বীর মুক্তিযোদ্ধা মফজল আহমদ চৌধুরীর কিছু কথা

160

মুহাম্মদ এনামুল হক মিঠু

মার্চ মাস মানেই স্বাধীনতার মাস। আনন্দ ও বেদনার এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে প্রতিবছর মার্চ মাস ফিরে আসে। এ মাসের প্রথম দিন থেকে জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন ঘটনাবলি নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন পরিবেশিত হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সেসব অজানা কাহিনি যখন বিভিন্ন মিডিয়ায় পরিবেশিত হয়, তখন প্রশ্ন জাগে-যে দেশকে, যে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমরা এত গর্ব করি, সেই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস আমরা কতটুকুইবা জানি।
এ দেশকে স্বাধীন করতে সেদিন যারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেসব অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কাহিনি আমরা কতটুকুই বা জানার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে এক ব্যতিক্রম ঘটনা। ১৯৭১ সালে মাত্র নয় মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে ত্রিশ লাখ প্রাণ আত্মোৎসর্গ করেছিলেন।
পৃথিবীতে এত অল্প সময়ে এত বেশি প্রাণ উৎসর্গ একমাত্র বাঙালি জাতিই করেছে। জাতি-ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে এ দেশের মানুষ সেদিন স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করতে পারিনি। জাতি হিসাবে এর চেয়ে বড় দুর্বলতা আর কী আছে! জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বা জামুকা এ তালিকা তৈরির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। এত বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি এত সহজ কাজও নয়।
তবে যে পদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে, তাতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধার নাম এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। সমাজে অবহেলিত এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা পদ্ধতিগত জটিলতার জন্য নিজেদের নাম প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারছেন না। ফলে, এসব মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের জীবদ্দশায় রাষ্ট্র কর্তৃক বরাদ্দকৃত সুযোগ-সুবিধা থেকে হচ্ছেন বঞ্চিত। তারই ধারাবাহিকতায় বাদ পড়ে গেছেন বাঁশখালীর বাহারচড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মফজল আহমদ চৌধুরী। যিনি চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার অন্তর্গত ৪নং বাহারছরা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মফজল আহমদের পিতা মরহুম ফেরদৌস আহমদ এবং মাতা মরহুমা জুলেখা খাতুন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মফজল আহমদ চৌধুরী তাঁর জীবদ্দশায় ১৯৬৫ থেকে ৮৬ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু অত্যন্ত সুনামের সাথে আওমীলীগের সভাপতি ও বাঁশখালী থানা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন। শুধু তাই নয়,এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মফজল আহমদ চৌধুরী স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর আমলে ৪নং বাহারছরা ইউনিয়নের রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন।
দারিদ্র্যের কশাঘাতে থেকেও তিনি বলতেন, ‘কোনো সনদ বা কাগজের জন্য বঙ্গবন্ধুর আহŸানে এ দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যায়নি। কী হবে ওই কাগুজে সনদ নিয়ে? কোনো স্বার্থ বা অর্থের লোভে তো মরণপণ সেই স্বাধীনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়িনি।’ অথচ ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে সমাজের উঁচু স্তরের ব্যক্তিরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েও রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। বর্তমান কিছু হাইব্রিডদের তাঁবেদারিতে এভাবেই হারিয়ে গেছে নির্লোভ, আসল মুক্তিযোদ্ধারা এবং সমাজে তাদের পরিবারগুলো আজও অবহেলিত।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মুরিদুল আলম ও ফরিদুল আলমের কথা অনেকেই অবগত আছেন। স্বাধীনতার পূর্বে মুরিদুল আলমের সাথে অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক ছিল মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মফজল আহমদ চৌধুরীর সাথে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের অধীনে ১১ টি সেক্টর কার্যকর ছিল। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য দ্বাদশ সেক্টর এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের সেক্টর কমান্ডার মুরিদুল আলমের সেক্টর হিসেবেই বিপুল পরিচিতি অর্জন করে। শহীদ মুরিদুল ছিলেন একমাত্র সেক্টর কমান্ডার যিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রাণ বিসর্জন দিয়ে শহীদের মর্যাদায় গৌরবদীপ্ত হয়েছেন। বাঁশখালীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুলতান উল কবির চৌধুরী ও নুরুল কবির চৌধুরীর মধ্যে কঠিন এক বিরোধ সৃষ্টি হলে তা মীমাংসার জন্য ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে শ্রদ্ধাভাজন প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার শহীদ মুরিদুলকে তাঁর রাজাখালীর আশ্রয়স্থলে যেতে বলেন। বিরোধী দুইপক্ষ একমাত্র শহীদ মুরিদুল ছাড়া আর কারো সিদ্ধান্ত মানতে সম্মত ছিলেন না। ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে শহীদ মুরিদুল চারজন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধা এবং কয়েকজন সঙ্গীসহ রাজাখালীর উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে ১৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে বাহারছড়ার নিবেদিত প্রাণ মুক্তিযোদ্ধা মফজল আহমদ চৌধুরীর বাড়িতে বিরতি এবং মধ্যাহ্নভোজ গ্রহণ করেন। ভোজন শেষে মুক্তিযোদ্ধা মফজল আহমদ সহ সন্ধ্যায় তাঁরা আবার যাত্রা শুরু করে ২০ সেপ্টেম্বর সোমবার খুব ভোরে জলকদর খালে ট্যাঙ ঘরের সম্মুখে সাঁকোর নিচে পৌঁছান। এই সংবাদ কোন না কোনভাবে অদৃশ্য শক্তির কারসাজিতে রাজাকারদের কাছে পৌঁছে যায়। শহীদ মুরিদুল সাঁকো পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা স্থানীয় কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার শফি তাদের মূল টার্গেট মুরিদুল আলমকে রাইফেল দিয়ে আক্রমণ করলে তিনি আহত অবস্থায় খালের মধ্যে পড়ে যান। প্রতিরোধ করতে গিয়ে তাঁর সহযোদ্ধা ফরিদুল আলমকে রাজাকারেরা হত্যা করে লাশ পানিতে ভাসিয়ে দেয়। আহতাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা মফজল আহমদ খালে ভাসতে ভাসতে অচেতন অবস্থায় সাগরে চলে যায়। পাশ্ববর্তী এক পরিচিত লোক সোলাইমান সাগরে ছম্পান চালানোরত অবস্থায় দেখিলে, তাৎক্ষনিক মুক্তিযোদ্ধা মফজল আহমদকে তুলে নেয়। কী অজানা কারণে অস্ত্রধারী সহযোদ্ধারা রাজাকারদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা না করে পালিয়ে গিয়েছিলেন; বিষয়টি এখনো রহস্যাবৃত। আহত মুরিদুল খালের ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে থাকাকালে ২১ সেপ্টেম্বর সকালে ঘৃণ্য এক রাজাকার তাঁকে দেখতে পায় এবং দা দিয়ে কুপিয়ে সেখানে হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধা মফজল আহমদের বাড়ি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ও আওয়ামীলীগের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। যেখানে দূরদূরান্ত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এসে খাবার খেতেন। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে আওয়ামীলীগ নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান খান কায়সার, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতানুল কবির চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা ডা. ইউসুফ, শহীদ মুরিদুল আলম সহ প্রায় সবার সাথে অত্যন্ত নিবিড় ও দৃঢ় সম্পর্ক ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা মফজল আহমদ চৌধুরীর সাথে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মফজল আহমদ চৌধুরী ১৯৮৬ সালের ২৬শে মে ( ১৬ রমজান) ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বেও মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান খান কায়সার এই কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা মফজল আহমদ চৌধুরীকে বাড়ীতে এসে দেখে এসেছিলেন এবং শহরে নিয়ে চিকিৎসা করান । বীর মুক্তিযুদ্ধা মফজল আহমদ চৌধুরী চার ছেলে ও ২ মেয়ে রেখে যান। যাঁরা বর্তমানে সবাই যেন এক একটা আওয়ামী পরিবার। এক কথায় বলা যায় রক্ত কথা বলে।
সুতরাং আমরা অনায়সে বলতে পারি , মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ দলিল। আর এই দলিলে যদি অনিয়ম হয়, মিথ্যা তথ্য থাকে, তাহলে সত্য বলে কোনো দলিল থাকবে না বাংলাদেশে।
তালিকার ভেতরে অনেক নকল মুক্তিযোদ্ধা সুবিধা ভোগ করে আসছে। অপর দিকে প্রকৃত অনেক মুক্তিযোদ্ধাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা পাচ্ছেন না। তাই স্বচ্ছ ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করা হোক। যাঁরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অথচ তাঁদের অনেকেই তালিকায় নেই, তাঁদেরকে অন্তত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হোক। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হোক। অন্যতায় তাঁদের আত্মার ও বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে হবে বেঈমানি।
১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের নেত্বত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিভাবক, সুহৃদ ও শুভাকাঙ্খি। তিনি উল্লেখিত দাবিগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করবেন বলে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরসূরি সন্তানরা দৃঢ়ভাবে আস্থা ও বিশ্বাস রাখেন এবং এটাই সর্বস্তরের প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট