বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্বৃত্তায়ন? চমেক হাসপাতালে ডায়ালাইসিস ফি ইস্যু

12

আসহাব আরমান
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের অবকাঠামো, পানি, বিদ্যুৎ ও নিরাপত্তাসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুবিধা ব্যবহার করে ডায়ালাইসিসের রোগীদের সেবা দিয়ে আসছে স্যান্ডর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস বাংলাদেশ (প্রা.) লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের রোগীদের জন্য সরকারি ভর্তুকির ব্যবস্থা রয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির প্রদেয় ভর্তুকি মনে হলেও সমপরিমাণ টাকা সরকার থেকে বিল হিসেবে নিয়ে আসছে তারা।
তাহলে হঠাৎ সেবার মূল্য বৃদ্ধি করলো কারা? সরকার নাকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি? এমন প্রশ্নের উত্তরে উঠে এসেছে সরকারি হাসপাতালে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে অসহায় রোগীদের জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা দুর্বৃত্তায়নের চিত্র। অন্যদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা খরচ করে সমপরিমাণ ডায়ালাইসিস রোগীর সেবা দেওয়ার মত ‘সেটআপ’ চট্টগ্রামের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে সহজে দিতে পারেন। করোনা মহামারীর সময় এমন দৃষ্টান্তের সংখ্যাও অনেক।
অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধি ইস্যুতে ভুক্তভোগীদের আন্দোলন, পুলিশের ধরপাকড়, মামলা-জামিনের পর স্যান্ডরের ডায়ালাইসিসে রোগীদের জন্য সরকারি ভর্তুকি আপাতত আগের নিয়মে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মৌখিক নির্দেশের পর গতকাল সোমবার থেকে স্যান্ডরের ডায়ালাইসিসে সরকারি ভর্তুকি সুবিধা কমানোর সিদ্ধান্ত আপাতত কার্যকর হচ্ছে না।
এ বিষয়ে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘ভর্তুকির সেশন কমানোর সিদ্ধান্তে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ায় বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি। ভর্তুকির বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। ফলে ভর্তুকির সেশন সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে। আপাতত স্যান্ডরের ডায়ালাইসিসে ভর্তুকি আগের মতোই থাকছে। এ ছাড়া হাসপাতালে নতুন চারটি ডায়ালাইসিস মেশিন বসেছে। সেখানেও কিছু রোগী যাচ্ছেন। দুদিক মিলিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছি।’
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্যান্ডর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস মূলত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ২০১৫ সালে এই কোম্পানির সাথে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ঢাকার জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে ৫০টি এবং চমেক হাসপাতালে ৩০টি মেশিন স্থাপন করে রোগীদের ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া হচ্ছে। এখানে দুটি পদ্ধতিতে সেবা দেওয়া হয়। একটি হচ্ছে সাড়ে ৫শ’ টাকা অপরটি দুই হাজার ৮৫০ টাকা। সাড়ে ৫শ’ টাকার অবশিষ্ট টাকা সরকার স্যান্ডরকে ভর্তুকি দিয়ে আসছে। মূলত সরকারই চালাচ্ছে এই ডায়ালাইসিস সেন্টার।
মূলত কিছুদিন ধরে ভর্তুকির বিলটি পেতে দেরি হওয়ায় মূল্য বৃদ্ধির কৌশল অবলম্বন করে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া একটি ডায়ালাইজার দিয়ে একজন রোগীকে সেবা দেওয়ার কথা। স্বাস্থ্য বিজ্ঞান মতে, একটি ডায়ালাইজার দিয়ে একাধিক রোগীকে সেবা দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি একটি ডায়ালাইজার দিয়ে তিন থেকে পাঁচজন রোগীকে সেবা নিতে বাধ্য করছে। অথচ সরকার থেকে রোগীপ্রতি নির্দিষ্ট অংকের ভর্তুকি নিচ্ছে। চমেকহা’র অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, ডায়ালাইসিসের বিশেষায়িত পানি, নিরাপত্তা, মার্কেট ভ্যালু সবকিছু ব্যবহার করেও স্বস্তি নেই প্রতিষ্ঠানটির।
জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধি নিয়ে গত ৭ জানুয়ারি থেকে বিক্ষোভে নামে রোগী ও তাদের স্বজনরা। ১০ জানুয়ারি সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করার সময় পুলিশের সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ বাধে। এসময় মোস্তাকিম নামে এক রোগীর স্বজনকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে গত রবিবার আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান মোস্তাকিম।
এদিকে গতকাল সোমবার থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে আগের সুবিধাতেই ডায়ালাইসিস সেবা চালু করে স্যান্ডর। আগে একজন রোগী ১০টি ডায়ালাইসিস সেশনের ৭টি ভর্তুকি পেয়ে থাকেন। এই সুবিধা বহাল আবারো রাখা হয়েছে। তবে চুক্তি অনুযায়ী ফি ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে ভর্তুকি সেশনের রোগীকে ৫১০ টাকার পরিবর্তে ৫৩৫ টাকা এবং বেসরকারি সেশনে ২৭৯০ টাকার পরিবর্তে ২৯৫০ টাকা ফি প্রদান করতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ন ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘আমি মনে করি, এটি একটি অসম চুক্তি। কারণ স্যানডোর কোম্পানি চট্টগ্রাম মেডিকেলের জায়গা, পানি ও বিদ্যুৎ সুবিধা ব্যবহার করছে। তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেলকে টাকা পরিশোধ করার কথা। উল্টো তারা সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি দিচ্ছে। যদিও বলা হচ্ছে স্যান্ডর কোম্পানি বাংলাদেশের মানুষকে সেবা দিচ্ছে। কিন্তু তারা মূলত অসহায় রোগীদের জিম্মি করে ব্যবসা করছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী স্যান্ডর বাৎসরিক নির্দিষ্ট সংখ্যক রোগীকে ভর্তুকিতে ডায়ালাইসিস সেবা দিবে। কিন্তু নানা চাপের কারণে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি রোগীকে ভর্তুকিতে ডায়ালাইসিসের সুপারিশ করে। এতে করে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পরিশোধে বিলম্ব হলে স্যান্ডর ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ করে দেয়। এতে সৃষ্ট অস্থিতিশীল অবস্থা সরকারের ভালো কাজগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার গত ৫ বছরের স্যান্ডরকে যে পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিয়েছে, তা দিয়ে চট্টগ্রামে একটি ১০০ শয্যার ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন করা যেত। চমেকের কিডনি ওয়ার্ডে ৪টি মেশিন এবং কয়েকদিন আগে নিচে আরও ৩টি ডায়ালাইসিস মেশিন চালু করা হয়। তাহলে এই মেশিনগুলো আগে কেন চালু করা হয়নি? চমেকের ১৭নং ওয়ার্ডেই চাইলে ৮টি মেশিন স্থাপন করা যাবে।’
ডা. আ ন ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘করোনাকালে হাসপাতালগুলোতে যে রকম চাহিদা রয়েছে সেরকম মেশিন সরবরাহ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে একসময় আইসিইউ ছিল না। করোনাকালে সেখানে ১৮ বেডের আইসিইউ স্থাপনা করা হয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা খরচ করে যদি ৩০ শয্যার একটি ডায়ালাইসিস ইউনিট চালু করা হয় তাহলে আমাদের আর স্যান্ডরের প্রয়োজন হচ্ছে না। চট্টগ্রামের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলেও একটি ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করি।’