বিহঙ্গ কথা ও মানবসমাজ

16

মুশফিক হোসাইন

পাািখ শুধু কৃষির উপকার করে তা নয়। গাছপালা বনবনানীরও মহাউপকার করে থাকে। বৃক্ষের বংশবিস্তারে পাখির ভূমিকা অপরিসীম। পাখি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। তাই বলা যায়, পাখিসমাজ মানুষ ও প্রকৃতির উপকারী বন্ধু। জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় তাদের ভূমিকা অসীম। বাংলাদেশের বন্য প্রাণী আইনে পাখি হত্যা ও বন্দী করা আইনতঃ দÐনীয় অপরাধ।
গত কিস্তিতে পাখি দেখা সম্পর্কে বলেছি। পাখি দেখার জন্য জানতে হয় তাদের খাদ্য অভ্যাস সম্পর্কে। পাখিদের কেউ শস্যদানা, কেউবা কীটপতঙ্গ, কেউ কেউ মাংশাসী। ছোট ছোট প্রাণী খেয়ে অভ্যস্ত। আবার কেউ পচাগলাসহ সর্বভূক। পাখি গান গায়, তবে সফল পাখি গায়ক পাখি নয়। গায়ক পাখিদের গলার ভোকাল কড বা স্বরযন্ত্র আলাদা থাকে। আমাদের দেশের গায়কপাখিদের অন্যতম হলো দোয়েল, শ্যামা, বুলবুলি, ঘুঘু। কোকিল কূহ কূহ গান গাইলেও তাকে গায়ক পাখি বলা হয় না। অন্যদিকে কাকের স্বর কর্কশ হলেও সে কিন্তু গায়ক পাখি। এবার আশা যাক পাখি দেখা নিয়ে। আমরা ইচ্ছে করলে যেকোন সময় পাখি দেখতে পারি। তবে পাখি পর্যবেক্ষণ করার সঠিক সময় হল সূর্য্যদেয় এবং সূর্যাস্তের সময়। সন্ধ্যার পর অধিকাংশ পাখি ঘুমাতে যায়। তবে কিছু রাতজাগা পাখি আছে, যারা অন্ধকারে শিকার খোঁজে। পেঁচা তাদের অন্যতম। একটি পেঁচা তার জীবনকালে ফসলি জমির ক্ষতিকর ইঁদুর খেয়ে কৃষকের বিশ লক্ষ টাকার ফসল রক্ষা করে থাকে। যাই হোক, পাখি পর্যবেক্ষণ বা পাখি দেখার জন্য নি¤œ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই সময় বেছে নিতে হবে। দ্বিতীয়তঃ বাইনোকুলার রাখা আবশ্যক। তৃতীয়তঃ ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা, চতুর্থতঃ খাতা কলম ও নোট বই, পঞ্চমতঃ ফিল্ডগাইড বই। সর্বোপরি দলবল নিয়ে পাখি পর্যবেক্ষণ যাওয়া যাবে না। পাখি দেখতে হবে নিঃশব্দে এবং নীরবে। শব্দ হওয়া মাত্রই পাখি উড়ে যায়। এই সকল শর্ত মেনে পাখি পর্যবেক্ষণে যেতে হবে। তাহলে পাখিদের আচরণ, রঙ, গান, বাসা ও ছানা লালন পালন সম্পর্কে সম্যকভাবে জানা যাবে। সোজা কথায় পাখি দেখতে হলে নিরিবিলি পরিবেশ চাই। এছাড়াও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বনবাদাড়ের সাপ ও পশুর আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে।
ইতিপূর্বে মানুষের বোকামীর জন্য অনেক পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাদেও মধ্যে ডোডো অন্যতম। মানুষকে অনুধাবন করতে হবে পাখি রক্ষা পেলে প্রকৃতি রক্ষা পাবে। রিয়ো ডি জেনিরো আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মূল পদিপাদ্য ঘোষণা ছিল, বিপন্ন পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে, রাখতে হবে সবুজ। অতএব বনভূমি উজার হলে পাখিও ধ্বংস হবে নিঃসন্দেহে। বার্ড ওয়াচিং বা পাখি পর্যবেক্ষণের পূর্বে পাখিদের প্রতি আমাদের মমতা ও ভালোবাসা সৃষ্টি করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ের খুব দুঃখজনক ঘটনা হলো নববর্ষ বা আনন্দ উল্লাস করার জন্য বিশ্বের দেশে দেশে আতশবাজি পোড়ানো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সাম্প্রতিক ঘটনা হলো ২০২৩ সালের পহেলা জানুয়ারিতে নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বিশ্বের দেশে দেশে এমন কী বাংলাদেশে রাত ১২টা এক মিনিটে হাজার হাজার আতশবাতি ও বাজি পোড়ানো হয়। যেহেতু পাখি সমাজের ৯৯ শতাংশ সন্ধ্যার পর ঘুমাতে যায়। ফলে রাতে আশতবাতির আলো ও শব্দে তারা দিশেহারা হয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে মাটিতে ভূপাতিত হয়। এতে করে অধিকাংশ সময়ে তারা মৃত্যুবরণ করে অথবা পঙ্গু হয়ে পড়ে। এ ধরনের ঘটনার সচিত্র ছবি ও সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এ ঘটনাগুলো সত্যি দুঃখজনক। মনে রাখতে হবে আমাদের একটি মাত্র পৃথিবী। এখানে সকল জীবের বসবাস। কোন একটি যদি কোনক্রমে জীবনচক্র বা খাদ্য শৃঙ্খল থেকে খসে পড়ে তবে বিশ্বে ভয়াবহ বিপদ দেখা দেয়া অস্বাভাবিক নয়।
বিশ্বে সকল প্রাণীদের মধ্যেমানব জাতি বিজ্ঞ ও চিন্তাশীল। তাই হেমান পশুপাখিসহ সকল প্রাণীদের প্রতি আমাদের দয়ামায়া মমতা থাকা উচিত। আমাদের এই পৃথিবী উষ্ণায়নের কারণে সংকটে পতিত। জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। উত্তরের মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, মরুভূমিতে বৃষ্টির প্রকোপ বাড়ছে, ইউরোপের দেশসমূহের তুষারপাত বাড়ছে। জলবায়ুর এই অনাকাক্সিক্ষত পরিবর্তন প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য সহায়ক নয়। দেখা দিচ্ছে দৈবদুর্বিপাক, মহামারীসহ নানা প্রাণঘাতি সমস্যার। এখনও সময় আছে সতর্ক হওয়ার। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, সকল অঘটনের জনর‌্য মানবজাতিই দায়ী। অতএব মানবসমাজকে আরও বেশি সংবেদনশীল ও চিন্তাশীল হতে হবে। ধ্বংস হওয়ার আগে পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)