আমার অনুপস্থিতিতে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা নিয়ে আসতে পারে, আজ বাংলাদেশকে নিয়ে যদি ষড়যন্ত্র করতে চাও, আর কোন খেলা খেলতে চাও, মনে রেখো-সাত কোটি বাঙালির একটা প্রাণ থাকতে বাংলার মাটিতে ঢুকবার ক্ষমতা তোমাদের নাই।’ বঙ্গবন্ধু জোরালো কন্ঠে কবিতার পংক্তি উপস্থাপনে ঘোষণা দেন, ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস, বিদায় নেবার আগে তাই ডাক দিয়ে যাই, দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে প্রস্তুত হইতেছে ঘরে ঘরে।’
বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের বেতার ও টেলিভিশন ভাষণের নির্যাস স্মরণ করা অপরিহার্য। তিনি বলেছিলেন, ‘ষোলই ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় দিবস। আরও স্পষ্ট কথা বিজয় দিবস। লাখো শহীদের রক্তমাখা এই দিন। লাখো মা-বোনের অশ্রæভেজা এই দিন। আবার সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বপ্ন ও পরম আকাক্সক্ষার এই দিন। এইদিন আমরা পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে স্বাধীনতা অর্জন করেছি।’ উল্লেখ্য দৃঢ়চেতা ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সোনার বাংলার মানুষ বিদেশি শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তি পেয়েছে। এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে বড় পবিত্র, বড় বেশি গৌরব ও আবেগমন্ডিত। এই দিন আমরা শ্রদ্ধা ও শোকের সঙ্গে স্মরণ করি আমাদের শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, আবার এই দিন আমরা আনন্দ উৎসব করি, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাফল্যের জন্য। এই দিন এক যুদ্ধ শেষ আর এক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। উনিশ’শ একাত্তর সালের ষোলই ডিসেম্বর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি। এই একই দিনে আমাদের দেশ গড়ার সংগ্রাম শুরু। স্বাধীনতা সংগ্রামের চাইতেও দেশ গড়া বেশি কঠিন। দেশ গড়ার সংগ্রামে আরো বেশি আত্মত্যাগ, আরও বেশি ধৈর্য্য, আরও বেশি পরিশ্রম দরকার।’
১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষ্যে উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি আর আপনার মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সাথে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের উপর অত্যাচার করবেন? গরিবের উপর অত্যাচার করলে আল্লাহর কাছে তার জবাব দিতে হবে। তাই শুধু আপনারা নয়, সমস্ত সরকারি কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য, যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যাতে কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন। যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটা নিরপরাধ লোকের উপর যেন অত্যাচার না হয়। তাতে আল্লাহ্র আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। আপনারা সেই দিকে খেয়াল রাখবেন।’
উপরোল্লেখিত বঙ্গবন্ধুর অমিয় ভাষণসমূহের মহামূল্যবান বার্তা ও আধুনিক উন্নত বিশ্বের আদলে দেশকে ধীরে ধীরে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনা সমূহ এখনও জাতির জন্য অবধারিত। সোনার বাংলা বিনির্মাণে সোনার মানুষ বা সৎ-যোগ্য-মেধাবী মানবসম্পদ উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেকটুকু পিছিয়ে আছে। এখনো প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী-নীতি নৈতিকতায়-সততায়-দেশপ্রেমের অনন্য প্রতীক হিসেবে যারা পরীক্ষিত; তাদের মূল্যায়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রে চরমভাবে উপেক্ষিত। ব্যক্তিস্বার্থে নিয়োজিত কদর্য চরিত্রের বর্ণচোরা-অনুপ্রবেশকারী-অন্ধকারের শক্তির সাথে অদৃশ্য যোগসাজশ বা আপোষকামীতায় পারদর্শী কথিত রাজনীতিক-ব্যবসায়ী-পেশাজীবি ব্যক্তিদের কুৎসিত মনোবৃত্তিকে পরাস্ত করা সরকার ও দেশবাসীর পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। সকল স্তরের নির্মোহ ও ত্যাগী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অবমূল্যায়নের মোড়কে অপাংক্তেয়-বিতর্কিত-অযাচিত-দোষী সাব্যস্ত করার সকল পাপিষ্ঠ উদ্দেশ্য পরিহার করে প্রান্তিক ও ন্যায়পরায়নতায় অবিচল ব্যক্তিবর্গকে যথাযোগ্য মূল্যায়নে যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত করা না হলে জাতি শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; ভবিষ্যতকে আলোকময় করার সকল সৎ উদ্যোগও বিফলে যাবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চটগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়