বেড়েই চলেছে স্বর্ণের দাম ভরি ৫৮ হাজার টাকা ছাড়াল

94

স্বর্ণের বাজার লাগামহীন। বাড়ছেতো বাড়ছেই। শুধু চলতি মাসেই বেড়েছে চার বার। এক বছরে ৯ দফায় ভরি প্রতি দাম বাড়েছে প্রায় ১১ হাজার টাকা। সর্বশেষ গত সোমবার বাড়ানো হয়েছে ভরি প্রতি ১১৬৬ টাকা। এতে স্বর্ণের ভরি ৫৮ হাজার টাকা ছাড়াল। দফায় দফায় দাম বাড়ানোর কারণে চাহিদা কমলেও বিপাকে ক্রেতারা। একই সাথে ভারতেও স্বর্ণের দাম বাড়ছে। কলকাতায় প্রতি ১০ গ্রাম বিক্রি হচ্ছে ৪০ হাজার রুপিতে।
সরকার ঘোষণা দিয়ে স্বর্ণ বৈধ করার যে সুযোগ দিয়েছিল, তাতে দাম স্থিতিশীল হবে বলে ভোক্তাদের প্রত্যাশা ছিল। বরং হয়েছে উল্টো। এক বছরে অলংকার তৈরির এই ধাতুর দাম বাড়ানো হয়েছে ভরিতে প্রায় ১১ হাজার টাকা।
জানা যায়, গত ৮ আগস্ট স্বর্ণের দাম প্রতি ভরিতে এক হাজার ১৬৬ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা এসেছিল। এর মাত্র এক দিন আগে ৬ আগস্ট সবধরনের স্বর্ণের দর একই পরিমাণ বাড়ানো হয়েছিল। ১৮ আগস্ট সবধরনের স্বর্ণের দরও ভরিতে ১ হাজার ১৬৬ টাকা করে বাড়ানো হয়। সর্বশেষ সোমবার চতুর্থ দফায় স্বর্ণের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি। ঘোষণা অনুযায়ী ভালো মানের স্বর্ণের দর ভরিতে ১ হাজার ১৬৬ টাকা বাড়ানোয় ২২ ক্যারেট স্বর্ণ এখন প্রতি ভরি ৫৮ হাজার ২৮ টাকায় বিক্রি হবে।
২৪ জুলাই আরেক দফা বাড়ানো হয়েছিল স্বর্ণের দর। তখনও ভরিতে ১ হাজার ১৬৬ টাকা বাড়ানো হয়েছিল।
সোমবারের ঘোষণা অনুযায়ী ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের মূল্য ৫৫ হাজার ৬৯৬ টাকা, ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের মূল্য ৫০ হাজার ৬৮০ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণের দাম ৩০ হাজার ৩২৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
গত রবিবার পর্যন্ত প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণ ৫৬ হাজার ৮৬২ টাকা, ২১ ক্যারেট ৫৪ হাজার ৫২৯ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৪৯ হাজার ৫১৩ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণ ২৯ হাজার ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়।
দাম বাড়ানোর পেছনে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধিকে কারণ দেখিয়েছেন বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়াল। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দর প্রতিদিনই বাড়ছে। গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠেছে এর দাম।
পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেন, ছয় মাস আগে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ছিল ১ হাজার ২৭০ ডলার। সোমবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬০০ ডলারে। এক বছর আগে ছিল ১ হাজার ১৭৩ ডলার। তিনি বলেন, আমেরিকা-চীন বাণিজ্য যুদ্ধে গোল্ডের দাম ভবিষ্যতে আরও বেড়ে যেতে পারে, এ আভাস পেয়ে অনেকেই এখন এটি কিনে মজুদ করে রাখছে। সে কারণে চাহিদা বাড়ায় দরও চড়ছে।
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরেই স্বর্ণের দাম বাড়ানো হয়েছে নয় বার। ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম সবশেষ ২৬ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৮ হাজার ২৮ টাকা। যা ২০১৮ সালের ৬ আগস্ট ছিল ৪৭ হাজার ৪৭২ টাকা ৪৮ পয়সা। ১ হাজার ৫১৬ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি দাম হয় ৪৮ হাজার ৯৮৮ টাকা ৮০ পয়সা। