বিশ্ব মন্দার দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব

20

পূর্বদেশ ডেস্ক

ভয়াবহ একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা আমাদের দ্বারপ্রান্তে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ এটি শুরু হয়ে আগামী বছরজুড়ে অব্যাহত থাকতে পারে। এবারের মন্দা ২০০৮ সালের তুলনায়, এমনকি কয়েক দশকের মধ্যে ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের। কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ যুক্তরাজ্যে। জ্বালানি সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে জার্মানিতে। পাকিস্তান রিজার্ভ সংকটে দেউলিয়া হওয়ার পথে। মার্কিন ডলার ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের মতো মজবুত অর্থনীতিও প্রবল ধাক্কা খেয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে আগামীতে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাবাজার অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে বলে জানান অর্থনীতিবিদরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বমন্দার যে আশঙ্কাটা করা হচ্ছে, তা এখন আর আশঙ্কার মধ্যে নেই। মন্দা দরজায় চলে এসেছে। বড় বড় তিনটি অর্থনীতি ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে ইতোমধ্যে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। ইউরোপে তো নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিই হয়েছে। এ অবস্থার একটা কারণ, বিশ্ব অর্থনীতি যখন কভিডের প্রভাব থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করল তখন চাহিদা বাড়ল। খরচ করার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেল। এর প্রভাব পড়ল মূল্যস্ফীতিতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছিল। যুদ্ধ শুরুর পর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।
অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, মন্দা শেষ পর্যন্ত নাও ঘটতে পারে। জাতিসংঘও বলছে, মন্দা অনিবার্য নয়। সঠিক পদক্ষেপ নিলে সংকট এড়ানো সম্ভব। তবে বিশেষজ্ঞরা প্রায় একমত, সম্ভাব্য এ মন্দায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইউরোপ। এশিয়া এবার তুলনামূলকভাবে কম ঝাঁকুনি খাবে। ২০০৮ সালের মন্দায় এশিয়া বেশি বিপর্যস্ত হলেও এবার এ অঞ্চলের দেশগুলো সংকট মোকাবিলায় অনেকাংশে প্রস্তুত।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলন সংস্থার (আঙ্কটাড) প্রধান রেবেকা গ্রিনস্প্যান সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিশ্ব এখন মন্দার দ্বারপ্রান্তে এবং এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোও এ মন্দায় মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। তিনি বলেন, আজ আমাদের সতর্ক করা দরকার যে আমরা একটি নীতি-প্ররোচিত বৈশ্বিক মন্দার দ্বারপ্রান্তে। আমাদের এখনও মন্দার প্রান্ত থেকে ফিরে আসার সময় আছে। কিছুই অনিবার্য নয়। আমাদের অবশ্যই পথ পরিবর্তন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, আসন্ন মন্দা এড়ানোর বিষয়টি পুরোপুরিভাবে নীতিগত ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ব্যাপার।
আঙ্কটাড’র পূর্বাভাস, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট এবং ২০২০ সালের করোনা মহামারি সংকটের চেয়েও এবার মন্দা আরও তীব্র হতে পারে। এতে আরও বলা হয়েছে, সব অঞ্চল প্রভাবিত হবে, তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি বিপদের ঘণ্টা বাজছে। এর মধ্যে অনেক দেশ ঋণখেলাপির কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে চীন ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আনুমানিক ৩৬০ বিলিয়ন ডলার আয় হ্রাস পাবে বলেও জানায় সংস্থাটি। উন্নত অর্থনীতিতে সুদের হার বৃদ্ধির কারণে প্রায় ৯০টি উন্নয়নশীল দেশের মুদ্রা এ বছর ডলারের বিপরীতে দুর্বল হয়েছে। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মহামারির আগের পাঁচ বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধির হারে নিচে থাকবে বলেও পূর্বাভাসে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতির তিন মূল চালিকাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের অর্থনীতি দ্রুত গতি হারাচ্ছে। ফলে আগামী বছরে সামান্য আঘাতেও মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। বিশ্বব্যাংক যে আশঙ্কা করেছে, তা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটি বলছে, সম্ভাব্য এই মন্দায় মারাত্মক পরিণতি ভোগ করবে মূলত উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। প্রতিবেদনে জাতিসংঘের অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, উন্নত দেশগুলোর মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি বিশ্বকে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের চেয়েও খারাপ অর্থনৈতিক মন্দায় ফেলতে পারে।
