বেগম রোকেয়া আসলে বেঁচে নেই!

19

কামরুল হাসান বাদল

২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’-এর আয়োজন করে। বিষয় ছিলো-সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? সে জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় অনুষ্ঠান প্রচার করে সে বছরের ২৬ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। বিবিসির সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ ২০জন বাঙালির তালিকায় স্যার জগজিৎ চন্দ্র বসু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়ের মতো জগৎখ্যাত ব্যক্তিদের পেছনে ফেলে ষষ্ঠ স্থানে উঠে আসে বেগম রোকেয়ার নাম। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বাঙালি সমাজ যখন ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল, সেই সময় বেগম রোকেয়া বাংলার মুসলিম নারী সমাজে শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলেন। বাঙালি মুসলমান নারী জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম একজন পথিকৃৎ। ফলে বাঙালির আধুনিক যুগের ইতিহাসে সে নারীর নাম গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় । বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক জমিদার পরিবারে। মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর পরিবার ছিল খুবই রক্ষণশীল। সেসময় তাঁদের পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়ার কোনো প্রচলন ছিল না।
আর সেসময় ঘরের বাইরে গিয়ে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভেরও কোন সুযোগ ছিল না। তাঁদের পরিবারে কী ভয়াবহভাবে পর্দাপ্রথার প্রচলন ছিল তার একটি বিবরণ পাই তাঁরই লেখায়, ‘সে অনেকদিনের কথা। রংপুর জেলার অন্তর্গত পায়রাবন্দ নামক গ্রামের জমিদার বাড়িতে বেলা আন্দাজ ১টা-২টার সময় জমিদার কন্যাগণ জোহরের নামাজ পড়িবার জন্য ওজু করিতেছিলেন। সকলের ওজু শেষ হইয়াছে, কেবল ‘আ’ খাতুন নাম্নী সাহেবজাদী তখনও আাঙ্গিনায় ওজু করছিলেন। আলতার মা বদনা হাতে তাঁহাকে ওজুর পানি ঢালিয়া দিতেছিল। ঠিক সেই সময় এক মস্ত লম্বাচৌরা কাবুলী স্ত্রীলোক আঙ্গিনায় আসিয়া উপস্থিত। হা, হা, সে কি বিপদ! আলতার মা’র হাত হইতে বদনা পড়িয়া গেল- সে চেঁচাইতে লাগিল-‘আউ আউ! মরদটা কেন আইল।’ সে স্ত্রীলোকটি হাসিয়া বলিল, ‘হেঁ মরদানা। হাম মরদানা হায়।’ সেইটুকু শুনিয়াই ‘আ’ সাহেবজাদী প্রাণপণে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া তাঁহার চাচী আম্মার নিকট গিয়া হাঁফাইতে হাঁফাইতে ও কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, ‘চাচী আম্মা। পায়জামা পরা একটা মেয়ে মানুষ আসিয়াছে।’ কর্ত্রী সাহেবা ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সে তোমাকে দেখিয়াছে?’ ‘আ’ সরোদনে বলিলেন, ‘হা’। অপর মেয়েরা নামাজ ভাঙ্গিয়া শশব্যস্তভাবে দ্বারে অর্গল দিলেন-যাহাতে সে কাবুলী স্ত্রীলোকও কুমারী মেয়েদের দেখিতে না পায়। কেহ বাঘ ভালুকের ভয়েও বোধহয় অমন করিয়া কপাট বন্ধ করে না।’
-অবরোধ বাসিনী, (১) বেগম রোকেয়া। সঙ্গত কারণেই প্রথম জীবনে গোপনে বড় ভাইয়ের কাছে উর্দু ও বাংলা পড়তে শেখেন বেগম রোকেয়া। তাঁর বড় দুভাই কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে শিক্ষালাভ করেছিলেন। তাঁর বড় বোন করিমুন্নেসাও ছিলেন বিদ্যোৎসাহী। প্রাথমিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ গঠনে বড় দুভাই ও বোন তাঁর জীবনকে প্রভাবিত করলেও বেগম রোকেয়ার আসল লেখাপড়া শুরু হয়েছিল বিয়ের পর স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায়। যদিও শিশু বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাসের সময় তিনি লেখাপড়ার সামান্য সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু সমাজ ও আত্মীয়স্বজনের সমালোচনা ও বিরোধিতার কারণে তা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি, তবে ভাইবোনদের সমর্থন ও সহযোগিতায় তিনি অল্প বয়সেই আরবী, ফারসি, উর্দু ও বাংলা আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন।
