বে-টার্মিনালে ডেলিভারি ইয়ার্ড ও ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণের দাবি

45

তীব্র যানজটে স্থবির হয়ে পড়া চট্টগ্রাম বন্দর কেন্দ্রিক আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি সঞ্চারে শিগগির বে-টার্মিনাল এলাকায় ডেলিভারি ইয়ার্ড ও ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম। গতকাল বুধবার বন্দর এলাকায় যানজটের সমস্যা চিহ্নিতকরণে আগ্রাবাদের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের বঙ্গবন্ধু কনফারেন্স হলে আয়োজিত সমন্বয় সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ দাবি জানান।
এসময় তিনি বলেন, অতি বৃষ্টি, যানজট ও জলজটের কারণে বন্দরে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিমানবন্দর থেকে মূল শহর পর্যন্ত মাত্র ১৬ কিলোমিটার সড়ক পেরোতে প্রায় ৪ ঘণ্টা সময় লাগছে। যার ফলে অনেক বিদেশি ক্রেতা কার্যাদেশ না দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় নগরের ওপর চাপ কমিয়ে বন্দরের গতিশীলতা বজায় রাখতে অতিসত্বর বে-টার্মিনাল এলাকায় ডেলিভারি ইয়ার্ড ও ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ ফার্স্টট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় সরকারের লক্ষ্য অর্জন চরম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ অচলাবস্থা রোধকল্পে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানোর জন্য চসিক, চউক, বন্দর, কাস্টম, বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর প্রধানদের নিয়ে শিগগির সমন্বয় সভা করবেন বলেও জানান চেম্বার সভাপতি।
চেম্বার সহ-সভাপতি তরফদার মো. রুহুল আমিন বলেন, স্বাভাবিক সময়ে ৩ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হলেও এ সময়ে তা ১৫শ এর নিচে নেমে আসে। তিনি ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের জন্য যানজট সৃষ্টি হচ্ছে উল্লেখ করে অতি দ্রæত অর্থনীতির লাইফ লাইনখ্যাত অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ এই সড়কের বিকল্প ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান। সেই সাথে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনানুযায়ী বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্ক্যানার মেশিন স্থাপন করা হলে হ্যান্ডলিং কার্যক্রম আরও অনেক গতিশীল হবে বলে তিনি জানান।
চেম্বার পরিচালক অঞ্জন শেখর দাশ বলেন, প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিক ইপিজেডে কর্মরত রয়েছে যাদের যানজটের কারণে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ ছাড়া সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছতে না পারার কারণে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) এনামুল করিম বলেন, বন্দর ও কাস্টমস’র মাধ্যমে অর্জিত রাজস্ব আয় শূন্য দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। আমাদের ৬০ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্যের কথা মাথায় রেখে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে। দেশের স্বার্থে ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে কোনো মতেই বাধাগ্রস্ত না হয় সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সবাইকে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (নিরাপত্তা) লে. কর্নেল তানভীর আহাম্মদ জায়গীরদার বলেন, দেশের অর্থনীতির স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনামতে বন্দর সর্বদা সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। অন্য সব স্টেকহোল্ডারদেরও স্ব-স্ব অবস্থান থেকে একইভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বন্দরের সুনাম ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে আইএসপিএস কোড অনুযায়ী সার্বিক নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তিনি বন্দরে প্রবেশকারী ড্রাইভারদের স্মার্টকার্ড বিতরণের জন্য বন্দর গেটের পরিবর্তে পৃথক ব্যবস্থা করে নির্দিষ্ট দিন ও স্থান সবাইকে জানানো হবে বলে জানান।
