বুলবুলকে ভুলে যাচ্ছে জাতি ?

24

 

২২ জানুয়ারি ছিল বহুমাত্রিক প্রতিভার সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের চতুর্থ মৃত্যুদিবস। ২০১৯ সালের এইদিনে হার্ট অ্যটাকে মৃত্যুবরণ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা, সুরকার, গীতিকার, ও সঙ্গীত পরিচালক। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই আমরা ভুলতে বসেছি এই মহান শিল্পীকে। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের পর যে গানটি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বাজানো হয় আমাদের বেতার, টিভি, মঞ্চে ও যেকোনো অনুষ্ঠানে তা হলো, ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না, ওরা আসবে চুপি চুপিৃ’। অন্তত তিন দশক ধরে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংবাদের সূচনাসঙ্গীত হিসেবে এই গানটির স্থায়ীর একটি অংশ বাজানো হয়। এই অমর গানটির সুর করেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। অনেকে মনে করেন এই গানের পর যদি তিনি আর কোনো গানের সুর না-ই করতেন তবুও এই গানটিই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতো বাংলার সঙ্গীতাঙ্গনে। সেই অমর গানসহ বাংলার প্রচুর জনপ্রিয় ও হৃদয়স্পর্শী গানের রচয়িতা ও সুরকার, বাংলা গানের বুলবুল, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল শুধু বাংলাদেশের নন এই উপমহাদেশের একজন বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ। আরেক অকাল প্রয়াত গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা এই গানটিতে সুর দিয়েছিলেন বুলবুল। আর এই কালজয়ী গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন। বুলবুলের মৃত্যুতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিখ্যাত এই শিল্পী বলেছিলেন, ‘নজরুল ইসলাম বাবুকে গানটি লেখার ধারণা দিয়েছিলেন বুলবুল। বাবুও কিছু ধারণা যোগ করে নিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান জানিয়ে গানটি লেখা হয়েছিল। প্রথমবার গানটির সুরে কেঁদে ফেলেছিলেন বলে জানালেন তিনি। আমি তো শুনে অবাক হয়ে গেছি। এও কী সম্ভব! বুলবুলকে বললাম, সুরটা তুমি এরকমভাবে কী করে এতো সুন্দরভাবে বসালে? আমি প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম। তারপর বাকিটা তো ইতিহাস।” সুরকার, গীতিকার, সংগীত পরিচালক, মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে আরও কয়েকটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন; বুলবুলের সুরে কণ্ঠে গান তুলেই পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। বাংলা সংগীতের অন্যতম প্রভাবশালী এ সুরকার-কণ্ঠশিল্পী জুটির আবির্ভাব গত শতকের আশির দশকে। সাবিনা ইয়াসমিন তখন দারুণ জনপ্রিয় আর ব্যস্ত শিল্পী। বিপরীতে বুলবুল সংগীতে নতুন; পায়ের নিচে শক্ত মাটি খুঁজছেন। মাঝে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ নামে চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করে নিজের হাত পাকিয়েছেন। বুলবুল তার একটি গান করার জন্য সাবিনা ইয়াসমিনকে বেশ কয়েকবার বলেছিলেন। কিন্তু সাবিনা ইয়াসমিন ভেবেছিলেন, ‘ছোটমানুষ কী করবে!’ কী মনে করে হঠাৎ সাবিনা একদিন সেই ছোট ছেলেটিকেই ডেকে বললেন, ‘তোমার কিছু গান শোনাও তো।’ দুয়েকটি গান শুনেই ‘থ’ বনে গেলেন। গানের সুরগুলো মনের কোণে দাগ কেটে গেল তার। সেইদিনের স্মৃতি ঘেঁটে সাবিনা ইয়াসমিন বললেন, “এখনও মনে আছে। অদ্ভুত ছিল সেই সুর! একদম আলাদা সুর। আমাদের দেশে এমন গান তো শুনিনি। আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।”
একটা নয়, বুলবুলের পাঁচটির মতো গানের সুরে কণ্ঠ তুললেন তিনি। সেই গানগুলোর মধ্যে ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে’, ‘ও আমার আট কোটি ফুল দেখ গো মালি’, ‘একদিন ঘুম ভেঙে দেখি তুমি নাই’ দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।
দীর্ঘ চার দশকের ক্যারিয়ারে দুইশ’র বেশি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করে গেছেন তিনি। ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’র মত দেশাত্মবোধক গানে তার দেওয়া সুর বাংলাদেশের মানুষের বুকে চিরদিন বাজবে। ২০১৯ সালের এই দিনে সকালবেলা রাজধানীর আফতাবনগরের বাসায় হার্ট অ্যাটাক হলে বুলবুলকে মহাখালীর আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একুশে পদক পাওয়া এই গানের মানুষটির বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি হৃদযন্ত্রের জটিলতায় ভুগছিলেন। হার্টে বøক ধরা পড়ায় ২০২০ সালে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে তার অস্ত্রোপচারও করা হয়েছিল। