বৃহত্তম ‘জল্লাদখানার’ জমি পুনরুদ্ধারে অনীহা কেন?

29

তুষার দেব

চট্টগ্রামে একাত্তরের বৃহত্তম ‘জল্লাদখানা’ হিসেবে পরিচিত পাহাড়তলী বধ্যভূমির বেহাত হয়ে যাওয়া জমি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সকলেই। তবে ওই এলাকায় খাসজমি ছাড়াও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিও রয়েছে। এ কারণে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে জমি পুনরুদ্ধারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এক ধরনের অনীহা রয়েছে। তাই সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল সরকারে থাকার পরও থমকে আছে পাহাড়তলী বধ্যভ‚মি স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণযজ্ঞ। অপরদিকে পাহাড়তলী বধ্যভূমি কমপ্লেক্স বাস্তবায়ন পরিষদের আন্দোলনের কর্মসূচিও দৃশ্যমান হয় কেবল বিশেষ সময়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, স্বাধীনতা কিংবা বিজয়ের মাসে পাহাড়তলী বধ্যভূমি কমপ্লেক্স বাস্তবায়ন পরিষদের বিভিন্ন কর্মসূচি চোখে পড়লেও বছরের অন্য সময়ে তাদের তৎপরতা আর সেভাবে পরিলক্ষিত হয় না। বিগত ২০২১ সালে লাগাতার আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হলেও সে পথে হাঁটা হয়নি। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে ফের নতুন করে জোরালো হচ্ছে পাহাড়তলী বধ্যভূমি কমপ্লেক্স বাস্তবায়ন পরিষদের আন্দোলন। সর্বশেষ গত ২৮ মার্চ সংগঠনের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া গত কয়েক মাসে বধ্যভূমি এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত প্রতিবাদী সমাবেশে হাজির হয়ে পরিষদের দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছেন সিটি মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী এবং জেলা পরিষদের চেয়ারমান এটিএম পেয়ারুল ইসলামসহ অনেকে।
জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেছেন, চট্টগ্রামের সব বধ্যভূমিই সংরক্ষণ করা হবে। এ ব্যাপারে কাজ শুরু করা হয়েছে। পাহাড়তলীতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী বধ্যভূমি কমপ্লেক্সও বাস্তবায়ন করা হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
মুক্তিযোদ্ধাসহ শহীদ পরিবারগুলোর অভিযোগ- দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ সত্বেও একাত্তরে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ নিরীহ বাঙালিদের নৃশংস হত্যাকান্ডের স্মৃতিবিজড়িত পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণের গরজবোধ করছে না কেউই। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার পরও বধ্যভূমি সংরক্ষণে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনীহা বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণের মানুষের মধ্যে নিদারুণ অস্বস্তি তৈরি করেছে। বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পাহাড়তলীর জাকির হোসেন রোডে পৌনে দুই একর ভূমিতে অবস্থিত বধ্যভূমি সংরক্ষণে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ জন্য প্রকল্প প্রণয়ন করে ৯৪ লাখ টাকা বরাদ্দও দেয়া হয়েছিল। পরে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীনর চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে প্রকল্পটি বাতিল করে টাকা ফিরিয়ে নেয়। আর তখন জমিটি কিনে নেয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি) কতৃর্পক্ষ। জমি কেনার পর ইউএসটিসি কর্তৃপক্ষ সেখানে ভবন নির্মাণ শুরু করে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক গাজী সালেহউদ্দিন, মিলি রহমানসহ আট বিশিষ্ট নাগরিক হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট রিটটি নিষ্পত্তি করে দিলে আবেদনকারীরা আপিল বিভাগে যান। আপিল বিভাগ ওই জমিতে বধ্যভূমি রয়েছে কি না, তা জানতে একটি কমিটি গঠন করে দেন। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম শফিউল্লার নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন। ওই প্রতিবেদন ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য বিবেচনায় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের আদেশ দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো জেলা প্রশাসকই এই বধ্যভূমি সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ নেননি বলে অভিযোগ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারগুলোর। বর্তমানে বধ্যভূমি এলাকায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। সেটিও ধুলায় ধুসর ও মলিন হয়ে আছে। ঘাস, আগাছা, ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে চারপাশ। মূল বধ্যভূমি যেখানে, সেখানে ইউএসটিসির ইস্পাতের তৈরি একটি অর্ধনির্মিত ভবন দাঁড়িয়ে আছে।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, আদালতের নির্দেশনার পরও কেবলমাত্র প্রশাসনিক উদ্যোগের অভাবে পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরও বেহাত হয়ে যাওয়া বধ্যভূমির জমি পুনরুদ্ধারে কারও কোনো নড়াচড়া নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, রায়েরবাজারের পর দেশের বৃহত্তম পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণে কেউই কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। স্বাধীনতার মাসে আমরা জেলা প্রশাসকের সাথে সাক্ষাত করে স্মারকলিপি দিয়েছি। তিনি আমাদের কথা যেমন শুনেছেন, তেমনি টেলিফোনে প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় কথা বলে এ ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন। তিনি সকলকে সাথে নিয়ে বধ্যভূমি কমপ্লেক্স বাস্তবায়নে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে এই বধ্যভূমিতে অন্তত পাঁচ হাজার নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। একাত্তরের ১০ নভেম্বর প্রয়াত অধ্যাপক ড. গাজী সালেহউদ্দিনের বাবা রেলওয়ের কর্মকর্তা আলী করিমসহ একই পরিবারের চারজনকে এখানে এনে হত্যা করা হয়েছিল। একই দিন পাঁচ হাজার নিরীহ বাঙালিকে ধরে এনে এখানে জবাই করা হয়েছিল বলে আদালতের শুনানিতে বিভিন্ন সাক্ষীর বক্তব্যে উঠে আসে। বধ্যভ‚মিটি যাতে সংরক্ষণ করা হয়, সে জন্য আইনি লড়াই করতে হয়েছিল। আইনি লড়াই অনেক আগে শেষ হলেও অবসান হয়নি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার। যার কারণে এখনও অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে একাত্তরে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ‘জল্লাদখানা’খ্যাত এই বধ্যভূমি।