অধিকাংশ নারীর জীবনে বিয়ে আরেকটি শৃঙ্খল হয়ে এলেও বেগম রোকেয়ার জীবনে ঘটেছিল উল্টোটি। বরং বিয়ে বা স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। বিহারের ভাগলপুরের অধিবাসী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন উর্দুভাষী। ছিলেন শিক্ষিত ও খুব উদার মনের মানুষ। বেগম রোকেয়া উর্দু কিছুটা আগেই শিখেছিলেন। বিয়ের পর সেই শিক্ষা তাঁর উর্দুভাষী স্বামীর সহায়তায় আরও প্রসার লাভ করে। শুধু তাই নয়, স্বামীর কাছ থেকে ইংরেজিতে খুব ভাল দক্ষতাও অর্জন করেন। তাই ইংরেজিতেও সাবলীলভাবে লিখতে পারতেন তিনি। তবে বাংলা ভাষার প্রতি ছিল গভীর দরদ। তাই বাংলাতেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও হয়েছিল স্বামীর অনুপ্রেরণায় ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গদ্য রচনার মধ্যে দিয়ে। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে প্রবন্ধ সংকলন ‘মতিচুর’ (২ খÐ), পদ্মরাগ, স্যাটায়ারধর্মী লেখা ‘সুলতানার স্বপ্ন’, এবং ‘অবরোধবাসিনী’ অন্যতম। তাঁর ‘সুলতানার স্বপ্ন’-কে বিশ্বের নারীবাদীতার চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করা হয়।
গত ২৬ এপ্রিল থেকে ১ মে পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট এবং একেবারে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ঘুরলাম। এই যাত্রায় আমি যাঁদের সফরসঙ্গী ছিলাম তাঁরা হলেন, প্রথম আলো চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক ওমর কায়সার, তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্না কায়সার, খ্যাতিমান আলোকচিত্রশিল্পী শোয়েব ফারুকী, সাংবাদিক-ভ্রমণলেখক এজাজ মাহমুদ এবং আমার স্ত্রী লেখক রোকসানা বন্যা।
তো রংপুর যাবো পায়রাবন্দ যাবো না তা কী করে হয়। বেগম রোকেয়ার নামের সঙ্গে পায়রাবন্দর যে মনের গভীরে প্রোথিত হয়েছিল। তাই ২৭ এপ্রিলের ভ্রমণতালিকায় শীর্ষে থাকল পায়রাবন্দ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
পায়রাবন্দে যখন পৌঁছালাম তখন দ্বিপ্রহরের কাছাকাছি। আগে থেকেই জানতাম সেখানে বর্তমান সরকারের আমলে ৩.১৫ একর ভূমির ওপর বাংলা একাডেমি গড়ে তুলেছে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র। তার সামনে গাড়ি থেকে নেমেই দেখলাম মুল গেটে তালা ঝুলছে। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। আমাদের আসার খবর পেয়ে প্রায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন কমপ্লেক্সের তত্ত¡াবধায়ক। তিনি তালা খুলে দেওয়ার পর আমরা পাঠাগারে ঢুকলাম। খুব যে বেশি বই আছে তা বলা যাবে না। তবে একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম, আমরা পাঠাগারে ঢুকতে ঢুকতে সাত-আটজনের একটি দল বইপত্র নিয়ে বসে গেল পড়তে। বোঝা গেল ব্যাপারটি বানোয়াট। শিশু-কিশোরের এই পাঠকরা আশেপাশেই থাকে, কোনো ভিজিটর গেলে তারা দ্রæত পাঠক সেজে বসে যায় টেবিলে। এটা তাদের সঙ্গে কথা বলেই বোঝা গেল। লক্ষণীয় ছিল এদের মধ্যে মেয়েশিশুরা বোরকা পরিহিত। পুরো কমপ্লেক্সটি ঘুরে ঘুরে দেখতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম একটি অডিটোরিয়ামও আছে এখানে। সেটি আমাদের খুলে দেখানো হয়নি। তবে বাইরের অবয়ব দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে, হলটি দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
কমপ্লেক্সের দুদিকে প্রচুর খালি জায়গা সেখানে বিভিন্ন জাতের ফুল ও ফলের গাছ আছে। আর আছে বেগম রোকেয়ার একটি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য। সেখানে আমরা ছবিও তুললাম।
কমপ্লেক্সের কাছেই রোকেয়ার জন্মভিটা। চারদিকে দেয়াল দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে বেগম রোকেয়ার পৈত্রিক ভিটার সামান্য নিদর্শন ছাড়া বাকিসব বিলীন হয়ে গেছে। বাড়ির মুল ফটকে ঢোকার মুখে হাতের ডানপাশে দেখলাম বেগম রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগার। সেখানে দেখা হলো রফিকুল ইসলামের সঙ্গে, যিনি নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন বেগম রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগার। রফিকের পাঠাগারে বেগম রোকেয়াকে নিয়ে দেশে বিদেশে যত বই, সংকলন, গবেষণা-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে সব সংগ্রহে আছে। তাঁর সঙ্গে কথাও হলো।
১৪৩ বছর আগে বেগম রোকেয়া যখন জন্ম নিয়েছিলেন তখন এই এলাকা নিশ্চয়ই এমন ছিল না। যোগাযোগ ব্যবস্থাও এতটা উন্নত ছিল না। কলকাতা ও ঢাকা থেকে (তখন পর্যন্ত অবশ্য ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ নগর হয়ে ওঠেনি) এতদূরে জন্ম নিয়ে, বেড়ে উঠে কীকরে তিনি এত অগ্রসর চিন্তার অধিকারী হলেন তা ভাবতেও বিস্ময় জাগে।
বেগম রোকেয়া মনে করতেন, ধর্ম গ্রন্থগুলো পুরুষের দ্বারা লিখিত। যা কিছু লেখা হয়েছে সবই নারীর বিপক্ষে। নীতি, প্রথা, দৃষ্টিভঙ্গি, আইন সর্বত্রই নারীর পক্ষে যে খুব কম কথা বলা হয়েছে সেটা তিনি তুলে ধরেছিলেন। পুরুষশাসিত সমাজের আচার অনাচার কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন বেগম রোকেয়া। মুসলিম মেয়েদের প্রগতির জন্য তিনি সারা জীবন কাজ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন মেয়েদের সাবলম্বী হওয়ার পথে, মুক্তির পথে শিক্ষার বিকাশই আসল রাস্তা।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কেতকী কুশারী ডাইসন সেসময় বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘বাংলার নবজাগরণের মত বড় একটা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছিলেন বেগম রোকেয়া, নারী মুক্তির বাস্তব পথ দেখাতে তাঁর অবদান ছিল বিশাল। তাঁর অর্জনের পেছনে ওই নবজাগরণ নি:সন্দেহে একটা বড় প্রেরণা ছিল। কিন্তু সে সময় আরও অনেকে হয়ত একইভাবে ভাবছিলেন, একই ধরনের কর্মে আত্মনিবেদন করেছিলেন। কিন্তু বেগম রোকেয়ার যে কাজটা সবার থেকে আলাদা হয়ে উঠেছিল তা হলো মেয়েদের শিক্ষার জন্য তাঁর সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা, যেটা ছিল নারী শিক্ষার পথে একটা মস্ত বড় অবদান।’
বক্ষমান লেখায় আমি উল্লেখ করেছি, কমপ্লেক্সের তত্ত¡াবধায়ক সেসময় উপস্থিত ছিলেন না। হঠাৎ করে কিছু শিশু-কিশোর পাঠক পাঠাগারে উপস্থিত হলো, মিলনায়তন প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। এসব বলেছি বটে তবে এরজন্য আমি সরকারি উদোগ, তত্ত¡াবধায়কের গাফিলতি কোনো কিছুকেই দায়ী করছি না। দায়ী যদি করতে হয় তাহলে ওই এলাকার মানুষকে করতে হয়। তারা যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসব সুবিধাকে কাজে লাগাতেন, তারা যদি বেগম রোকেয়ার মতো এমন এক ব্যক্তিকে ধারণ করতেন তাহলে এই কমপ্লেক্সের বেহাল হতো না। কাজেই অন্যের কাঁধে দায় তুলে দিয়ে একটি সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। আমি বলতে চাই, যে নারীদের শিক্ষা ও মুক্তির জন্য তিনি জাগরণ তৈরি করলেন তারা অর্থাৎ সে নারী সমাজই কি আজ বেগম রোকেয়াকে ধারণ করে? বরং দেখতে পাচ্ছি তারা স্বেচ্ছায় সে বন্দীত্ব, সে অন্ধকারকেই সাদরে বরণ করে নিচ্ছে। প্রায় দেড়শ বছর আগের সমাজব্যবস্থার কদর্যরূপ তিমি তুলে ধরেছিলেন, কীভাবে পর্দার নামে নারীদের প্রতি অমানবিক আচরণ করা হতো তা স্পষ্ট ও দ্যর্থহীন ভাষায় তুলে ধরেছিলেন। সে সময় পুরুষরা বাধ্য করতো নারীদের আর আজ অধিকাংশ নারীই যেন স্বইচ্ছায় সে পর্দা নামক অমানবিকতাকে সাদরে বরণ করে নিচ্ছে। বর্তমান সময়ে তাদের কর্মকাÐ দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হতেন স্বয়ং বেগম রোকেয়া। এখানে এসে তীব্রভাবে অনুভব করলাম বেগম রোকেয়া আসলে বেঁচে নেই!
এখন মন খুলে কথা বলার সুযোগ নেই। আমি বরং বেগম রোকেয়ার অবরোধ বাসিনী থেকে কয়েক ছত্র তুলে ধরলাম, যেখানে সে সময়ের নারীদের করুণ অবস্থা বিবৃত হয়েছে।
১। ইহাও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। পাটনায় এক বড় লোকের বাড়ীতে শুভবিবাহ উপলক্ষে অনেক নিমন্ত্রিত মহিলা আসিয়াছেন। অনেকে সন্ধ্যার সময়ও আসিয়াছেন। তন্মধ্যে হাসমত বেগম একজন। দাসী আসিয়া প্রত্যেক পাল্কীর দ্বার খুলিয়া বেগম সাহেবাদের হাত ধরিয়া নাৃাইয়া লইয়া যাইতেছে, পরে বেহারাগণ খালি পাল্কী সরাইয়া লইতেছে এবং অপর নিমন্ত্রিতার পাল্কী আসিতেছে। বেহারা ডাকিল- “” মামা! সাওয়ারী আয়া!” মামারা মন্থর গমনে আসিতেছে। মামা যতক্ষণে হাসমত বেগমের পাল্কীর নিকট আসিবে ততক্ষণে বেহারাগঙ সওয়ারী নামিয়াছে ভাবিয়া পাল্কী লইয়া সরিয়া পড়িল। অতঃপর আর একটি পাল্কী আসিলে মামারা দ্বার খুলিয়া যথাক্রমে নিমন্ত্রিতাকে লইয়া গেল।
শীতকাল। যত পাল্কী আসিয়াছে ‘সওয়ারী’ নামিলে পর সব খালি পাল্কী এক প্রান্তে বট গাছের তলায় জড় করিয়া রাখিয়া দেওয়া হইয়াছে। অদূরে বেহারাগণ ঘটা করিয়া রান্না করিতেছে। তাহারা বিবাহ বাড়ী হইতে জমকালো সিধা পাইয়াছে। রাত্রিকালে আর সওয়ারী খাটিতে হইবে না। সুতরাং তাহাদের ভারী স্ফূর্তি- কেহ গান গায়, কেহ তামাক টানে, কেহ খেইনি খায়- এইরূপে আমোদ করিয়া খাওয়া-দাওয়া করিতে রাত্রি ২টা বাজিয়া গেল।
এদিকে মহিলা মহেল নিমন্ত্রিতাগণ খাইতে বসিলে দেখা গেল-হাসমত বেগম তাহার ছয় মাসের শিশুসহ অনুপস্থিত। কেহ বলিল, ছেলে ছোট বলিয়া হয়ত আসিলপন না। কেহ বলিল, তাঁহাকে আসবার জন্য প্রস্তুত হইতে দেখিয়াছে-ইত্যাদি।
পরদিন সকালবেলা যথাক্রমে নিমন্ত্রিতাগণ বিদায় লইতে লাগিলেন-একে একে খালি পাল্কী আসিয়া নিজ নিজ ‘সওয়ারি’লইয়া যাইতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে একটি ‘খালি’ পাল্কী আসিয়া দাঁড়াইলে তাহার দ্বার খুলিয়া দেখা গেল হাসমত বেগম শিশু পুত্রকে কোলে লইয়া বসিয়া আছেন। পৌষ মাসের দীর্ঘ রজনী তিনি ঐ ভাবে পাল্কীতে বসিয়া কাটাইয়াছেন।
তিনি পাল্কী হইতে নামিবার পূর্বই বেহারাগণ পাল্কী ফিরাইয়া লইয়া গেল-কিন্তু তিনি নিজেনত শব্দ করেনই নাই-পাচে তাঁহার কণ্ঠস্বর বেহারা শুনিতে পায়, শিশুকেও প্রাণপণ যতেœ কাঁদিতে দেন নাই-যদি তাহার কান্না শুনিয়া কেহ পাল্কীর দ্বার খুলিয়া দেখে। কষ্ট সহ্য করিতে না পারিলে আর অবোধ বাসিনীর বাহাদুরী কি?
২। প্রায় ২১/২২ বৎসর পূর্বেকার ঘটনা। আমার দূরসম্পর্কীয়া এক মামীশাশুড়ী ভাগলপুর হইতে পাটনা যাইতেছিলেন; সঙ্গে মাত্র একজন পরিচারিকা ছিল। কিউল স্টেশনে ট্রেন বদল করিতে হয়। মামানি সাহেব অপর ট্রেনে উঠিবার সময় তাঁহার প্রকাÐ বোরকায় জড়াইয়া ট্রেন ও প্লাটফর্মের মাঝখানে পড়িয়া গেলেন। স্টেশনে সে সময় মামানীর চাকরানী ছাড়া অপর কোনো স্ত্রীলোক ছিল না। কুলিরা তাড়াতাড়ি তাঁহাকে ধরিয়া তুলিতে অগ্রসর হওয়ায় চাকরানী দোহাই দিয়া নিষেধ করিল -”খবরদার কেহ বিবি সাহেবার গায়ে হাত দিও না”। সে একাই অনেক টানাটানি করিয়া কিছুতেই তাঁহাকে তুলিতে পারিল না। প্রায় আধঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর ট্রেন ছাড়িয়া দিল।
ট্রেনের সংঘর্ষে মামানী সাহেব পিষিয়া ছিন্নভিন্ন হইয়া গেলেন, – কোথায় তাঁহার বোরকা- আর কোথায় তিনি। স্টেশনে ভরা লোক সবিস্ময়ে দাঁড়াইয়া এই লোমহর্ষণ ব্যাপার দেখিল- কেহ তাঁহার সাহায্য করিতে অনুমতি পাইল না। পরে তাঁহার চূর্ণপ্রায় দেহ একটা গুদামে রাখা হইল; তাঁহার চাকরানী প্রাণপণে বিনাইয়া কাঁদিল আর তাঁহাকে বাতাস করিতে থাকিল। এই অবস্থায় ১১ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি দেহত্যাগ করিলেন। কি ভীষণ মৃত্যু!
৩। প্রায় ১০/১১ বৎসরের ঘটনা। বলিয়াছি ত বেহার অঞ্চলে বিবাহের তিন মাস পূর্বে ‘মাইয়া খানায়’ বন্দী করিয়া মেয়েদের আধমরা করা হয়। ও কখনও ঐ বন্দীশালায় বসিবার মেয়াদ-যদি বাড়ীতে কোনো দুর্ঘটনা হইয়া বাহের তারিখ পিছাইয়া যায় তবে বৎসর কালও হয়; এক বেচারী সেইরূপ ছয় মাস পর্যন্ত বন্দিনী ছিল। তার স্নান, আহার প্রভৃতির বিষয়েও যথাবিধি যতœ লওয়া হইত না। একেই ত বিহারী লোকেরা সহজে স্নান করতে চায় না, তাহাতে আমার ‘মাইয়া খানার’ বন্দিনী মেয়েকে কে ঘন ঘন স্নান করাইবে? ঐ সময় মেয়ে মাটিতে পা রাখে না। প্রয়োজনমতো তাহাকে কোলে করিয়া স্নানাগারে লইয়া যাওয়া হয়। তাহার নড়াচড়া সম্পূর্ণ নিষেধ। সমস্ত দিন মাথা গুঁজিয়া একটা খাটিয়ার উপর বসিয়া থাকিতে হয়, রাত্রিকালে সেইখানেই শুইতে হয়। অপরে মুখে তুলিয়া গ্রাস খাওয়ায়, অপরে ‘অবখোরা’ ধরিয়া পানি খাওয়াইয়া দেয়। মাথার চুলে জটা হয়; হউক-সে নিজে মাথা আঁচড়াইতে পারিবে না। ফল কথা, প্রত্যেক বিষয়ের জন্য তাহাকে পরের মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতে হয়। যাহা হউক, ছয় মাস অন্তর সেই মেয়েটির বওবাজ হইলে দেখা গেল, সর্বদা চক্ষু বুজিয়া থাকার ফলে তাজার চক্ষু দুইটি চিরতরে নষ্ট হইয়া গিয়াছে।

আমরা কি সে সময়ের কাছেই ফিরে যাচ্ছি?
আমার প্রশ্ন।

লেখক : সাংবাদিক