বেতন কম তাই পদত্যাগ করতে চান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী

51

কাজি রশিদ উদ্দিন

আজকের লেখার শুরুতে পাঠকদের জন্য কিছুটা ভিন্নতা প্রকাশ করার মানসে একটি বিশেষ খবর ও রসগল্প দিয়ে শুরু করে পরে মূল নিবন্ধে চলে যাব। প্রথমে বিশেষ খবরটি হলো ঢাকার একটি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার খবরটি এই রূপ ‘খবরটির শিরোনাম হলো- বেতন কম, পদত্যাগ করতে চান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী’ বিস্তারিত খবরটি হলো, বেতন কম হওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তাই তিনি আগামী বসন্তে পদত্যাগ করতে চান।
গত বছর জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার আগে বরিস জনসন বর্তমান উপার্জনের চেয়ে অনেক বেশি আয় করতেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার সহকর্মীদের কাছে এমন অভিযোগ করেছেন। তার দল কনজার্ভেটিভের কিছু এমপি এ তথ্য দিয়েছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বরিস জনসনের বার্ষিক আয় এক লাখ ৫০ হাজার ৪০২ পাউন্ড। অথচ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি পত্রিকায় কলাম লিখতেন। সেমিনারে বক্তব্য করতেন। এতে তিনি মাসে আয় করতেন ২৩ হাজার পাউন্ড। সে হিসাবে তার বার্ষিক আয় ছিল দুই লাখ ৭৬ হাজার পাউন্ড। বরিস জনসন কখনো এক মাসে দু’টি সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে আয় করেছিলেন এক লাখ ৬০ হাজার পাউন্ড।
তবে হোয়াইটহল সূত্র সংবাদমাধ্যমকে বলেছে, পদত্যাগের আগে আরো ছয় মাস অপেক্ষা করতে চান প্রধানমন্ত্রী। যাতে তিনি ব্রেসিট পুরোপুরি সম্পন্ন করতে পারেন এবং করোনা মহামারীর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি থেকে বৃটেনকে রক্ষা করতে পারেন। একজন এমপি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে তার ছয় সন্তানের জন্য বছরে খরচ দিতে হয় ৪২ হাজার ৫০০ পাউন্ড। এই খরচ নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি। অন্যদিকে বিবাহ বিচ্ছেদের চুক্তি অনুযায়ী সাবেক স্ত্রী মেরিনা হুইলারকে একটা বড় অংকের অর্থ দিতে হয়। সবমিলিয়ে ব্যক্তিগত আয় রোজগারের অর্থনৈতিক সমস্যায় আছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।
এবার অন্য একটি প্রসঙ্গ। লোহা কঠিন ধাতু। লোহাকে ঘায়েল করতে শুরু করে মরিচা। যথা সময়ে প্রতিরোধ না করলে সামান্য মরিচাই একসময় ঝরঝরে করে দিতে পারে কঠিন ধাতুকে। রাজনৈতিক দলের অঙ্গ-সংগঠন শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতোই অপরিহার্য। সতর্কতার অভাবে অঙ্গ-সংগঠনের কোনো কোনো অংশ মরিচার মতোই দলকে কাবু করে দিতে পারে। কর্মীদের আবদার ভেদ করে সাধারণ মানুষের আর্তনাদের শব্দ যখন কোনো সরকারের বা দলের কানে পৌঁছে না তখনই প্রশ্ন ওঠে সরকার বা দল তুমি কার ?
প্রবন্ধের শুরুতে রসগল্প উপস্থিত না করলে প্রবন্ধের আর্তনাদ ও পাঠকের কর্নকুহরে প্রবেশ করবেনা। প্রথম গল্পটি চাটুকার সম্পর্কে। একবার রাজা হবুচন্দ্র মন্ত্রী গবুচন্দ্রকে নিয়ে মফস্বলে গেলেন সাধারণ প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য। রাতে ঘুম যাওয়ার আগে ‘হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া’ শব্দ রাজার কানে প্রবেশ করে। কিসের শব্দ ? মন্ত্রীর কাছে জানতে চান রাজা। ‘ওরা শিয়াল। এখন শীতকাল, কাঁথা-কম্বল নেই। আপনার আগমন সংবাদ পেয়ে সমবেত হয়ে তাদের কষ্টের কথা প্রকাশ করছে।’ এই বলে রাজাকে বুঝালেন মন্ত্রী, মহানুভব রাজার রাজ্যে কেউ কষ্ট করবে, তা রাজা মানতে পারেন না। শিয়ালদের চাহিদামতো কম্বলের ব্যবস্থা করেছিলেন রাজা। পরের বছর একই কারণে এসে একই রকম ‘হুক্কা হুয়া’ শব্দ শুনে কারণ জানতে চান রাজা। ‘আপনার দেয়া কম্বল গায়ে দিয়ে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে বলে উত্তর দেন মন্ত্রী, শুনে রাজা মহাখুশি।