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। ১৯৭০ দশকের শেষ লগ্ন থেকে আমৃত্যু বাংলাদেশ চলচ্চিত্রশিল্পসহ সঙ্গীত শিল্পে সক্রিয় ছিলেন তিনি। অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা তিনি। ‘মেঘ বিজলি বাদল’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন এরপর থেকেই উপহার দিয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের অসংখ্য জনপ্রিয় গান। সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদি, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, আগুন, কনকচাঁপাসহ দেশের প্রায় সব জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। বুলবুল ছিলেন একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা। দেশকে অকৃত্রিমভাবে ভালোবেসেছিলেন বলেই হয়ত তাঁর দেশাত্মবোধক গানগুলো কথা ও সুরে অনন্য হয়ে উঠতো। মহান মুক্তিযুদ্ধে মাত্র ১৫ বছর বয়সে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। এক সময় পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বিবিসির সাথে এ বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সাল। রোজার মাসের ঘটনা। আমি তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কারাগারে বন্দী। সাতাশে রমজানের ইফতারের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ভেতরে প্রবেশ করলেন। তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন আলী রেজা। ‘সে আমাদের বললো, কাম আউটসাইড (বাইরে এসো) এবং লাইনআপ (সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াও)। লাইনআপ করার পরে তিনি আমাদের আঙুল তুলে বললেন, এ কয়জন একদিকে থাকো, এবং এই কয়জন আরেক দিকে থাকো। ৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে আলাদা করলো এবং আমরা চারজন আলাদা।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন ব্রিগেডিয়ার, নাম সাদ উল্লাহ। ব্রিগেডিয়ার সাদ উল্লাহর কাছে গিয়ে কিশোর বুলবুল জানতে চাইলেন, ‘কেন তাদের আলাদা করা হচ্ছে?’ তখন সে বুলবুলকে ডেকে নিয়ে মাথায় হাত বোলালো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, তোমরা তো সাতদিন পরে ধরা পড়েছিলে। ওদের মৃত্যুদÐে আজ কার্যকর করবো আর তোমাদেরটা কার্যকর করবো তিনদিন পর। সরাসরি বললো। আমি ওনাকে থ্যাংকস দিলাম। ঐ রাতটা আমি আমার জীবন থেকে কখনো ভুলতে পারবো না। অনেক হৃদয়বিদারক একটা বিষয় বলেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। প্রতি রাতে তাদের জেলখানা থেকে তাদের নিয়ে রাজাকার ক্যাম্পে অত্যাচার করা হতো। ওই রাতে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এবং তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বুলবুলের স্মৃতিচারণে আছে, ‘আমরা চারজন ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনতাই করেছি এবং ঐ অবস্থায় আমরা পালিয়ে গেছি।’
যুদ্ধ করে এবং তারপর অসাধারণ সব দেশাত্মবোধক গান সৃষ্টি করেই কিন্তু তিনি তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি। দেশ মাতৃকার স্বার্থে, একাত্তরের ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালে তিনি ছিলেন একজন অন্যতম সাক্ষী। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদানের পর তিনি এক প্রকার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বের হতেন না কোথাও। তাঁর মৃত্যুর বছর তিনেক আগে তাঁর ছোটভাই নিহত হয়েছিলেন আততায়ীর হাতে। এই ঘটনায় তিনি বেশ মুষড়ে পড়েছিলেন। একজন শিল্পী হয়ে তিনি নীরবে এবং শান্তিপূর্ণভাবে জীবন কাটাতে পারতেন কিন্তু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে পিছপা হননি। ‘৭০-এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেশাত্মবোধক গান দিয়ে সুরকার হিসেবে যাত্রা শুরু করেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তবে তিনি নিজে কখনো গায়ক হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেননি। ‘আমার স্বপ্ন ছিল যে আমি গান লিখবো। যিনি গান গান, তিনি গান গাইবেন। আমি একাধারে গান লিখবো, গান সুর করবো এমন দুঃস্বপ্ন কখনো দেখিনি, এভাবেই নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন তিনি। ‘নয়নের আলো’ সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে আসেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ওই সিনেমার ছয়টি গানই তুমূল জনপ্রিয় হয়েছিল। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি তাকে। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের হাতের রেখা দেখে একজন জ্যোতিষী মন্তব্য করেছিলেন, এ হাতের মধ্যে সুরকার এবং গীতিকার হওয়ার কোন রেখাই নেই, কিন্তু জ্যোতিষীর সেই ভবিষ্যতবাণী ভুল প্রমাণ করেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। পরবর্তীতে তিনিই হয়ে ওঠেন অসংখ্য জনপ্রিয় গানের সুরকার ও গীতিকার। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা। জাতিকে মুক্তি দিতে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন কিশোর বয়সে। পরিণত বয়সে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের স্বার্থে সাক্ষী দিয়ে পালন করেছিলেন আরেক ঐতিহাসিক দায়িত্ব। মাঝখানে সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলার সঙ্গীত জগৎকে। এই মহান মুক্তিযোদ্ধা এখন আমাদের মাঝে নেই। জীবিতকালে তিনি তার সমস্ত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন। বাঙালি বড় বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি। আমাদের ভালোবাসা যেমন দীর্ঘস্থায়ী নয় তেমনি ঘৃণাও দীর্ঘস্থায়ী নয়। যে কারণে মাত্র তিনবছরেই আমাদের স্মৃতিতে ধুলি জমে কীভাবে। ভুলে গেলে চলবে না, যে দেশে গুণীর কদর হয় না সে দেশে গুণী জন্মায় না।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক