বিসিবি পারলে বাফুফে কেন নয় ?

15

গোপাল নাথ বাবুল

ফুটবল এমন এক খেলা, যেখানে গোল হওয়া না হওয়ার আনন্দ-বেদনার সঙ্গে জটিলতম সব ফরমেশন ও কৌশলের মজা পাওয়া যায়। যে যার অবস্থান থেকে খেলাটাকে উপভোগ করতে পারার এ দুর্দান্ত সর্বজনীনতা খেলাটাকে দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ইভেন্টে পরিণত করেছে। আর নিঃসন্দেহে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর হলো বিশ্বকাপ ফুটবল। এ সময় গোটা পৃথিবীর নজর থাকে কে জিতল, কে হারল। কারা জিতে স্বপ্নের সোনার কাপ তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। সমর্থকদের রয়েছে খেলাটির সবরকম মানবীয় আবেগকে ধারণ করার ক্ষমতা। এ কারণে বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু হার-জিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এ অশান্ত দুনিয়ায় ফুটবল দিনকে দিন আরও আপন এবং এক হয়ে ওঠার উপলক্ষ হয়ে ওঠে।
ফুটবল নিয়ে বাঙালির উন্মাদনা চিরাচরিত। কারণ বাঙালি সবসময় খেলা পাগল। সে খেলাটা যদি ফুটবল হয়, তাহলে তো কথাই নেই। নাওয়া-খাওয়া ছাড়তেও রাজি ফুটবলের জন্য। প্রতি ৪ বছর পরপর বাংলাদেশের মানুষ যেন সবকিছু ভুলে ফুটবলেই মগ্ন হয়ে পড়ে।
বর্তমানে ফুটবল বিশ্বকাপ চলছে। নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্যে কাতারে বসেছে ফুটবলের মহামিলন মেলা। আরবের মরুভূমিতে প্রথম ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবলের নান্দনিক ফুল। ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩০ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুষ্ঠিত এ বিশ্বকাপ নানা কারণেই অনন্য। বিশ্বসেরা হতে শেষবারের মতো এ মঞ্চে ভাগ্য এবং প্রতিভাকে বাজি রাখছেন বিশ্বসেরা ফুটবলাররা। পায়ে পায়ে খেলছেন নেইমার, মেসি, রোনাল্ডো, এমবাপেরা। আর সমর্থকদের কেউ ব্রাজিল, কেউ আর্জেটিনা, কেউবা অন্য কোনও দেশের খেলোয়াড়ের ভক্ত। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে নিয়ে যেভাবে ফুটবল ভক্তদের মাঝে উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক একইভাবে আমাদের দেশের আবাহনী-মোহামেডানকে নিয়েও একসময় বিপুল উন্মাদনা ছিল। যেদিন আবাহনী-মোহামেডানের খেলা থাকত, সেদিন সারাদেশে ভক্তদের মাঝে ফুটবল উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ত। মাঝেমাঝে এ উন্মাদনা ও উত্তেজনা আবেগে পূর্ণ ভক্তদের মাঝে মারামারিতে রূপ নিত এবং এ মারামারি স্টেডিয়ামের গন্ডি পার হয়ে রাস্তায় রাস্তায় এবং পাড়ার অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে পড়ত। গত শতক পর্যন্ত আবাহনী-মোহামেডানের ভক্তদের মাঝে এ উন্মাদনা ছিল। আবাহনীর আসলাম, সত্যজিৎ দাশ রুপু, চুন্নু ও মোহামেডানের হামিদ,
সাব্বির প্রভৃতি খেলোয়াড়রা ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার পর ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ফুটবল তলানিতে চলে আসে। বাংলাদেশের সেই ফুটবলের উন্মাদনা কীভাবে যে হারিয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না।
কাতারে ২২তম বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরে ইতিমধ্যে গ্রুপ পর্বের লড়াই শেষ। ৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে নকআউট পর্বের ম্যাচ। এর আগে জাপান-দক্ষিণ কোরিয়াতে ২০০২ সালে বিশ্বকাপের আসর বসেছিল। পরিতাপের বিষয় হলো-এশিয়াতে দু’-দু’বার বিশ্বকাপের আয়োজন করা হলেও বাংলাদেশের কাছে বিশ্বকাপ খেলা এখনও কেবল স্বপ্নই। ইরাক, জর্ডানের মতো দেশ বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জনের কাছাকাছি চলে গেলেও বাংলাদেশ এখনও বিশ্বকাপে ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখেই চলছে। স্বপ্ন দেখার যেন শেষ নেই।