এবার মূল প্রসঙ্গ। দেখা যাচ্ছে প্রতারণার জাল ছড়িয়ে গেছে সারাদেশে। প্রতারকদের এমনই রমরমা অবস্থা হয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন কায়দায় প্রতারণা চলছে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। একেবারে উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে এটি এখন গেড়ে বসেছে। পুরো জাতি এদের খপ্পরে পড়ে আজ হাসফাঁস করছে। এর প্রতিকারের আশু আয়োজন করতে হবে। কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সাময়িক সামাল দেয়ার ব্যবস্থা অবশ্য হচ্ছে। কেবল সাহেদ-সাবরিনা এ ধরনের কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে হবে না। অবশ্য এদের বিরুদ্ধে নেওটাও প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়া প্রতারণার ঘটনা বন্ধ করতে হলে এর প্রকৃত পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এভাবে চলতে থাকলে জাতি হিসেবে যে আমরা অপমানিত হয়ে যাবো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সহযোগী একটি দৈনিকে চার দিকে শুধু প্রতারণা শিরোনামে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এদেশে সংঘটিত প্রতারণার আংশিক একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ওই পাঁচ বছরে এ সংক্রান্ত সাড়ে ১৩ হাজার ঘটনা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি পাঁচ হাজার ৩০০ জাল – জালিয়াত ও প্রতারণার মামলা তদন্ত করে। সিআইডি মেট্রো বিভাগ তিন হাজার ২০০ মামলা তদন্ত করেছে। পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে এর মধ্যে খাঁটি প্রতারণার মামলাই দুই হাজার ১০০টি। প্রতারণার ভাইরাস ঢোকেনি এমন কোনো সেক্টর এখন আর নেই মনে হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, বিদেশে লোক পাঠানো, জমি প্লট বিক্রি ও চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা খুবই সাধারণ ব্যাপার। এসব ব্যাপারে মানুষ প্রতারিত হবে সেটি এখন আর বিস্ময়ের কিছু নয়।
শিশু খাদ্য। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও মহামারী করোনা নিয়েও ভয়াবহ সব প্রতারণা এ দেশে হয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের মানুষেরা প্রতারকদের প্রধান টার্গেট। একটা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে মানুষের অর্থকড়ি তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন। অনেক সময় তাদের চক্করে পড়ে অনেকে ভিটেবাড়ি এমনকি জীবনও হারাচ্ছেন। ওই প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, গরিব মিসকিনরাও প্রতারকদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। রাজধানীর কাঠালবাগানে একটি কোন-অপারেটিভ সোসাইটি গড়ে প্রতারকরা হাতিয়ে নিয়েছে শত কোটি টাকা। এ কো-অপারেটিভে জমা দিয়েছেন পান দোকানদার, হকার, গৃহপরিচারিকা এই শ্রেণীর মানুষ। অনেকে সেখানে তাদের সারা জীবনের সঞ্চয় জমা করেছিলেন। প্রকাশ্যে তারা বেশ কয়েক বছর ধরে সমিতির কার্যক্রম চালায় প্রশাসনের সামনে। এক দিন হঠাৎ অফিস বন্ধ করে উধাও হয়ে গেল এই সমিতির কর্মকর্তারা। এভাবে চট্টগ্রাম সহ সারাদেশে অসংখ্য মানুষ আজ প্রতারিত, কিন্তু তাদের পক্ষ হয়ে এর প্রতিকার এনে দেবে এমন কাউকে আমরা সক্রিয় দেখতে পাচ্ছি না। বরং জাতীয় পর্যায়ে এই প্রতারনার আকারটা অনেক বড়। পিকে হালদার নামে একজনেই প্রতারণার মাধ্যমে মেরে দিয়েছেন ১০ হাজার কোটি টাকা।
বর্তমান সময়ে প্রতারণার এই মহামারীর মধ্যে আমরা বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রতারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। বরং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে অনেকে এ প্রতারকদের সাথে কাজ করতে বেশি আগ্রহী। সাহেদ ও সাবরিনারা পুরো জাতির সাথে প্রতারনা করেছেন। আমরা এও দেখলাম স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা তাদের সাথে মিলে কাজ করতে আগ্রহী ছিল। এ সুযোগে তারা সরকারি অর্থের হরিলুট করেছে। দেশের মানুষের সর্বনাশ করেছে। বিদেশে আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছে। তাই এ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন দরকার। তা হলেই কেবল এ দেশের মানুষ প্রতারণা থেকে রেহাই পাবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট