বৃষ্টি নামতেই পাহাড়ে মৃত্যুভয়

37

রাহুল দাশ নয়ন

চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধ বসতি আছে। এরমধ্যে ২০১৮ সালের সর্বশেষ তালিকায় ১৭টি পাহাড়কে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে সেখানে ৮৩৫টি পরিবার থাকার তথ্য তুলে ধরা হয়। যেখানে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাস করছে ৫৩১ পরিবার ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাত পাহাড়ে বসবাস করছে ৩০৪ পরিবার। চার বছর আগে প্রস্তুতকৃত সেই তালিকা ধরেই এতদিন উচ্ছেদ কার্যক্রম চালিয়েছে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। এবার সেই তালিকা নতুনভাবে করতে নির্ধারিত সময় বেঁধে দিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
গত ২৭ মার্চ পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৩তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গত ১৫ এপ্রিলের মধ্যে পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীর তালিকা পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু দেড় মাসেও সেই তালিকা জমা দিতে পারেনি পাহাড় মালিকপক্ষগুলো। একইভাবে পাহাড়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ কোনো সংযোগ আছে কিনা সেই তথ্যও দিতে পারেনি তিন সেবাসংস্থা।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব মো. নাজমুল আহসান পূর্বদেশকে বলেন, আমরা পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সর্বশেষ সভায় ঈদের পরেই উচ্ছেদ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী সম্পর্কে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও কোনো সংস্থাই তা দেয়নি। একইভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার সিদ্ধান্ত দেয়া হলেও তাও কেউ দেয়নি। কোনো দপ্তরই টাকা খরচ করতে চায় না। অথচ পাহাড় বাঁচানোর দায়িত্ব সবার। বারবার চিঠি দেয়ার পরেও কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। বেসরকারি সংস্থার পাহাড়গুলোতে যত চাপাচাপি করা যায় সরকারি সংস্থার পাহাড়ে অনেক নিয়মনীতি মেনেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’
জানা যায়, ২২তম সভার সিদ্ধান্তমতে সকল দপ্তরকে নতুন তালিকা জমা দিতে নির্দেশনা দিয়েছিল পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ তালিকা জমা দিলেও অন্য কোনো সংস্থা তালিকা জমা দেয়নি। যে কারণে গত সভাতেও অবৈধ বসবাসকারীর ডাটা বেইজ জমা দিতে পুনরায় নির্দেশনা দেয়া হয়। গত ১৫ এপ্রিলের মধ্যে এ তালিকা জমা দিতে বলা হলেও সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরই তা দেয়নি। একইভাবে বিদ্যুৎ বিভাগ, চট্টগ্রাম ওয়াসা এবং কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডকে পাহাড়ে কোনো অবৈধ সংযোগ আছে কিনা এবং সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে কিনা তার প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। পাশাপাশি অবৈধ সংযোগ থাকলে ১৫ দিনের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করতে নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু এ নির্দেশনার দেড় মাসেও কোনোরূপ বাস্তবায়ন হয়নি। একদিকে পাহাড়ে অবৈধ বসতি অপসারণ হলেও অন্যদিকে অবৈধ বসতি বেড়েই চলেছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযান চালানো নিয়মিত প্রক্রিয়া। আমরা পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের তালিকা তৈরি করছি। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক তালিকা তৈরির কাজ চলছে। আমাদের লোকবল কম থাকায় কিছুটা সময় নিতে হচ্ছে।’
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত বছরের ২৪ থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসরত ২৫০টি পরিবারকে অপসারণ করা হয়। এর আগে গত ১৪ জুন থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত বায়েজিদ লিংক রোড, আকবরশাহ পাহাড় ও একে খান পাহাড় থেকে ৪২৩টি পরিবারকে অপসারণ করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি অবৈধ বসতি আছে মতিঝর্ণা ও বাটালী হিল পাহাড়ে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের আগে এই দুই পাহাড় ঘিরেই বড়ধরনের উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো হয়।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সর্বশেষ সভায় চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমের পূর্বেই পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের অপসারণ করা প্রয়োজন। অবৈধভাবে বসবাসকারীদের অপসারণের বিষয়ে পূর্বে গঠিত সাব-কমিটি এ বছরেও কাজ করবে।’
এদিকে গতকাল বৃষ্টিপাত শুরুর পরপরই পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিতে বসবাসকারী মানুষগুলোর মধ্যে আতঙ্ক বাড়তে থাকে। যদিও মৃত্যুভয় থাকলেও পাহাড় ছেড়ে কোনো পরিবার সরেনি। নগরীর ছয়জন সার্কেল এসিল্যান্ড পাহাড়গুলোর উপর নজরদারি বাড়িয়েছেন। কোনো কোনো জায়গায় উচ্ছেদও শুরু করেছেন। গত বছর উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে সরিয়ে দেয়া অনেক পরিবার পুনরায় পাহাড়ে ফিরে গেছে।
মতিঝর্ণা এলাকায় বসবাসকারী রিকশাচালক আব্দুল জব্বার বলেন, ‘সারাদিন পরিশ্রম করে যে টাকা আয় করি তা দিয়ে ভালো জায়গায় থাকা যাবে না। যে কারণে মৃত্যুভয় থাকলেও পাহাড়েই কম ভাড়ায় পরিবার নিয়ে বসবাস করছি। বেশি বৃষ্টি হলে সরে যাই। বৃষ্টি কমলে পরে ফিরে আসি।’