বন্দর এলাকার সহকারী কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মোশাররফ হোসেন যানজটের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে জলাবদ্ধতা, পরিকল্পিত উপায়ে সব ধরনের প্রকল্প ও সংস্কার কাজ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। বারিক বিল্ডিং থেকে এয়োরপোর্ট পর্যন্ত একমাত্র রাস্তার ওপরে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের কাজ চলমান থাকায় বিকল্প সড়ক হিসেবে কাটগড়, র‌্যাব-৭ সংলগ্ন এলাকা, ইপিজেড, হালিশহর-বড়পোল ও জহুর আহমেদ স্টেডিয়াম সংলগ্ন সংযোগ সড়কসহ রিং রোডের কাজ দ্রæত শেষ করা, বিদ্যমান সড়কের স¤প্রসারণের মাধ্যমে যানজট নিরসন সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, সিডিউল অনুযায়ী ক্রম অনুসারে ট্রাক, প্রাইম মুভার বন্দরে ঢোকানোর ব্যবস্থা করলে সড়কে কোনো খালি গাড়ি অপেক্ষমাণ থাকবে না। এতে যানজটের হার অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
বিজিএমইএর সহ-সভাপতি এএম চৌধুরী সেলিম বলেন, বর্তমান অর্থনীতি বিনষ্ট করে কখনো ভবিষ্যৎ অর্থনীতির ভিত রচনা করা সম্ভব নয়। শত প্রতিকূলতার মাঝেও আরএমজি রপ্তানি খাতে ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে যা আরও বাড়ার কথা ছিল। এ ধারা অব্যাহত রাখতে রপ্তানি কার্যক্রম আরও নির্বিঘœ করতে হবে। তিনি সার্বক্ষণিকভাবে বন্দর ও কাস্টমস’র কার্যক্রম চালু রাখার দাবি জানান। এছাড়াও বন্দর এলাকায় বিগত ৭-৮ দিনে স্মরণকালের তীব্র যানজটে সৃষ্ট অচলাবস্থার নেপথ্যে কোনো দুরভিসন্ধি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার আহŸান জানান।
পরিচালক সৈয়দ জামাল আহমেদ ও অঞ্জন শেখর দাশ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) এনামুল করিম ও পরিচালক (নিরাপত্তা) লে. কর্নেল তানভীর আহাম্মদ জায়গীরদার, বন্দর এলাকার সহকারী কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মোশাররফ হোসেন ও বিজিএমইএর পরিচালক খন্দকার বেলায়েত হোসেন বলেন, এ সেক্টরে লিড টাইম ঠিক রাখা ছাড়া টিকে থাকা খুবই কঠিন ব্যাপার তা সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে।
সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু স্ক্যানার মেশিন অপারেটরদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের বন্দর বিষয়ক সম্পাদক লিয়াকত আলী হাওলাদার মতামত তুলে ধরেন।লিয়াকত আলী হাওলাদার পতেঙ্গা এলাকায় ৭-৮টি অফডক’র অবস্থান যানজটের অন্যতম কারণ বলে মন্তব্য করেন।
এ ছাড়া যানজট নিরসনে রাত ৮টার পর থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সড়ক মেরামতের কাজ করার জন্য সিটি করপোরেশনের প্রতি আহŸান জানানো হয়। এনসিটি ৩ নম্বর গেট ভোর ৬টা থেকে চালু করা, পরিবহন প্রবেশের ক্ষেত্রে একাধিক লেন খোলা রাখা, সিপিআর গেট দিয়ে স্ক্র্যাপ বহনকারী গাড়ি প্রবেশ ও বের হওয়া নিশ্চিত করা হবে বলে সভায় জানানো হয়।
সভায় জাহাজ আসার আগে অর্থাৎ অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়া কোনো গাড়িকে বন্দরে ঢোকার অপেক্ষায় থাকতে না দেওয়া, বন্দরের ভেতরে কোনো ট্রাক/ট্রলি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় অবস্থান করতে না দেওয়া, ট্রাক/ট্রলি চালকদের কনটেইনার অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া, বন্দর এলাকায় রাস্তার ওপরে ও ফুটপাতে কোনো ধরনের দোকানপাট করতে না দেওয়া, এলসিএল কনটেইনারের পণ্যসমূহ বন্দর অভ্যন্তরে না খোলা, কর্তৃপক্ষের কাছে বন্দরে প্রবেশমুখী গাড়ির নম্বর ও চালকের বৃত্তান্ত যথাসময়ে দাখিল করা, ফুটওভার ব্রিজ তৈরি ও ব্যবহার নিশ্চিত করা, রেল চলাচলে শৃংঙ্খলা আনা, এয়ারপোর্ট রোড, পোর্ট কানেক্টিং রোড ও আগ্রাবাদ এক্সেস রোড-সহ সংস্কারাধীন সড়কগুলোর কাজ দ্রæত সম্পন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়।