বিস্ময়কর বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম

38

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন

বিজ্ঞানী হিসেবে যে কয়েকজন ব্যক্তি বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নামকে উজ্জ্বল করেছেন, তাদের মাঝে অন্যতম জামাল নজরুল ইসলাম। বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনেক বিষয়েই হয়, কিন্তু তার গবেষণার মতো কাব্যিক গবেষণা খুব কমই হয়। সামগ্রিক মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ কী হবে তথা মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি কী, তা নিয়ে জামাল নজরুল ইসলাম করেছেন বিশ্বমানের গবেষণা। বর্তমানে অনেকেই মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণা করছেন কিন্তু তিনি যে সময়ে করেছেন, তখন খুব বেশি কেউ এই ক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করেনি। স্টিফেন হকিং মহাবিশ্ব নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন, কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নামে বই লিখে দুনিয়াজুড়ে বিখ্যাতও হয়েছেন। তবে জামাল নজরুল ইসলাম মহাবিশ্বের উচ্চমার্গীয় বিষয় নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন তারও আগে। স্টিফেন হকিংয়ের প্রথম বই ‘অ ইৎরবভ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঞরসব’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮ সালে এবং জামাল নজরুল ইসলামের প্রথম বই ‘ঞযব টষঃরসধঃব ঋধঃব ড়ভ ঞযব টহরাবৎংব’ প্রকাশিত ১৯৮৩ সালে।
দেশের মানুষের কাছে একটি সময় পর্যন্ত খুব বেশি পরিচিত ছিলেন না তিনি। তবে তার সম্পর্কে যে-ই জেনেছে সে-ই ভালোবেসে ফেলেছে প্রথমবারে। ১৯৮১ সালে লন্ডনের লাখ টাকা বেতনের চাকরি এবং উন্নত সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে মাত্র ৩ হাজার টাকা বেতনের চাকরি নিয়ে তিনি চলে আসেন মাতৃভূমি বাংলাদেশে। বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষা এবং বিজ্ঞান গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তিনি। বাংলার সন্তানদেরকে বিজ্ঞান শিক্ষা এবং গবেষণায় উজ্জীবিত করার মাধ্যমে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন জামাল নজরুল ইসলাম।
জামাল নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারিতে। জন্মস্থান ঝিনাইদহ হলেও তার শিকড়ের ঠিকানা চট্টগ্রামে। চাকরিসূত্রে বাবা ঝিনাইদহ অবস্থান করছিলেন বলে জন্মস্থান হয়েছে সেখানে। বংশগত দিক থেকে ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান, তৎকালে ঢাকার নবাব বাড়ির পাশাপাশি যোগাযোগ ছিল জর্ডানের বাদশার পরিবারের সাথে। তবে বংশ হিসেবে অভিজাত হলেও ছিল না আভিজাত্যের অহংকার।
চার ভাই আর চার বোন নিয়ে ছিল তাদের পরিবার। ভাইদের নামগুলোতে একজনের সাথে আরেকজনের খুব মিল- কামাল জিয়াউল ইসলাম, তারেক মইনুল ইসলাম, হেলাল শমসের ইসলাম ও জামাল নজরুল ইসলাম। বাবা মুহম্মদ সিরাজুল ইসলাম ছিলেন ঝিনাইদহ জেলার সাব জজ (মুন্সেফ)। মাতা রাহাত আরা বেগম ছিলেন একজন সাহিত্য অনুরাগী লেখক, গানও গাইতেন ভালো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকটি উর্দুতে অনুবাদ করে বেশ প্রশংসা অর্জন করেছিলেন রাহাত আরা। তাদের বাসায় যাতায়াতও ছিল অনেক উঁচু দরের মানুষের। তাদের কলকাতার বাসায় কবি কাজী নজরুল ইসলামও যাতায়ত করতেন। কবির নামের সাথে মিল রেখেই তার বাবা-মা তার নাম রেখেছিলেন ‘জামাল নজরুল ইসলাম’।
অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের জীবনে তার মা ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শিশু জামাল নজরুল ইসলামকে মাত্র ১০ বছর বয়সে রেখেই ১৯৪৯ সালে তিনি চলে যান পৃথিবী ছেড়ে। শিশু বয়সে মাকে হারালেও সারা জীবন কখনো ভোলেননি মায়ের গাঢ় স্মৃতির কথা।