গণতান্ত্রিক ও মুক্ত অর্থনীতির দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এক প্রতিবেদনে বলেছে, পুরো বিশ্ব এবং বিশেষ করে ইউরোপ ইউক্রেনের যুদ্ধের মাশুল দিচ্ছে এবং অনেক অর্থনীতি কঠিন শীতের মুখোমুখি হচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, এটি ২০২৩ সালে অনেক দেশকে মন্দার দিকে ঠেলে দেবে। গ্যাসের দাম সম্ভাব্য ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ফলে সার ও তেলের মতো পণ্যের দাম বাড়বে। ইউরোপের বাইরে এর অভিঘাত ছোট হবে। তবে উচ্চ মূল্যম্ফীতির বিরূপ প্রভাব বহাল থাকবে।
অবশ্য এসব সত্ত্বেও এবার এশিয়া ভালো অবস্থানে রয়েছে। এএনজেড রিসার্চের এশিয়া বিভাগের প্রধান খুন গোহ বলেছেন, এবার এশিয়ায় ১৯৯৭ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলে মনে করি না। এশিয়ার অন্তর্নিহিত সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলো এখন নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ের তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে। এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংয়ের এশিয়া বিভাগের প্রধান অর্থনীতিবিদ লুই কুইজ বলেন, এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে সংকটের আশঙ্কা কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বমন্দা বাংলাদেশের জন্য একটা সুখবরও বয়ে আনতে পারে। মন্দার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমে যেতে পারে। শিল্পের কাঁচামাল, খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় কমলে বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ কমে আসবে। তবে বিপদও আসতে পারে। রপ্তানি ইতোমধ্যে কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন রপ্তানি আদেশ আমেরিকা থেকে না কমলেও ইউরোপ থেকে কমেছে। আগামীতে আমদানি ব্যয় কমলেও রপ্তানির ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আরেকটি সমস্যা হলো বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের সুদহার বেড়ে গেছে। বাইরের কিছু ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকের এলসি গ্রহণ করতে চাইছে না। তাদের অভিযোগ, মুদ্রাবাজারের অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো সময়মতো এলসি নিষ্পত্তি করতে পারছে না। সার্বিক পরিস্থিতিতে আগামীতে মুদ্রাবাজার অবশ্যই ঠিক রাখতে হবে। কিন্তু বাস্তবে সমস্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে। যেমন- বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন একই মুদ্রার একেক রকম দর কার্যকরের সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর রেমিট্যান্স কমে গেছে।
অন্যদিকে রিজার্ভ বাড়াতে হলে ডলার আয় বাড়াতে হবে। আগামীতে রপ্তানির মাধ্যমে হয়তো আয় খুব একটা বাড়ানো যাবে না। এ ছাড়া আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের প্রবণতাও তো বেড়ে যেতে পারে মুদ্রা বিনিময় হারে পার্থক্যের কারণে। কাজেই এ ক্ষেত্রে প্রধান উপায় হচ্ছে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়ানো। প্রতি মাসে ২২০ থেকে ২২৫ কোটি ডলার যদি আসে তাহলে স্বস্তির জায়গাটা থাকবে। এ ছাড়া আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আড়াই থেকে তিন বিলিয়ন ডলার পাওয়া গেলে তা রিজার্ভে যোগ হবে। তবে সবচেয়ে টেকসই পদক্ষেপ হবে রেমিট্যান্স বাড়ানো।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক মন্দা নাও ঘটতে পারে বলে মনে করছে অক্সফোর্ড ইকোনমিকস। সংস্থাটি বলছে, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ আগামী বছর বা তারও বেশি সময় মন্দার মধ্যে পড়তে পারে। তা সত্তে¡ও বিশ্বব্যাপী মন্দা এড়ানো অস্বাভাবিক নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৮০-এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত ৯ বার মন্দার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র পাঁচবার সংকট দেখা গেছে। বাকি ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়নি।