বিশ্ব মন্দায় সবাইকে সতর্ক ও সাশ্রয়ী হতে হবে

29

পটিয়া, চন্দনাইশ ও খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি

পটিয়ার কালারপোলসহ শত সেতুর উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দায় সবাইকে সতর্ক ও সাশ্রয়ী হতে হবে। করোনা ভাইরাস এবং পরবর্তীতে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিচ্ছে। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, ভেড়া পালন ও শাকসবজির চাষাবাদ করে নিজেদের উপার্জন নিজেদের করার চেষ্টা করতে হবে। তেল-গ্যাস, পানি বিদ্যুতের ব্যবহারে সীমিত ও সাশ্রয়ী হতে হবে। যেখানে খালি জমি আছে সেখানে খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা বাংলাদেশের যেন খুব বেশি ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য দেশবাসীকে সতর্ক হতে হবে।
গতকাল সোমবার সকাল ১০টায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। পটিয়ায় কালারপোল সেতু এলাকায় এ উপলক্ষে আয়োজিত সভায় শত শত নেতাকর্মীর সরব উপস্থিতির জনস্রোত তৈরি হয়। সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত হওয়ার সাথে সাথে উপস্থিত লোকজন প্রধানমন্ত্রীকে দাঁড়িয়ে ও হাতে থাকা জাতীয় পতাকা উচিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জানানো হয়, প্রায় ৮৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব সেতুর মধ্যে সবচেয়ে বড় সেতু সুনামগঞ্জের রানীগঞ্জ ইউনিয়নে, এর দৈর্ঘ্য ৭০২ মিটার। এ সেতু নির্মাণের ফলে ঢাকার সাথে সুনামগঞ্জের দূরত্ব কমবে প্রায় ৫২ কিলোমিটার। বাকি সেতুগুলোর মধ্যে ৮টি সেতুর দৈর্ঘ্য ১০১ মিটার করে, ২০টি সেতুর দৈর্ঘ্য ৫১ থেকে ১০০ মিটার এবং ৭২টি সেতুর দৈর্ঘ্য ১৬ থেকে ৫০ মিটার। ১০০টি সেতুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সেতু খাগড়াছড়ি জেলায়। সেখানে মোট ৪২টি সেতু নির্মাণ করা হয়। এরপরের অবস্থানে রয়েছে সুনামগঞ্জ। সেখানে মোট ১৭টি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামে রয়েছে দুটি। এরমধ্যে একটি পটিয়া কালারপোল ও অন্যটি চন্দনাইশ বরকল ব্রিজ। শত সেতুর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামেই ৪৫টি সেতুর উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া ঝালকাঠি, বরিশাল ও পিরোজপুর জেলায় ৪টি করে সেতু, রাজবাড়ী ও নেত্রকোনা জেলায় ৩টি করে, মানিকগঞ্জ, শেরপুর, পটুয়াখালী, বগুড়া ২টি করে সেতু উদ্বোধন করা হয়। এর বাইরে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, পাবনা, নাটোর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নোয়াখালী ও বান্দরবান জেলায় একটি করে সেতু উদ্বোধন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী সেতুগুলো বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন।
গণভবনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মূখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয়। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হওয়ার পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান পটিয়াস্থ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন। এসময় তিনি পটিয়াসহ চট্টগ্রামের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরেন। পটিয়া কালারপোল সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে সেতু এলাকায় সকাল থেকে ব্যাপক জনসমাগম ঘটে। সকাল ৮টা থেকে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌরসদর থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী নিয়ে মিছিলসহকারে অনুষ্ঠানস্থলে যোগদান করেন। সকাল সাড়ে ৯টা হতেই মাঠ লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে।
পটিয়ায় কালারপোল সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে সেতু সংলগ্ন এলাকায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের সঞ্চালনায় এসময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপি, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী, বোয়ালখালী আসনের সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমেদ, বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মাহবুবের রহমান, ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান চেমন আরা তৈয়ব, পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, উপজেলা চেয়ারম্যান মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আতিকুল মামুন, পটিয়া পৌরসভার মেয়র আইয়ুব বাবুল, সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) রাকিবুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আকম সামশুজ্জামান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক হারুনুর রশিদ, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান তিমির বরণ চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা বিজন চক্রবর্তী, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাজেদা বেগম শিরু, দোহাজারী সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ ছাড়াও বিভিন্ন ইউপি চেয়ারম্যান, পৌর কাউন্সিলর, উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো বলেন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আওতাধীন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে দেশের ২৫টি জেলায় নবনির্মিত শত সেতুর উদ্বোধন করা হচ্ছে। দেশে একসঙ্গে শত সেতুর উদ্বোধন ঐতিহাসিক একটি ঘটনা। এর আগে এমনটি ঘটেনি।