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে বাড়ে ১ হাজার ১৬৬ টাকা। তাতে ২৯ জানুয়ারি দাম হয় ৫০ হাজার ১৫৫ টাকা ২০ পয়সা। ১৪ জুন হয় ৫১ হাজার ৩২১ টাকা ৬০ পয়সা। ১৮ জুলাই হয় ৫০ হাজার ১৫৫ টাকা ২০ পয়সা। ৭ জুলাই হয় ৫২ হাজার ১৯৬ টাকা ৪০ পয়সা। ৬ আগস্ট হয় ৫৪ হাজার ৫২৯ টাকা ২০ পয়সা। ৮ আগস্ট হয় ৫৫ হাজার ৬৯৫ টাকা ৬০ পয়সা। ১৯ আগস্ট হয় ৫৬ হাজার ৮৬২ টাকা। একই সময়ে ২১ ক্যারেট, ১৮ ক্যারেট ও সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণের দামও বাড়ানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, সরকার চলতি সালের শুরুতে স্বর্ণ নীতিমালা জারি করে। তাতে স্বর্ণ আমদানির শর্ত শিথিল করা হয়। স্বর্ণ আমদানির জন্য ডিলারের লাইসেন্সও দেয়া হয়। ভরি প্রতি এক হাজার টাকা ট্যাক্স দিয়ে অবৈধ স্বর্ণ বৈধ করারও সুযোগ দেয়া হয়।
গত জুন মাসের শেষে প্রথমবারের মতো স্বর্ণ করমেলার আয়োজন করা হয়। মেলায় ব্যবসায়ীদের হাতে থাকা অপ্রদর্শিত প্রতি ভরি স্বর্ণ ১ হাজার টাকায় বৈধ করার সুযোগ ছিল। এ সময় স্বর্ণ মালিকরা ১৭৫ কোটি টাকা কর দিয়ে অবৈধ স্বর্ণ বৈধ করেন।
ঘটা করে স্বর্ণ করমেলা করার পর ৪ জুলাই স্বর্ণের দর বাড়িয়েছিল বাজুস। সেবার ভালোমানের সোনা ভরিতে ২ হাজার টাকার বেশি বাড়ানো হয়েছিল।
এর আগে ১৩ জুন ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার দিন প্রতি ভরি ভালোমানের সোনার দাম দেড় হাজার টাকা বাড়ানো হয়। বাজুস সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা সাংবাদিকদের বলেন, শেয়ারবাজার ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অনেক বিনিয়োগকারী এখন স্বর্ণকেই নিরাপদ মনে করছেন। তাই বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের নজর এখন স্বর্ণ মজুদে। যেখানে শেয়ারবাজারের তুলনায় পুঁজি হারানোর ভয় অনেক কম। শেয়ারবাজার ছেড়ে স্বর্ণে বিনিয়োগ এর দাম বাড়াতে অনেকটাই ভূমিকা পালন করছে। তিনি আরও বলেন, গত এক মাসে বিশ্ব বাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম বেড়েছে ১৫০ ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তুলনা করলে দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম এখনো কম। বিশ্বব্যাপী শেয়ারবাজারে জালিয়াতির কারণে অলংকার তৈরির এই ধাতুর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও তিনি মনে করেন।
জানা গেছে, সবশেষ ২৩ আগস্ট বিশ্ব বাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ছিল ১ হাজার ৫২৭ দশমিক ৫ ডলার। আর চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ছিল ১ হাজার ২৮৩ ডলার।
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি সূত্র জানায়, সারাদেশে বর্তমানে ১০ হাজারের বেশি জুয়েলার্স রয়েছে। প্রতি বছর এসব জুয়েলার্সে ১৮ থেকে ৩৬ মেট্রিক টন স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে।
এদিকে স্বর্ণের দাম বাড়ায় প্রভাব পড়েছে ক্রেতা পর্যায়ে। দাম বাড়ায় চহিদাও কমেছে। নগরীর স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রণয় ধর বলেন, দফায় দফায় স্বর্ণের দাম বাড়তে থাকায় কাস্টমার অনেক কমে গেছে। আগের তুলনায় তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে কাস্টমারের অভাবে এক সময় আমাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে বলে তিনি জানান।
দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন ক্রেতারা। বিশেষ করে বিয়েতে স্বর্ণ বাধ্যতামূলক হওয়ার কারণে কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন লোকজন। অপরদিকে ভারতেও স্বর্ণের দাম বেড়েই চলেছে। বর্তমানে সেখানে প্রতি ভরি স্বর্ণ ৪৮ হাজার রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। যা বাংলাদেশি টাকায় ৫৬ হাজার টাকারও বেশি।