এবার অত্যন্ত গরিব দেশ ৩ কোটি ৭০ লক্ষ জনসংখ্যার মরক্কো এবং মাত্র ১ কোটি ২১ লক্ষ জনসংখ্যার তিউনিসিয়া সহ মোট ৩২টি দেশ অংশগ্রহণ করেছে। যদিও মরক্কো কানাডাকে হারিয়ে ওঠে এলেও তিউনিসিয়া নকআউট পর্বে ওঠতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো- মরক্কো ও তিউনিসিয়া যদি এ জনসংখ্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের ১১জন ফুটবল প্লেয়ার তৈরি করতে পারে, তবে কেন ১৬ কোটির বাংলাদেশ ১১জন ফুটবলারকে খুঁজে পায় না ? আর কতদিন বাংলাদেশ কেবল ‘আদর্শ’ দর্শকের ভূমিকা পালন করবে ?কতদিন বাংলাদেশি দর্শকদের ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাকে নিয়ে হই-হুল্লোড়, লাফালাফিসহ উন্মাদনা তৈরি করতে হবে। এখনও ফিফা র‌্যাকিং-এ বাংলাদেশের স্থান ১৮৬। অথচ মাত্র ১ কোটি ৪ লক্ষ ১৯ হাজার জনসংখ্যার দেশ বেলজিয়াম
ফিফা র‌্যাকিং-এ ১ নম্বর। সবার প্রশ্ন-বিসিবি যদি বিশ্বকাপ খেলতে পারে বাফুফে কেন পারছে না ?
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দেশে প্রতিভার অভাব নেই। সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে বাংলাদেশও এশিয়ার সেরা হয়ে বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। কারণ, এক সময় বাংলাদেশ ফুটবলের একটা দুর্দান্ত অতীত ছিল। আন্তর্জাতিক ফুটবল অনেক এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ ক্রমশ পিছিয়েছে। কেন এমন হচ্ছে, এ প্রশ্নের জবাব খোঁজা জরুরি।
অনেকের ধারণা-বাংলাদেশ ফুটবলের এ অবস্থার জন্য বাফুফের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যথেষ্ট ব্যর্থতা রয়েছে। এ ব্যর্থতা কাটিয়ে অতীতের ভুলগুলো শোধরাতে পারলে আশা করা যায়, বাংলাদেশও একদিন বিশ্বকাপ খেলবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফুটবলে সফলতা পেতে হলে নি¤েœাক্ত বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
ফুটবল খেলাকে এগিয়ে নিতে যারা ব্যর্থ তাদের বাদ দিয়ে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বাফুফে-এ যোগ্যলোক নিয়োগ দিতে হবে। বাফুফের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং দলীয়করণ মুক্ত থাকতে হবে। কিছু কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে উপযুক্ত খেলোয়াড়রা জাতীয় দলসহ বিভিন্ন দলে সুযোগ পায় না। এ রকম অনেক কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায়।
তৃণমূল থেকে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের তুলে আনতে হবে। এজন্য পূর্বের মতো স্কুল ও কলেজলীগসহ ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলায় জেলায় প্রিমিয়ার লীগ চালু করতে হবে।
সবচেয়ে বেশি যেটাতে নজর দিতে হবে, সেটা হলো-খেলোয়াড়দের দম কীভাবে ধরে রাখা যায়। প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধের ১০/১৫ মিনিট খেলে খেলোয়াড়রা আর দম ধরে রাখতে পারে না, নেতিয়ে পড়ে। যা খেলোয়াড়দের শারীরিক ভাষায় প্রকাশ পায়। এজন্য খেলোয়াড়দের ফিটনেসের প্রতি আগে নজর দিতে হবে।
সবশেষে খেলাধুলাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে এবং ফুটবলের উন্নতির জন্য প্রয়োজন সবার ঐক্যবদ্ধ সমম্বিত প্রচেষ্টা এবং খেলোয়ারদের সদিচ্ছা আর কঠোর পরিশ্রম।
উপরোক্ত সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারলে আশা করি, ১৬ কোটি মানুষের মধ্য থেকে অন্তত ১৬ জন খেলোয়াড় ওঠে আসবেন এবং বাংলাদেশও একদিন বিশ্বকাপ খেলতে পারবে। তা না হলে ফুটবল নিয়ে ব্যর্থতার গ্লানি বহন করে চলতে হবে অনন্তকাল।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক