বৈশাখে বজ্রপাতের সম্ভাবনা, সতর্ক হোন

36

মুশফিক হোসাইন

খনার বচনে আছে, ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পুণ্যিদেশ’। বাংলা মাঘ মাস প্রায় শেষ। বাংলায় আরও একটি প্রবাদ আছে ‘মাঘের শীতে বাঘ ডোরে’। এবার মাঘ মাসে উত্তরবঙ্গে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেলেও চট্টগ্রামসহ দক্ষিণাঞ্চালের জেলাগুলোতে তেমন ভাবে শীত অনুভুত হয়নি আবহাওয়া বিভাগের অগ্রিম বার্তায় মাঘের শেষে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। হলে তা ভালই। দেশের শনৈ শনৈ উন্নতি হবে এ সুসংবাদ। আমরাও চাই মাঘের শেষে দেশে বৃষ্টি হোক। এ প্রত্যাশার শেষে বাংলা ঋতু চক্রের ধারা অনুযায়ী আসবে ফাল্গুন ও চৈত্র মাস। তারপর বাংলা নববর্ষ বৈশাখ মাস। বৈশাখে বাঙালির মনে ও প্রাণে বইতে আনন্দধারা। এবার হয়ত সে আনন্দ নাও হতে পারে। বিশ্বময় এখন চলছে অতিমারী কোভিড-১৯ এর প্রচন্ড থাবা। বিশ্বে মৃতের সংখ্যা ২৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্ত কয়েক কোটি। এখন কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভ চলমান। সান্তÍনার কথা দেশে কোভিড প্রতিহত করার ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়ে গেছে। আশা করি কোভিডের প্রকোপ ধীরে ধীরে সহনীয় পর্যায়ে এসে যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবাক হয়ে বলছে বাংলাদেশসহ আটটি সার্কভুক্ত দেশে কোভিডের প্রকোপ তুলনামূলক কম। তারাএ বিষয়ে গবেষণার প্রস্তাব দিয়েছে।
বৈশাখ আমাদের জীবনে আসে নতুনের বার্তা নিয়ে। আবার কখনো কখনো কালবৈশাখীর তুমূল ঝড় লÐভÐ করে দেয় প্রকৃতিকে। আমাদের সমাজে কালবৈশাখী মানেই ঝড় আর বজ্রপাত। এটা প্রকৃতির নিয়ম বলতে চান অনেকেই। কিন্তু বিজ্ঞানিরা বলছেন, দেশে বজ্রপাতের হার ও সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এই বজ্রপাত অনেক সময় যমদূত হয়ে আসে। অথচ ৭০/৮০’র দশকেও এতো সংখ্যায় বজ্রপাত হতো না। মৃত্যুর হারও ছিল তুলনামূলক কম। তখন কেউ বজ্রপাতে মারা গেলে, তাকে বা তাদের অভিশপ্ত হিসাবে বিবেচনা করা হত। গত কয়েক বছরে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানির ঘটনা সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলা নতুন বছরের শুরুতেই দেশে জ্রপাত রীতিমতো আতংকে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ২০১০ সালে সরকার। বজ্রপাতকে ‘দুর্যোগ’ হিসাবে ঘোষণা করে। পরিবেশ বিজ্ঞানিরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে বজ্রপাত বাড়ছে। অন্যদিকে যাপিত জীবনে ধাতব বস্তুর ব্যবহার বেড়ে যাওয়া এবং বজ্রপাত নিরোধক সুউচ্চ গাছের অভাবের কারণে দেশে মৃত্যুও হার বাড়ছে। আশার কথা বজ্রপাত নিরোধে অঞ্চলে তালগাছ লাগানো কর্মসূচির একটা উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। এছাড়াও দেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি জোরদার হচ্ছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণের কোন উপায় নেই। তবে কিছু কিছু প্রচেষ্টা ও পদক্ষেপ নেয়া গেলে নিরাপদ থাকা যেতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসেই সর্ভশেষ রেকর্ড অনুযায়ী প্রায় ৪৭ জন মারা গেছে। বিষ্ময়ের বিষয় ২০১৮ সালের একদিনেই মারা গেল ১৮জন। এদেও মধ্যে বৃহত্তর চট্টগ্রামের রাঙামাটি এবং মীরসরাইতে একজন কওে দু’জন মারা গেছে। তার আগের বছর ২০১৭ সালে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৭৯ জন। তার আগে ২০১৬ সালে মৃতের সংখ্যা ছিল দুই শতাধিকের বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাবিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তণজনিত কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়ছে। যার ফলে বজ্রপাত, ঝড়, বৃষ্টি ও জলোচ্ছ¡াসের সংখ্যা বাড়ছে। এর জন্য মূলত বৈশ্বিক উষ্ণয়নই দায়ী। উষ্ণতার কারণে বায়ুমন্ডল দ্রুত গরম হয়ে যাওয়ায় মেঘ সৃষ্টির স্বাভাবিক পরিবেশ থাকে না। ফলে দ্রুত মেঘ তৈরির সময় বাড়ছে বজ্রপাত। বাংলাদেশে যে বজ্রপাত হয় তার আতুরঘর ভারতের সমুদ্রউপকুলে।
প্রকৃতির উপর মানুষের নির্দয় আচরণের কারণে প্রকৃতি রুষ্ট হচ্ছে। বজ্রপাতে শুধু মৃতের সংখ্যা বাড়ছে তা নয় সম্পদেরও হানি হচ্ছে। মানব সমাজকে উপলব্ধি করতে হবে প্রকৃতির প্রতি বৈরি আচরণ যত বাড়বে, ততই বাড়বে মানুষের মৃত্যুর মিছিল। বাতাসে যতবেশি কার্বণের হার বাড়বে তত বেশি বজ্রপাত বাড়বে। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে বায়ুদূষণ প্রতিদিন আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। এ দূষণের মাত্রা যত বাড়বে ততই বিপদ বাড়তে থাকবে। প্রকৃতি তথা গাছ ও বনাঞ্চল ধ্বংস করা থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের কারণে এখন বজ্রপাতের পূর্বাবাস ছয়ঘন্টা আগে পাওয়া যায়। এ ছাড়া ১০৯৪১ নম্বরে ডায়াল করলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বজ্রপাতের তথ্য পাওয়া যায়। গবেষকদের ধারণা, বাংলাদেশে গত ৮০ থেকে ১২০ দিন বজ্রপাত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বেস্টস্টেট ইউনির্ভাসিটির ডিপার্টমেন্ট অব জিওগ্রাফির প্রফেসর ড. টমাস ডব্লিউ স্মিজলিনের রিস্ক ফ্যাক্টরস অ্যান্ডসোসাল ভালনারেবিলিটি শীর্ষক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, প্রতি বছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতিবর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় ৪০টি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের চৈত্র-বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের এ সময়টা গরমের সময়। বাযুদূষণ, বাতাসে কার্বণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে এমনটি হচ্ছে। যা কিনা নভোমন্ডলের বায়ুকে উত্তপ্ত রাখতে সাহায্য করে। কার্বন লেডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এবং অন্যান্য যে সব উপাদান মেঘ তৈরিতে সহায়ক, সেগুলো সক্রিয় থাকে। ফলে বজ্রপাত বেশি ঘটে।
নিরক্ষীয় রেখার ৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি আর ক্রান্তি অঞ্চলের ১৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি উত্তর দক্ষিণের দেশ বাংলাদেশে বজ্রপাত একটা স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতি বছর বিশ্বেও বায়ুমন্ডলে প্রায় দুই কোটিবার বজ্রপাত হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিজ্ঞানিরা ধারণা করছেন ২০৫০ সাল নাগাদ বজ্রপাতের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে প্রায় তিন কোটি। ফলে এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবে জানমালের ক্ষয়ক্ষতিও বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তন হেতু গত ৪০ বছরে বাংলাদেশর তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে ২০ শতাংশ বজ্রপাত বৃদ্ধি পায় এ হিসাবে বজ্রপাত প্রায় ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবেশ বিজ্ঞানিরা ধারণা করছেন, কোন দৈব ঘটনা না ঘটলে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে গড় তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। এতে করে বিশ্বে বজ্রপাতের ঝুঁকিও সমান হারে বাড়বে নিঃসন্দেহে।
এক সময় বাংলাদেশে লম্বা লম্বা গাছের প্রাচুর্য ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সাল থেকে দেশের মানুষ বেপরওয়া হয়ে উঠে। গাছপালা, বন বনানী, নদী নালা খালবিল সব জবর দখলের আওতায় চলে আসতে থাকে। যে যার মতো স্বাধীনতা ভোগ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। জবাবদিহিতার অবকাশ থাকে না। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গবেষণার জন্য ঢাকার প্রতিষ্ঠিত সার্ক মিটিওরোজিকাল রিসার্স সেন্টার এক গবেষণায় জানা যায় দেশে বজ্রপাতের হার ও মৃত্যু সংখ্যা দুটোই বাড়ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ বজ্রপাতের ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জনসচেতনতা অতীব জরুরি। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সভা সেমিনার, বিলবোর্ড, পোস্টার ও মোবাইল ফোনে মেসেজ পাটানোসহ নানা পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবইয়ে এসংক্রান্ত বিষয়ের শিক্ষাকার্যক্রম চালু রাখা যেতে পারে। বজ্রপাত সরাসরি মাটিতে পড়ে না, বিদ্যুৎ পরিবাহীর উপর পতিত হয়। এরপর পরিবহন পদ্ধতির মাধ্যমে মাটিতে চলে আসে। এজন্য উঁ”ু গাছ, ভবন ও পাহাড় শীর্ষে বজ্রপাত পতিত হয়। যে কারণে বাসাবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল ভবনে বিদ্যুৎরোধী তার লাগানো হয়। ফলে জান মালের হার কমে। কিন্তু সমস্যা হলো মানুষ তো আর ঘরে বসে থাকে না। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে তাকে ক্ষেতে খামারে কিংবা ঘরের বাইরে থাকতে হয়। এখানেই ঘটে বিপত্তি। আসন্ন বৈশাখ থেকে জ্যৈষ্ঠমাস তথা এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত জনসাধারণকে বজ্রপাত থেকে সাবধান থাকতে হবে। সতর্কভাবে চলাচল করা বাঞ্চনীয়। মনে রাখতে হবে আকাশে ঘন মেঘ দেখা দিলে বজ্রপাতের আশঙ্কা তৈরি হয়। বজ্রপাত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময় ঘরের বাইরে না যাওয়াই শ্রেয়। নিতান্ত যদি যেতেই হয় রাবারের জুতা পায়ে বের হওয়া ভালো। বজ্রপাতের সময় খোলা জানালা, খোলা মাঠ ও উঁচু স্থানে অবস্থান করা যাবেনা। বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ রাখা বাঞ্চনীয়। ঘরের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে। ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার না করে কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার নিরাপদ।
বায়ুমন্ডলে উঞ্চতা বাড়ছে, অতএব আসন্ন বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে অনেকগুলো বজ্রপাতের সম্ভাবনা থেকেই যায়। সমাজের মানুষ যদি সতর্ক না হয়, তবে জানমালের ক্ষতির সম্ভাবনা প্রচুর। আসুন নিজে সতর্ক হই অন্যকে ও সতর্ক করি। দেশ ও জাতির মূল্যবান সম্পদ ও জানমালের হেফাজত করি।

লেখক: কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)