শৈশবে কলকাতার একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন জামাল নজরুল ইসলাম। সেখান থেকে আসেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তির সময় তার মেধা দেখে অভিভূত হন প্রধান শিক্ষক। মেধায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ডাবল প্রমোশন দিয়ে তুলে দেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে। এখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে চলে যান পাকিস্তানের লরেন্স কলেজে। লরেন্স কলেজ থেকে এ লেভেল এবং ও লেভেল সম্পন্ন করে ভর্তি হন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বি.এসসি অনার্স সম্পন্ন করেন। তারপর চলে যান লন্ডনের বিশ্ববিখ্যাত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে ১৯৬৪ সালে ‘এপ্লায়েড ম্যাথম্যাটিকস এন্ড থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স’-এর উপর পিএইচ.ডি সম্পন্ন করেন তিনি।
শিক্ষা ও ডিগ্রি অর্জনের ব্যাপারগুলো ঘটে যাচ্ছিল খুব দ্রæত। ২০ বছর বয়সেই তিনি দু’বার বি.এসসি করে ফেলেন (লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজে ২য় বার বি.এসসি করেছিলেন)। ছোটবেলায় যেমন ডাবল প্রমোশন পেয়ে সিক্সে ওঠে গিয়েছিলেন তেমনই পোস্ট ডক্টরাল করার সময়ও ‘ডাবল প্রমোশন’ পেয়েছিলেন। ডক্টরেট সম্পন্ন হবার আগেই পোস্ট ডক্টরাল গবেষণায় যোগ দেন তিনি। সাধারণত ডক্টরেট সম্পন্ন হবার আগে পোস্ট ডক্টরেট গবেষণা করা যায় না। কিন্তু তিনি নির্ধারিত সময়ের আগেই পিএইচ.ডির কাজ শেষ করে ফেলেন। কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলেও থিসিস জমা দেবার সময় না হওয়াতে পিএইচ.ডি সম্পন্ন হতে দেরি হয় তার। তাই তিনি বিশেষ বিবেচনায় পোস্ট ডক্টরাল গবেষণার সুযোগ পেয়েছিলেন।
বিজ্ঞানে খুব উঁচু মানের পারদর্শিতা দেখালে কিংবা খুব বড় ধরনের প্রভাব ও অবদান রাখলে ডক্টর অব সায়েন্স (ডি.এসসি) প্রদান করা হয়। সহজ কথায় এ ধরনের ব্যক্তিরা হলেন শিক্ষকদের শিক্ষক, সেরাদের সেরা। আমাদের জামাল নজরুল ইসলামও ১৯৮২ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি কর্তৃক ডি.এসসি ডিগ্রিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত, স্টিফেন হকিং চাইতেন জামাল নজরুল ইসলাম বিলাতেই থেকে যেন গবেষণা করে যান। একেবারে বিলাতেই থিতু হয়ে যাওয়ার কথা বলতেন তিনি। হকিং প্রায়ই বলতেন, তুমি এখানে থেকেই তো দেশের জন্য অনেক কাজ করতে পারো।
বিলাতে থেকেও দেশের জন্য কাজ করা যায় জামাল নজরুল ইসলাম সেটি জানতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার যেন বাংলাদেশের পক্ষে থাকে, সে জন্য তিনি প্রায় সব ব্রিটিশ এমপির কাছে চিঠি লিখেছেন। এমনকি ব্রিটিশ এমপি লর্ড বাটলারের মাধ্যমে গণচীনের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের কাছে অনুরোধ করেন, যেন চীন পাকিস্তানের পক্ষে না দাঁড়ায়।
বলা বাহুল্য, বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে বাংলাদেশের তরুণদেরও বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখাগুলোতে অবাধ সন্তরণ শিখতে হবে। কেমব্রিজে নিজের গবেষণা করে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের একটি নতুন চ্যালেঞ্জিং জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে জামাল নজরুল ইসলাম দেশে ফেরেন। জামাল নজরুল ইসলাম প্রায় বলতেন, ‘বাংলাদেশের একটি ছেলে বা মেয়েকে যদি আমি বিজ্ঞানের পথে নিয়ে আসতে পারি, যদি তার সামনে মহাবিশ্বের রহস্য অনুসন্ধানের একটি নতুন দরজা খুলে দিতে পারি, তাহলেই আমার দেশে ফেরা সার্থক হবে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গাণিতিক ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র (স্টিফেন হকিং একই কাজ করেছেন কেমব্রিজে, তবে সেটি জামাল নজরুল ইসলামের দেড় দশক পরে)। নিজের কাজ দিয়ে তিনি জানতেন, তত্ত¡ীয় পদার্থবিজ্ঞান আর কসমোলজির আঙিনায় চরে বেড়ানোর মতো শিক্ষার্থী এ দেশেই আছেন। দরকার কেবল তাঁদের পথ দেখানো এবং রসদ জোগান দেওয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল ও ফিসিক্যাল সায়েন্সে তাঁর অধীনে মাত্র ৫০ জন শিক্ষার্থী এমফিল ডিগ্রি লাভ করেছেন। আর ৩৩ জন পেয়েছেন পিএইচডি ডিগ্রি। তাঁদের প্রত্যেকের কাজই আন্তর্জাতিক মানের।
ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করা, তাঁদের অভিভাবক হওয়ার পরেও তিনি তাঁর নিজের গবেষণা এবং কাজের সময়টুকু ঠিকই বের করে নিতেন। ১৯৯২ সালে তাঁর অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথেমেটিক্যাল কসমোলজি বইটি প্রকাশিত হয়। এরও পরে লিখেছেন ফার ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্স। তবে জামাল নজরুলের সবচেয়ে বিখ্যাত বইটি হলো দি আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স। ১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ প্রেস থেকে প্রকাশের পর এটি ফরাসি, পর্তুগিজ, যুগো¯øাভ ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বইটি তাঁর নিজের গবেষণার সারাংশ। গবেষণার সন্দর্ভ হাতে পাওয়ার পর বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসন তাঁর মতো দুনিয়ার শেষ পরিণতি সম্পর্কে আকৃষ্ট হোন। অধ্যাপক জামালের মৃত্যুর পর তিনি স্মরণ করেছেন, ‘জামাল ইসলামের কাজ আমাকে দুনিয়ার শেষ পরিণতি সম্পর্কে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছে। জামাল ইসলাম সেই কাজটিই করেছেন, যা কি না অনেকেই করতে চান না, কারণ কাজটা কঠিন।’
দুনিয়ার শেষ পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনেক ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া লাগে। প্রোটন কণার লয় থেকে দুনিয়ার তাপীয় মৃত্যু। এখনো বিজ্ঞানীরা মহাবিস্ফোরণ থেকে এই দুনিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশ্বাস করলেও দুনিয়ার শেষ পরিণতি কী হবে তা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। প্রসারণ দিয়ে যার শুরু, সংকোচন দিয়ে তার শেষ কি না কে জানেন? তবে জামাল নজরুল ইসলাম দেখিয়েছেন শেষের দিকে এক মহাশূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। যে গুটিকয়েক বিজ্ঞানী মহাবিস্ফোরণ তত্তে¡র বিপরীতে স্টেডি স্টেট থিউরি মেনে চলেইন, তাদের অন্যতম জয়ন্ত নারলিকর কেমব্রিজে জামাল নজরুলের সহপাঠী ছিলেন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্তে¡র আঙিনায় তখন একঝাঁক তরুণ-তরুণীর বিচরণ। যাঁদের অনেকেই পরে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
প্রসঙ্গত, বিকেল হলে জামাল-সুরাইয়া জুটি তাঁদের দুই মেয়ে সাদাফ আর নার্গিসকে নিয়ে হাঁটতে চলে যেতেন নদীর পাড়ে। কোনো কোনো দিন সঙ্গী হন স্টিফেন আর জেন হকিং, সঙ্গে তাঁদের ছেলে রবার্ট আর মেয়ে লুসি। আলোচনায় সৃষ্টিতত্ত¡ যেমন আসে, তেমনি আসে প্রকৃতির কথাও। প্রকৃতির সত্য উদ্ঘাটন করতে হলে প্রকৃতিকে নিজের মতো করে জানা দরকার। এই বোধ থেকে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর মেয়েদের প্রকৃতি পাঠে উৎসাহ দিতেন।
দেশে ফিরবেন এই পরিকল্পনা তাঁর শুরু থেকেই ছিল। তাই ঠিক সময়ে মেয়েদের বাংলা শেখানো শুরু করেন, সঙ্গে গান–বাজনা। আইনস্টাইনের জগতের এই ব্যক্তি চমৎকার করে পিয়ানো ও সেতার বাজাতে পারতেন। চট্টগ্রামে তাঁর বাসায় নিয়মিত বসতো গানের আসর। কখনো কখনো জামাল নজরুল বসে পড়তেন হারমোনিয়াম নিয়ে। স্ত্রী সুরাইয়া ইসলামও গলা মেলাতেন তাঁর সঙ্গে।
বিস্ময়কর হলেও সত্য, প্রতিদিন নাশতার টেবিলে কোনো না কোনো অঙ্কের সমাধান করতেন। কোনো কোনো সময় ব্যবহার করতেন দৈনিক পত্রিকার মার্জিনের খালি অংশ। একটি সমস্যা সমাধানে পটু প্রজন্মের সন্ধান করে গেছেন আমৃত্যু।
দেশের জন্য, দেশের বিজ্ঞানচর্চার জন্য তিনি যে পরিমাণ আন্তরিকতা দেখিয়েছেন, তা সত্যিই বিরল। নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ এই গুণী বিজ্ঞানী ২০১৩ সালে ৭৪ বছর বয়সে পরলোকগত হন। তার মৃত্যুতে এই দেশ তথা এই পৃথিবী আসলেই একজন আলোকিত নক্ষত্রকে হারিয়েছে। কিছু কিছু ব্যক্তিত্ব আছে যাদের আবেদন কখনো ¤øান হয় না। শেষ বয়সে পৌঁছালে অনেকেরই আবেদন কমে যায়। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশের বিজ্ঞান জগতের পথিকৃৎ।

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চ.বি. গ্রন্থাগার