বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই

15

কয়েকমাস আগে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আগামী বছর বিশ্বে মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়তে গিয়ে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় একই সময়ে সুদের হার বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ায় এ শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতি সামান্য ধাক্কা খেলেও সেটা বিশ্বমন্দার কারণ হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এ বছর বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যে মাত্রায় সুদের হার বাড়িয়েছে, গত পাঁচ দশকে তা দেখা যায়নি। লক্ষ করা যাচ্ছে, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি দ্রত কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ মন্দায় পড়ার কারণে তা আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে। গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানী ঢাকায় বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিশ্বমন্দার শঙ্কা এবং মোকাবেলায় প্রস্তুতির আহবান জানিয়ে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চলমান কভিড-১৯ মহামারির কারণে আগামী বছর বিশ্বে দুর্ভিক্ষ হতে পারে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ যাতে কখনোই দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যের অপ্রতুলতার মতো কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি না হয় সেজন্য দেশবাসীকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোরও আহবান জানান তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, রানি এলিজাবেথের শেষকৃত্যে গিয়ে আমি সবার মুখে শুনেছি, আগামী বছর দুর্ভিক্ষ হতে পারে। তাই যে যা পারেন উৎপাদন করেন। এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদী না থাকে। এ ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতার ব্যবস্থা করেছি। তিনি বলেন, আমাদের মাটি ও মানুষ আছে। তাই এখন থেকেই আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে, বাংলাদেশ যাতে কখনো দুর্ভিক্ষ বা খাদ্য সংকটে না পড়ে। আমরা আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াব। বিশ^ বাজারে প্রতিটি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং পরিবহণ ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে তিনি আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। যুদ্ধের কারণে সারাবিশে^র সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে উল্লেখ করে জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণে তাঁর যুদ্ধ বন্ধ করার উদাত্ত আহবানের পাশাপাশি শিশুদের জন্য খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার পাশাপাশি উন্নত জীবন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণের আহবানের কথাও অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
আমরা মনে করি, দেশের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ বিশ্বব্যাংকের পর প্রধানমন্ত্রীর এ আগাম সতর্কতাকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেবে। সরকার বারবার ব্যয় সঙ্কোচনসহ সঞ্চয় কর, অপচয় বন্ধ কর-এ কথাগুলো বলে আসছে। কিন্তু বিষয়টি আমরা কতটুকু অনুধাবন করছি-তা চিন্তার কারণ। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, বিশ্বমন্দা নিয়ন্ত্রণের প্রধান পদক্ষেপ হচ্ছে, মুদ্রাবাজার ও মূল্য¯ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। এছাড়া বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি যাতে না কমে, সেজন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বস্তুত এ পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে একযোগে কাজ করতে হবে। লক্ষ করা যাচ্ছে যে, স¤প্রতি আমাদের দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাÐ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে। সা¤প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ কম থাকায় তা দিয়ে আমদানি ও অন্যান্য ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজারে ডলারের জোগান দিতে হচ্ছে। আগামী বছর বিশ্বে মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হলে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি কমে যেতে পারে এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে শ্রমনির্ভর পেশার পরিবর্তে মেধানির্ভর পেশাকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রবাসী বংলাদেশিদের অবৈধভাবে অর্থ প্রেরণের পরিবর্তে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে অর্থ প্রেরণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। করোনায় অর্থনৈতিক কর্মকাÐ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় অনেকদিন ধরেই দেশে বিনিয়োগে মন্দাভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ কারণে চাকরির বাজার সংকুচিত হয়েছে। ফলে অনেকেই চাকরিচ্যুত হয়েছে। অনেকের বেতনভাতা কমেছে। এদিকে দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের শিল্প খাতকে চাঙা করে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষিখাতের জোর দিতে হবে, খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণে জোর দিতে হবে। এদিকে ডলারের বাজারের অস্থিরতা কমছে না। এ পরিস্থিতিতে আমদানিনির্ভরতা কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
জানা গেছে, বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় আমদানি কমানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অংশ হিসাবে কৃষি খাতে স্বল্পসুদে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগটি ইতিবাচক। দেশের প্রান্তিক কৃষকের পুঁজি হলো গতানুগতিক প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতা। এ পুঁজি দিয়ে তাদের পক্ষে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব মোকাবিলার কৌশলসহ কৃষকদের আধুনিক পদ্ধতির চাষাবাদ শেখানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে স্বল্পসুদে ঋণ বিতরণের সুফল মিলবে না। শুধু তাই নয়, স্বল্পসুদের ঋণ যাতে কৃষকের গলার কাঁটায় পরিণত না হয়, সেজন্যও পদক্ষেপ নিতে হবে। আমদানিনির্ভরতা কমাতে দেশীয় শিল্পবিকাশেও যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট দূর করা না হলে বিদ্যমান শিল্পখাতও সংকুচিত হয়ে যেতে পারে। দেশীয় শিল্পের বিকাশে অবকাঠমোগত সমস্যা দূর করার পাশাপাশি সুশাসনও নিশ্চিত করতে হবে।