বেতন না বাড়িয়ে গালমন্দ করায় খুন করে গৃহকর্মী

21

বেতন বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বললেই রাগারাগি, গালমন্দ। আর এতে অসন্তুষ্ট হয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় লোহার খুন্তি (স্থানীয় ভাষায় খোরাবারি) দিয়ে সজোরে মাথায় আঘাত করার পর মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যার চেষ্টা, তাতেও মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়ায় অন্য কক্ষ থেকে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করে খুন করা হয়েছে সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা আব্দুল হক মিঞাকে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এমন রোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছে গৃহকর্মী জমির উদ্দিন। গতকাল বুধবার দুপুরে সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ আনোয়ার হোসেনের অফিসে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এমন বর্ণনার কথা জানান সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকারিয়া রহমান জিকু। এর আগে গত মঙ্গলবার বিকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আব্দুল হক মিঞার বাড়ির পেছনের একটি পুকুরের পানি সেচ করে পুলিশ হেফাজতে থাকা জমিরের দেখানো মতে, তিনটি মোবাইল ফোন, হত্যায় ব্যবহৃত খন্তি ও ছুরি উদ্ধার করা হয়।
জানা যায়, গত রবিবার রাতে আব্দুল হক মিঞা তার এক আত্মীয়ের সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলে রাত দেড়টার সময় ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে রান্না-বান্নার কাজ করার জন্য কাজের বুয়া নুর নাহার এসে বাড়ির প্রধান গেট বন্ধ পেয়ে পিছনের খোলা থাকা দরজা দিয়ে প্রবেশ করে শয়নকক্ষে আব্দুল হক মিঞার লাশ ও লাশের পাশে চোখ, মুখ ও পা বাধা অবস্থায় গৃহকর্মী জমির উদ্দিনকে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার দিয়ে প্রতিবেশীদের বিষয়টি জানান। পরে খবর পেয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে লাশ উদ্ধার ও জমিরকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যান।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জমির উদ্দিনকে ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে অসংলগ্ন বিবরণ দেওয়ায় পুলিশের সন্দেহ হয়। পরে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয়।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ঘুমিয়ে থাকা আব্দুল হক মিঞাকে ভোর আনুমানিক পাঁচটার দিকে খুন্তি দিয়ে মাথায় সজোরে আঘাত করলে তিনি চিৎকার দিয়ে উঠেন। এরপর ধস্তাদস্তি করে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলে পরক্ষণে ঐ কক্ষ থেকে বেরিয়ে নিজের কক্ষ থেকে ধারালো ছুরি এনে তা দিয়ে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে ঘটনা থেকে নিজেকে আড়াল করতে ডাকাতির ঘটনা সাজানোর চেষ্টায় বাড়ির মালামাল তছনছ করে। এরপর আব্দুল হক মিঞার ব্যবহ্নত একটি ও তার ব্যবহৃত দুটি মিলিয়ে মোট তিনটি মোবাইল বাড়ির পিছনের পুকুরে ফেলে দিয়ে আবারো ঘরে ফিরে এসে কাপড় দিয়ে নিজেই নিজের চোখ, মুখ ও পা বাঁধলেও হাত বাধার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে লাশের পাশেই শুয়ে থাকে যাতে খুনে তাকে কেহ সন্দেহ করতে না পারে।
সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকারিয়া রহমান জিকু বলেন, জমির পুলিশকে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু এক পর্যায়ে সে খুনের ঘটনা স্ববিস্তারে বর্ণনা করে। তার দেওয়া তথ্য ও তার দেখিয়ে দেওয়া অনুযায়ী পুকুর সেচ করে তিনটি মোবাইল ফোন, হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছুরি ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। সে আরো যেসব তথ্য দিয়েছে তা যাচাই বাচাই করে দেখা হচ্ছে। এ হত্যাকান্ডে আরো কেউ জড়িত আছে কি-না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, আব্দুল হক মিঞার ঘরের কর্মচারী জমির এ ঘটনায় শতভাগ জড়িত। বেতন বাড়িয়ে না দিয়ে গালি দেওয়ায় ক্ষোভে আব্দুল হক মিঞাকে খুন করা হয়েছে বলে দাবি করলেও খুনে অন্য কারো সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা তদন্তাধীন।
প্রসঙ্গত, সোমবার সকালে নিজঘরের শয়নকক্ষ থেকে সাতকানিয়া উপজেলার কেওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হক মিঞার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এদিকে বেতন না বাড়িয়ে গালি দেওয়ায় কর্মচারী জমির এমন নির্দয়ভাবে বয়োবৃদ্ধ এই মানুষটিকে নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে এটি মানতে পারছেন না তার সন্তানরা।
আব্দুল হক মিঞার বড় ছেলে শিল্পপতি নেজাম উদ্দিন বলেন, আমাদের ঘরের পুকুরের মাছ, গাছের ফল, গাভীর দুধসহ সব ক্রয়-বিক্রয় করতো এই জমির। জমিরের বেতন কোন নির্দিষ্টও ছিল না। তাছাড়া আমার বাবা তাকে (জমির) পাকা ঘর তৈরিও করে দিচ্ছেন। এমন পর্যায়ে বেতনের অজুহাতে আমার বাবাকে হত্যা করার কথা নয়। হত্যার অন্য কোন কারণ বা অন্য কেহ জড়িতও থাকতে পারে। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে সেখানে কাউকে আসামি করা হয়নি। তদন্তে যারাই জড়িত থাকার প্রমাণ আসবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনকে অনুরোধ জানিয়েছি।
কে এই জমির :
সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হক মিঞাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা বাড়ির কর্মচারী জমির উদ্দিনকে নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। তার বাড়ি অন্য উপজেলায় হলেও সে আব্দুল হক মিঞার বাড়িতে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে রয়েছে গৃহকর্মী হিসেবে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বাঁশখালী পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের জলদী খলিশা পাড়ার হাবিবুর রহমানের পুত্র জমির উদ্দিন অনেক ছোট বয়স থেকে আব্দুল মিঞার ঘরে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন ঐ বাড়িতে থাকার কারণে বাড়ির সকলের কাছে খুবই প্রিয় হয়ে উঠেন জমির। পুকুরের মাছ, গাছের ফল, গাভীর দুধ বিক্রি ও ঘরের নিত্য প্রয়োজনীয় বাজারাদি করার দায়িত্ব ছিল জমিরের। বাঁশখালীস্থ নিজ বাড়িতে একটি পাকা ঘর তৈরির কাজ শুরু করলে আব্দুল মিঞা তাকে নগদ টাকা, ইট ও কংক্রিটও সহায়তা করেন। এমন সুবিধায় থাকা একজন মানুষ তার গৃহকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে এটি আসলেই মেনে নেওয়া কষ্টকর বলে মন্তব্য করেছেন সচেতন মহল।