বেকারত্ব : করোনা বিধ্বস্তে আরেক আতঙ্ক

55

রাইসুল উদ্দিন সৈকত

করোনা যত বড় না রোগ তার চেয়েও বড় সমস্যায় আমরা সামনের দিনগুলোতে নিশ্চিত মোকাবিলা করতে যাচ্ছি! হাজারো রোগের সঙ্গে লড়াই করে মানুষ দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করে আসছে। করোনা শুধু মানুষকে অসুস্থ করছে বা মেরে ফেলছে না, পৃথিবীর অর্থনীতিকেই ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হয়েছে। গরিব মানুষকে অনাহারে মারার ব্যবস্থা করেছে। সকলের চেনা পৃথিবী হঠাৎ অচেনা হয়ে উঠেছে সামান্য সময়ের ভিতরে। এই প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস হানা দেয়ার পর থেকেই দেশের কর্মসংস্থান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। কর্মহীন বেকার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প বিশেষ করে গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনের আওতা বৃদ্ধি করা জরুরী। শুধু বাংলাদেশ নয়, করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যতিব্যস্ত সারাবিশ্ব। এই পরিস্থিতি যদি দ্রæত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসে তবে বিশ্ব অর্থনীতি আরও বড় বিপদের সম্মুখীন হবে। অর্থনীতির একটি দিক চাকরির বাজার, যা অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করতে পারে। তবে করোনার কারণে এই দিকের টালমাটাল অবস্থা। করোনার কারণে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো দেশেও বেকারত্বের ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সেই ঢেউ এসে লাগছে এশিয়ার দেশগুলোতেও। মধ্যপ্রাচ্যে ইতোমধ্যে অনেক বাংলাদেশি কর্মহীন হয়ে পড়েছে। মালদ্বীপেও একই সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনায় ক্রমবর্ধমান হারে মানুষই কেবল মরছে এমনটা নয়। সেই সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতিকে দমিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে অর্থনীতি যে মন্দার সম্মুখীন তা অতীতে যেকোনো মহামন্দাকে ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর তাই অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব কীভাবে মোকাবিলা করা যায় সেটা এখন ভাবার বিষয়। তার সঙ্গে ভাবতে হবে করোনাপরবর্তী অর্থনীতি পুনর্গঠন নিয়েও। ভয়াবহ এই করোনার কারণে দেশ তথা সারা বিশ্বে বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। বিশ্বে দৈনিক করোনার ছোবলে প্রাণ হারাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। চীনের অবস্থা সব থেকে বেশি ভয়াবহ ছিল। তবে সেই ঝুঁকি চীন কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।
সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে মানুষকে ঘরে থাকতে বলায় থমকে গেছে যানবাহন ও কল-কারখানার চাকা। সেই সঙ্গে থেমে গেছে অর্থনীতিও। এ অবস্থায় দেশে দেশে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে কোটি কোটি মানুষ।
করোরা ভাইরাসটির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি, কলকারখানা বন্ধ থাকা এবং সর্বোপরি ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির থাকায় দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। অবশ্য করোনায় অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটাতে সরকারি ভাবে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কর্মসংস্থানে উৎপাদনশীল খাত চালু করা, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনসহ বেশকিছু পদক্ষেপ। এসব কর্মহীন মানুষকে দ্রæত কাজে ফিরিয়ে আনতে উৎপাদনমুখী বৃহৎ ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতের জন্য ৫২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গ্রামীণ আত্মকর্মসংস্থানে চলতি বাজেটে পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রমের জন্য ১০০ কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক কর্মসংস্থানের দিকে নজর রাখছে সরকার। একই সঙ্গে তৈরি পোশাকসহ রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতনভাতা প্রদানের লক্ষ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার এবং কুটির শিল্পসহ এসএমই প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার দুটি আলাদা স্বল্প সুদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের ঋণ সুবিধা চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রবর্তিত ইডিএফ-এর পরিমাণ বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার হতে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা এবং ঋণের সুদের হার কমানো হয়েছে। পাশাপাশি প্রিশিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণ সুবিধা চালু করা হয়। এছাড়া কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট উৎপাদন এবং সেবা, ক্ষুদ্র ব্যবসা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রভৃতি খাতে গ্রামের দরিদ্র কৃষক, বিদেশফেরত প্রবাসী শ্রমিক এবং প্রশিক্ষিত তরুণ ও বেকার যুবকদের গ্রামীণ এলাকায় ব্যবসা ও আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজে স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম স¤প্রসারণ করা হবে। এ কাজে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক এবং পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সরকার এ লক্ষ্যে ৫০০ কোটি টাকা করে মূলধন প্রদান করবে, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো সুনির্দিষ্ট প্রোগ্রামের আওতায় উপযুক্ত উদ্যোক্তাদের নিকট স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করবে। এসবের পাশাপাশি শিল্প খাতে কর্মসৃজনের গতি বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশ আধুনিকায়ন, শ্রমিকের সুরক্ষা জোরদার করা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধটা আরও ভালোভাবে চালানোর পক্ষেই সহায়ক হবে এই পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় শক্তি হলো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, যার দশা এখন ঠেলাগাড়ির ন্যায়।
কর্মসংস্থানের একটি বিশাল অংশ পোশাক শিল্পকে ঘিরে। বাংলাদেশে রফতানি পণ্যের অন্যতম পোশাক। ইউরোপ ও আমেরিকার করোনার প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প রফতানি কার্যক্রমও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আওয়াজ উঠেছে। যদিও সরকার পোশাক শিল্প মালিকদের জন্য প্রনোদনা ঘোষণা করেছে। কিন্তু তারপরও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কার্যক্রম থেমে নেই। আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, কর্মী ছাঁটাই স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ, যা অর্থনীতির ক্ষেত্রে বড় বাধা।
আমি মনে করি, বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। মানে, দেশটি উন্নত দুনিয়ার সমগোত্রীয় নয়। সেই স্তরে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছে। মনে রাখতে হবে, দেশে বেকারের সংখ্যা অগনিত। কমছে না। প্রতিদিনই বাড?ছে। কাজের সুযোগ বৃদ্ধির উপায় কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য এবং পরিষেবা ক্ষেত্রের পরিধি বাড়ানো দরকার। কারণ করোনা-জয়ের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের বিপর্যয়ও কাটিয়ে উঠুক প্রিয় বাংলাদেশ।

লেখক : চেয়ারম্যান, এলবিয়ন গ্রæপ