বোতলজাত ভোজ্যতেলের সুফল কবে?

19

ফারুক আবদুল্লাহ

১৫ থেকে ২০ দিন আগে পাইকারি বাজারে মণপ্রতি সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছিল ৭ হাজার ২০০ টাকায়। এখন কমে তা বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৪২০ টাকায়। একই সময়ে পাম তেল পাইকারিতে মণপ্রতি বিক্রি হয়েছিল ৬ হাজার টাকায়, যা এখন ৪ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কারণ বিশ্ববাজারের প্রভাবে পাইকারি বাজারে ভোজ্যতেলের দামে ধস নেমেছে। এতে খুচরা পর্যায়ে খোলা তেলের দাম আগের চেয়ে কমেছে। তবে এখনো বোতলজাত তেলের দামে প্রভাব পড়েনি।
তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্রের কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে টনপ্রতি পরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম উঠেছিল ১ হাজার ৯৫০ ডলার। সে সময় প্রতি ডলার ৮৬ টাকা হিসাবে লিটারপ্রতি দাম ১৫৩ টাকা ছিল। গত বৃহস্পতিবার এই দাম কমে আসে টনপ্রতি ১ হাজার ৩১৮ ডলারে। এভাবে কখনো ভোজ্যতেলের ইতিহাসে দরপতন হয়নি।
একইভাবে সয়াবিনের চেয়ে পাম তেলের দাম কমেছে বেশি। মালয়েশিয়ার কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বুশরা মালয়েশিয়া ডেরিভেটিভসে গত ৫ মে অপরিশোধিত পাম তেল বিক্রি হয় ৭ হাজার ৩৮২ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা লিটারপ্রতি প্রায় ১৩৯ টাকায়। গত বুধবার এ দাম কমে আসে ৩ হাজার ৮৫০ রিঙ্গিত বা লিটারপ্রতি ৭১ টাকায়। অর্থাৎ দুই মাসে পাম তেলের দাম কমেছে প্রায় ৪৮ শতাংশ।
এদিকে বিশ্ববাজারের প্রভাবে ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে আগের চেয়ে তেলের দামে ধস নেমেছে। আরএম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, ১৫ থেকে ২০ দিন আগে সয়াবিন তেল পাইকারিতে মণপ্রতি ৭ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল আর এখন বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৪২০ টাকায়। একইভাবে পাম তেল পাইকারিতে মণপ্রতি ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হলেও তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৫০০ টাকায়। বিশ্ববাজারের পরিস্থিতির কারণে এমন দরপতন হচ্ছে। সামনে আরও কমতে পারে।
তিনি বলেন, এভাবে ভোজ্যতেলের দরপতন হলেও বোতলজাত তেলের দামে তেমন প্রভাব পড়েনি। এর ফলে ভোক্তা সাধারণ এর সুফল পাচ্ছে না। তাই তেলের বাজার সমন্বয় করা জরুরি।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকজন পরিবেশকের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দরপতন অব্যাহত থাকার কারণে দেশের বাজারে ধস নেমেছে। এর ফলে খুচরা পর্যায়ে খোলা তেলের দাম আগের চেয়ে কমেছে। কিন্তু এখনো বোতলজাত তেলের দাম সেভাবে কমেনি। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে আগের মত বিক্রি হচ্ছে। তাদের কাছে তেলের দরে সমন্বয় করা হবে এমন কোনো বার্তা নেই। তবে খুব শিগগিরই কোম্পানিগুলো সমন্বয়ের উদ্যোগ নিতে পারে বলে জানান অনেকেই।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমার কারণে দেশে দ্রুত দাম সমন্বয়ের দাবি জানিয়েছেন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে এ দাবি জানিয়েছে তারা।
বিবৃতিতে ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, দেশে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন দাম বাড়াতে যতটুকু আগ্রহী, বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশে কমাতে তেমন আগ্রহী না হবার কারণে ভোজ্যতেলের বাজারে এখনকার নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশীয় বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে দেন আমদানিকারকরা। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দীর্ঘদিনেও দেশীয় বাজারে পণ্যটির দাম সমন্বয় হয় না। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় বাজারে দাম বাড়ে, কিন্তু দাম কমলে ব্যবসায়ীরা উল্টো সুর তোলেন। বেশি দামে কেনা বা বুকিং রেট বেশিসহ নানা অজুহাত দেখান। আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমাগতভাবে দাম কমার পরও দেশে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয়ের বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী একাধিক বার আশ্বাস দিলেও সে আশ্বাসের বাস্তবায়ন হয়নি।
বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, যখন বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি ছিলো, তখন পণ্যটি আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট ছাড়, এলসি কমিশন ও এলসি মার্জিন প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর ওই সুবিধা নিয়ে আমদানিকারকরা তেল দেশের বাজারে আনলে দাম কমার কথা ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার বিপরীত ঘটেছে এবং ভোক্তারা তার কোনো সুফল পাননি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে, দেশে তার বিপরীতে বাড়ানো হচ্ছে। আবার ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের উল্টো সুর হলো- ভোজ্যতেলের এফওবি দাম কমলেও বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের উচ্চমূল্যসহ নানা ভৌতিক কারণে দাম আগের অবস্থানে ফিরছে না। এটি ব্যবসায় সুশাসন, ব্যবসায়িক নীতি নৈতিকতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে।
বিবৃতিতে ক্যাব সহ-সভাপতি আরও বলেন, দাম বৃদ্ধির পর্যালোচনা করে দেখা যায়- গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ভোজ্যতেলের দাম পাঁচবার উঠানামা করেছে। এর মধ্যে তিন দফায় দাম বাড়ানো হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারসাজিতে অক্টোবরের শেষ দিক থেকে বেসামাল হয় ভোজ্যতেলের বাজার। ফলে অক্টোবরে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১৩৬ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন ১৬০ টাকা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে প্রতি লিটার ২১০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পরে সরকারের পক্ষ থেকে ৭ ফেব্রæয়ারি লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সে সময় প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৬৮ নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি খোলা সয়াবিন ১৪৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
ক্যাব জানায়, গত রমজানের ঈদের পর গত ৫ মে দেশে ভোজ্যতেলের দাম সরকার পুনর্নিধারণ করে। ওই সময়ে সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি রেকর্ড পরিমাণ ৩৮ টাকা বাড়ানো হয়। এরপর গত ৯ জুন কোনো কারণ ছাড়াই মিল পর্যায়ে ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে এক লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম মিলগেটে ১৮০ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৮২ টাকা ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম মিলগেটে ১৯৫ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৯৯ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এক লিটারের খোলা পাম অয়েলের (সুপার) দাম মিলগেটে ১৫৩ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৫৫ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৫৮ টাকা করা হয়। এক্ষেত্রে সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারপ্রতি ৫ থেকে ৭ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে তিন মাসের ব্যবধানে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ২০০ থেকে ৪৯০ ডলার কমলেও দেশে তার বিপরীতে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে এক মাসে দু’দফায় প্রতি লিটার সয়াবিনে দাম বাড়িয়েছেন ৫১ টাকা।
তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের গড় মূল্য ছিল টনপ্রতি ৭৬৫ ডলার। ২০২০ সালে দাম ছিল ৮৩৮ ডলার এবং ২০২১ সালে সয়াবিনের টনপ্রতি দাম ছিল ১৩৮৫ ডলার। কিন্তু চলতি বছরের মার্চে এক পর্যায়ে তা বেড়ে যায়। মার্চে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম হয় ১৯৫৬ ডলার। সর্বশেষ ১৩ জুলাই পাম অয়েলের টনপ্রতি দাম কমতে কমতে ৯৪১ ডলার এবং সয়াবিনের দাম নেমে আসে ১ হাজার ৩৫৩ ডলারে।