এসময় শেখ হাসিনা বলেন, সেতুগুলো নির্মাণ করে দিলাম। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ, সুন্দরভাবে ব্যবহার করা আপনাদের নিজ নিজ দায়িত্ব। সেতুগুলো নির্মাণের ফলে প্রত্যেকটা অঞ্চলে আর্থসামাজিক উন্নতি ঘটবে। শত সেতুর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামেই ৪৫টি সেতুর উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং এই মন্ত্রণালয়ের সচিব এবিএম আমিনুল্লাহ নূরী।
এদিকে চন্দনাইশ ও আনোয়ারা উপজেলা সীমান্তের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত চাঁনখালী খালে নবনির্মিত বরকল সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে সেতু সংলগ্ন এলাকায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দোহাজারী সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এতে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম-১৪ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম চৌধুরী।
অন্যান্যদের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আবদুল জব্বার চৌধুরী, তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী মো. জাহিদ হোসেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাছরীন আক্তার, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জামাল উদ্দীন, চন্দনাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মাহাবুবুর রহমান শিবলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ রাফিজ বিন মনজুর, বরকল ইউপি চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহিম চৌধুরী, কার্য-সহকারী মো. আবদুন নুর, ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম, আওয়ামী লীগ নেতা আবুল বশর ভ‚ঁইয়া, মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসুল ইসলাম খান, বলরাম চক্রবর্ত্তী, মাস্টার আহসান ফারুক, মোজাম্মেল হক, নবাব আলী, সাইফুর রহমান চৌধুরী, ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী, যুবলীগ নেতা মো. তৌহিদুল আলম, মুরিদুল আলম মুরাদ, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান, নাঈম উদ্দিন, যুবলীগ নেতা ফোরক আহমদ, আনসারুল হক, কৃষ্ণ চক্রবর্ত্তী, উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মারজাদুল ইসলাম চৌধুরী আরমান, সিরাজুল কাফি চৌধুরী, সিরাজুল হক সাকিব প্রমুখ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নজরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি বলেন, বরকল সেতু নির্মাণ হওয়ায় এ অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থায় আসবে আমূল পরিবর্তন। আগামীতে বঙ্গবন্ধু টানেল হয়ে আসা বিপুল পরিমাণ যানবাহন গাছবাড়িয়া-চন্দনাইশ-বরকল-আনোয়ারা সড়ক হয়ে কম সময়ের মধ্যে পর্যটন নগরী কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় পৌঁছাতে পারবে। তাছাড়া চন্দনাইশ ও আনোয়ারা উপজেলায় উৎপাদিত কৃষি পণ্য দ্রæত গন্তব্য স্থানে নিয়ে যেতে পারবেন কৃষকেরা।
অন্যদিকে খাগড়াছড়িতে ৪২টি সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ নেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স’র চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী পদ-মর্যাদা) কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি, সংরক্ষিত নারী সাংসদ বাসন্তী চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, গুইমারার রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামাল মামুন, খাগড়াছড়ি রিজিয়নের স্টাফ অফিসার (জিটুআই) মেজর মো. জাহিদ হাসান, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আলম চৌধুরী, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস, পুলিশ সুপার মো. নাইমুল হক পিপিএম, খাগড়াছড়ি পৌর সভার মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী, খাগড়াছড়ি শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মৃদুময় চাকমা, সড়ক বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সবুজ চাকমাসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
উদ্বোধনী বক্তব্যে খাগড়াছড়িবাসীকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম (শান্তি চুক্তি) করে ছিলাম। শান্তি চুক্তি করার একটায় লক্ষ ছিলো যে ঐ অঞ্চলে যেনো শান্তির প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের যারা অধিবাসী তাদের যেন জীবনমান উন্নত হয়। উন্নয়ন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। আমরা শান্তি চুক্তি করার ফলে ঐ অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নতি করে দিচ্ছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে একইসাথে এতো সেতু নির্মাণ তা অনেকে কল্পনাই করতে পারেনি। আশা করি এ এলাকায় অর্থনৈতিক আরো উন্নতি সম্ভব হবে।
তিনি আরো বলেন, আগে পার্বত্যাঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিকমতো পাওয়া যেত না, সেখানে আমরা শক্তিশালী নেটওয়ার্কের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে এবং হচ্ছে জানিয়ে বর্তমান সরকারের সময় অসহায় মানুষকে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করে দেওয়াসহ উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরে খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন সড়কের নবনির্মিত ৪২টি সেতুর জন্য ১৮৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।