বেকার সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি

93

 

বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতি ও জনবহুল দেশ। সংখ্যাও ভয়াবহ। কারণ আমাদের দেশে পর্যাপ্ত শিল্প-কলকারখানা নেই। শিক্ষিত-অশিক্ষিত-বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থান ও চাকরির তেমন সুযোগ-সুবিধাও নেই। ফলে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। পক্ষ – বিপক্ষ যে যেই ভাষাতেই কথা বলুক না কেন বর্তমান দেশে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সংকট রয়েছে। কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়া মানেই বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া। আর আমাদের দেশের বেকারের সংখ্যা কয়েক লাখ। ১৮ কোটি মানুষের দেশে বেকার জনগোষ্ঠী এ সংখ্যাটি দেশের উন্নয়নের অন্তরায়। আর বেকারত্ব জীবন যুবকদের কাছে একটি অভিশাপ। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের প্রতিটি পরিবারের কর্তাব্যক্তি মনে করে তাদের সন্তানরা লেখাপড়া শিখে একটি ভালো চাকরি পেয়ে বাকি জীবনটা আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দেবে। তাদের ধারণা যে অমূলক তা নয়। যদিও শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ভিন্ন; কিন্তু আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত তরুণ অর্থ উপার্জনে একটি ভালো পথ খুঁজে না পেলে অধিকাংশ পরিবারে নেমে আসে চরম হতাশা ও অর্থনৈতিক দৈন্যদশা।
আবার লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে কোনো চাকরি পাওয়া সব পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। অথচ দেশের মোট জনসংখ্যার বেশির ভাগ মানুষই গ্রামে বাস করে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তিলাভের আশায় বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রমিক-পেশাজীবীরা বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত। তাছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াতেও বহু তরুণ, যুবক নানা পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। এসব দেশগুলোতে শিক্ষিত তরুণরা যেমন রয়েছে তেমনি অল্প শিক্ষিতও আছে। আর দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থ যাকে রেমিট্যান্স বলি। এ বৈদেশিক অর্থ দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আবার কেউ কেউ উন্নত জীবনের আশায় অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে করুণভাবে মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের দেশে এর অনেক নজির রয়েছে। অতি স¤প্রতি (২৩ এপ্রিল) বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির পূর্ব উপক‚ল থেকে ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়ার সময় পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশিকে আটক করে দেশটির পুলিশ। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি পূর্ব উপক‚ল থেকে ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়ার সময় পুলিশের হাতে আটক পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশিকে সরকার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়- বড় কথা হচ্ছে, অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার মনোবৃত্তি জীবনের স্বার্থে পরিত্যাগ করা দরকার। তাই আমাদের এই পথ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ যে কোনো অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি রয়েছে এমনকি প্রাণহানীর আশঙ্কা তো আছেই। অভিবাসীদের অন্য রাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে মানব পাচারকারীরা খুবই কৌশলী ও শক্তিধর।
অবৈধভাবে বিদেশ যেতে প্রতি বছরই নৌকা কিংবা ট্রলার ডুবে শত শত বাংলাদেশির সলিল সমাধি ঘটছে। কখনো বা অভিবাসী আটক হওয়ার পর দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নানা উদ্যোগে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। স¤প্রতি আটক হওয়া বাংলাদেশিদের সরকার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। তাই আমরা মনে করি এটা সরকারের একটি বাড়তি ঝামেলা। বিদেশ গমণেচ্ছুদের প্রতি অনুরোধ অবৈধ বা অভিবাসী হিসেবে বিদেশ থেকে বিরত থাকায় শ্রেয়।
বাংলাদেশের বেকারত্ব সমস্যা প্রতিকারে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণের জন্য কতৃপক্ষ আমলে নিতে পারেন। যেমন : ১) যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। অধিক জনসংখ্যাকে দেশের বোঝা নয়, সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে ২) বৃত্তিমূলক, কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি করতে হবে। নারী শিক্ষার স¤প্রসারণে যথাযথ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ৩) ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ৪) কোনো কাজকেই তুচ্ছ না ভেবে কায়িক পরিশ্রমের মর্যাদা দিতে হবে। ৫) পরিকল্পিত শিল্পকারখানা গড়ে তুলে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ৬) আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ শ্রমশক্তি গড়তে তুলতে হবে। ৭) ভাষাগত দুর্বলতা দেশি-বিদেশি শ্রমবাজারে কর্মসংস্থ্না প্রাপ্তিতে একটি বড় সমস্যা। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শ্রমিকদের ভাষাগত দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে হবে। ৮) কর্মক্ষম শ্রমিকদের বিদেশে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে ৯) শিক্ষিত যুবসমাজকে গ্রামমুখী করতে হবে। ১০) তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেটে আউটসোর্সিং হতে পারে বেকারত্ব হ্রাসের আরেকটি উপায়। আমাদের দেশে বেকারত্বের মূল কারণ অদক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা, স্বজনপ্রীতি, মানসিকতা পরিবর্তনের অভাব, অতিরিক্ত আত্মসম্মানবোধ, পুঁজির অভাব। বেকারত্বের ভয়াবহ অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে সমগ্র জাতিকেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলীয়করণের মনোবৃত্তি পরিহার করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মে নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বেকারত্ব থেকে উত্তরণের জন্য সরকার কতৃক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে, পাশাপাশি সর্বমহলে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এটা হোক সর্বস্তরের প্রত্যাশা।
লেখক: প্রাবন্ধিক