বৈশ্বিক মহামারি, নতুন মেয়র ও জন প্রত্যাশা

32

আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী

২৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর মহানগর ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম এর মানুষ পাবে তাঁদের নির্বাচিত মেয়র। এই নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল আরো আগে। অর্থাৎ গত বছরের মার্চে। যদি সময়মত হতো, এতোদিনে নতুন মেয়র কিছু কাজও শুরু করতে পারতেন। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর কারণে তা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের জননন্দিত প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা এবং এই রাষ্ট্রের উপর মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতের কারণে বাংলাদেশ করোনা মহামারির মধ্যেও আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর ঠিক এই সময়টিতে ইউরোপের অনেক দেশে লকডাউন পুনরায় শুরু হয়ে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত। করোনার কারণে কর্মচ্যুত হয়েছে কোটি মানুষ। বাংলাদেশ ও তার ব্যতিক্রম নয়। সাধারণ মানুষ দিশেহারা। সরকার টিসিবির কার্যক্রম পুনরায় চালু করেছে। মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্তসাধারণ ছুটির প্রচন্ড সংকটকালে রাস্তায় দেখা গেছে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে সরকার নির্ধারিত ন্যায্য মূল্যে টিসিবির ট্রাক থেকে চাল, ডাল, আটা, তেল, চিনিসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করেছে। বাঁচতে হলে খেতে হবে। ইউরোপে সরকার ঘরে ঘরে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কারণে যা সম্ভব নয়। সরকার সাধ্যমত চেষ্টা করেছে ও করছে। কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন চালু রাখা সম্ভব নয়। তদুপরি এখন অফিস চালু হয়েছে। কাজ ফেলে ট্রাকের লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানো সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে পাকিস্তানি আমলের পরেও স্বাধীনত্তোরকালে রেশন কার্ড ব্যবস্থা চালু ছিল যা ভারতে এখনো আছে। প্রতি সপ্তায় মানুষ নির্দিষ্ট ওয়ার্ডের রেশন দোকান থেকে সরকারি ইস্যুকৃত রেশনকার্ডের মাধ্যমে সরকারি মূল্যে চাল, আটা, তেল, চিনি, লবণ এমনকি গম ও ক্রয় করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর রেশন দোকানের মাধ্যমে সরকারি মূল্যে দুধ ও বিভিন্ন দেশ প্রদত্ত ভোগ্যপণ্য ন্যায্য মূল্যে সাধারণ মানুষকে সংগ্রহ করতে আমরা দেখেছি। বৈশ্বিক এই অর্থনৈতিক সংকটে অনেক উন্নত দেশও পণ্য রপ্তানি প্রক্রিয়ায় বিধিনিষেধ আরোপ করছে। অতি সা¤প্রতিককালে পিঁয়াজ ও এখন ভোজ্য তেলের ঊর্ধ্বমুখী মূল্য তার উদাহরণ। এমতাবস্থায় নতুন মেয়র যিনি নির্বাচিত হবেন তিনি যদি দেশের এই দ্বিতীয় বৃহত্তর মহানগরটিতে পুনরায় ওয়ার্ড ভিত্তিক রেশন কার্ড চালু করে প্রতি সপ্তায় বা মাসে সাধারণ মানুষের জন্য সরকারি মূল্যে ভোগ্যপণ্য পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন এই মহামারিতে তিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করতে পারেন অনন্য উদাহরণ। আরো একটি কাজ যিনি নির্বাচিত হবেন তিনি করতে পারেন। সেটি হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রতিটি ওয়ার্ডে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ওয়াই ফাই চালু করে দিলে বর্তমান শিক্ষার্থীদের অনলাইন শিক্ষার ডাটা খরচের ব্যয় অনেক সাশ্রয় হবে। মোবাইল কোম্পানিগুলোর উচিৎ ছিল এই মহামারী পরিস্থিতিতে ডাটার মূল্য ও মোবাইল ফোনের কল রেইট কমানো, কিন্তু সেটি তারা করেনি। এই মহামারীকালে একমাত্র মোবাইল কোম্পানিগুলোর ব্যবসা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়েও বেশি বেগবান ছিল। তারা তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন ঠিকমতো করেনি।
আরো দুটি বিষয় নতুন মেয়রের কাছে আমাদের চাওয়া। চট্টগ্রামে বিপ্লব উদ্যান বলে একটি জায়গা আছে। সদ্য বিদায়ী মেয়র এটির সংস্কার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী ¯েøাগান ‘জয় বাংলা’ চমৎকার করে লিখে দিয়েছেন। কিন্তু বিপ্লব উদ্যান নামটি কেন? বাংলাদেশ কোন মেজরের একদিনের বিপ্লবে সৃষ্ট নয়। জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে এই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জাতিরপিতা হয়েছেন। আর স্লোগান দিয়েছেন ‘জয় বাংলা’। ১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রয় নেয়া মানুষদের ভারতীয় জনগণ বলতো জয় বাংলার লোক। প্রতিটি যুদ্ধজয়ের পর আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ¯েøাগান দিত জয় বাংলা। আমি তাই আগামীর নতুন মেয়রের কাছে দাবী জানাবো তথাকথিত বিপ্লব উদ্যান নামটি বাদ দিয়ে এর নামকরণ করা হোক ‘জয় বাংলা’ উদ্যান। দ্বিতীয়ত আমরা যখন ঢাকায় যাই তখন দেখি অনেক প্রয়াত ও আমাদের জন্য বেঁচে থাকা অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে ঢাকার সিটি কর্পোরেশন এর সড়কগুলোর নামকরণ করা হয়েছে। অথচ দু’একজন মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে এখানে সড়কের নামকরণ করা হয়নি। বরঞ্চ আগ্রাবাদের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে জিন্নাহ পরিবর্তন করে শেখ মুজিব সড়ক করা হয়েছে যা এখন করা উচিত বঙ্গবন্ধু সড়ক। ঢাকার জিন্নাহ এভিনিউ হয়েছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ সড়কের নাম এখন সংক্ষিপ্ত করে লেখা হয় এস এস খালেদ সড়ক যা মোটেই বাঞ্চনীয় নয়। চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধকালে যাঁরা কমান্ডার ছিলেন শহরে যাঁরা অমিত তেজে যুদ্ধ করেছেন তাদের নামে সড়কের নামকরণ এখন সময়ের দাবী। এখন কেন গুড সাহেব রোড থাকবে? কেন উর্দু গলি থাকবে? এই বিষয়গুলো নিয়ে নতুন মেয়র কাজ করবেন, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি চিরভাস্মর করে রাখবেন এটিই শেখ হাসিনার সরকারের মেয়রের করা দরকার যা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে জ্বলে উঠা বীর চট্টলার মানুষের প্রত্যাশা।
যাই হোক উপরের প্রস্তাব গুলো আগামীর নির্বাচিত মেয়রের কাছে দিয়ে রাখলাম যা আজকের জনপ্রত্যাশা। আমি নিশ্চিত বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই প্রস্তাব তুলে ধরলে তিনি বিষয়টি শুধুমাত্র চট্টগ্রামের জন্য না করে সারা দেশের জন্য ও করতে পারেন যা নতুন মেয়রের জন্য হবে এক বিরল সম্মান। বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা দারিদ্রমুক্ত স্বপ্নের বাংলাদেশের মানুষ এই মহামারিকাল অতিক্রম করে এগিয়ে যাক এটিই সবাই চাই।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
সিনিয়র সহ-সভাপতি বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্র, চট্টগ্রাম