বিশ্ব পঙ্গু দিবস সাবধানতাই পঙ্গুত্ব থেকে দূরে থাকার উপায়

22

খন রঞ্জন রায়


গত ১৫ মার্চ বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব পঙ্গু দিবস। এই শব্দটি প্রতিটি সচেতন মানুষের মন প্রবলভাবে নাড়া দেয়। অজ¯্র নির্বুদ্ধিতার মধ্যেও জীবন সম্বন্ধে সংশয়ের চিত্র ফুটে ওঠে। কিছুটা ভিন্নার্থে। হাজারটা বেদনামিশ্রিত এই শব্দ ইংরেজিতে-এর সমার্থক শব্দে ভেদবিভেদ থাকলেও বাংলায় এর ভাবনা মোটামুটি সঙ্গতিপূর্ণ। পঙ্গু, খোড়া, ল্যাংড়া, ল্যাংচা, দুর্বল, অচল, ব্যর্থ, রুগ্ন, বিকল, বিকলাঙ্গ, বিকৃতাঙ্গ, বাতিল, অকার্যকর, অক্ষম, স্বাস্থ্যহীন, অসম্পূর্ণ, বলহীন, হীনবল ইত্যাদি বিশেষ্যপদে ডাকা হলেও মূলত স্বাভাবিকভাবে চলার শক্তি নেই এমন অবস্থাকেই বুঝায়। এই শব্দের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এক প্রকার দৈহিক বিকার থাকে। পক্ষাঘাত বলেও আক্ষেপের সাথে বুঝানো হয়।
মাংসপেশী স্বাভাবিক কাজ করার বদলে দুর্বল-শিথিল-আড়ষ্ট হলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অচল হয়। কার্যকারিতা কমে যায় কিংবা একেবারে শূন্য হয়। তখনই স্পর্শ- অনুভূতিহীন হয়। এর বিভীষিকাময় ফল পঙ্গু বা পঙ্গুত্ব। স্বল্পস্থায়ী হলে কিছুটা নিরাময়ের সম্ভাবনা থাকে। দীর্ঘস্থায়ী হলেই এর ভয়াবহ রূপ পঙ্গুত্ববরণ। কিছু রোগের সাথে পঙ্গু শব্দটির গভীর সংমিশ্রণ আছে। স্ট্রোক থেকে পঙ্গু হওয়ার অন্যতম আদর্শ জায়গা। এছাড়া কিছু রোগ যেমন পোলিও, পর্কিনন্সন্স ডিজিজ, গুলেবারে সিনড্রোম, জন্মগত সিফিলিস, মালটিপল স্পেক্লরোসিস, সোরিব্রাল পালসি ইতাদি রোগের অন্তর্গত দ্ব›েদ্বও পেশীর দৌর্বল্য থেকে পঙ্গু হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। পেশীজনিত কিংবা ¯œায়ুজনিত কোনো রোগের পাকে পড়লেও পঙ্গু হয়ে যেতে পারে মানবদেহ। নিয়তির পরিহাসে জন্মগত পঙ্গু বিকলাঙ্গতা-তো ছায়ার মতো পরিবারের বেদনাবিরহের কারণ হয়। সমাজ ও সময়ে এই বিষয়টি সর্বাত্মক সংকট সৃষ্টি না করলেও বিজ্ঞানীরা গবেষণায় প্রমাণ করেছেন সাধারণের অলক্ষ্যে প্রতি ৫০ জনে ১ জন কোনো না কোনোভাবে শারীরিক বিকলাঙ্গতার শিকার।
বিকলাঙ্গ আর পঙ্গু সমার্থক শব্দ হলে আজকের বিষয় মূলত মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে জীবনবোধ নিঃস্বার হওয়া বা পঙ্গুত্ব বরণ করা। এখানে অবহেলাকেও আমলে আনা যায়। বিশেষত দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার প্রকারভেদ থাকলেও প্রকারান্তরে সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টিতেই পঙ্গু হওয়ার করুণ চিত্র ভেসে ওঠে। প্রবহমান সাধারণ জীবনবোধকে হতাশ করে।
এই কথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় বহু মানুষের জীবনে পঙ্গুত্বের অভিশাপ নেমে আসে। বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা যায় সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানির চেয়ে পঙ্গুত্ব হওয়ার সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। একটিমাত্র দুর্ঘটনায় অনেকে পথের ভিখারী হয়। যে ব্যক্তি টাটকা মাছ, নির্ভেজাল দুধ আর নির্ভেজাল শাক-সবজি-ঘি খেয়ে জীবন ধারণ করেছে একটি দুর্ঘটনা তাঁর জীবন সব ওলটপালট করে দিয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরÑ
‘যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরনীতে
যে নদী মাঝ পথে হারালো ধারা
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা’র- মতো বিকৃত স্বস্তি নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। বাংলাদেশের অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা এখন স্বাভাবিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট, পুলিশের সংুশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান সংস্থা, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট, বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি, নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের কঠিনেরে ভালোবাসার মতো তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৩ জন এবং বছরে প্রায় সাড়ে আট হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে সড়ক দুর্ঘটনায়। নানা ঘাত-প্রতিঘাত সহ্যর মধ্য দিয়ে পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকে বছরে প্রায় ২৫ হাজার প্রাণ। দিন দিন এই সংখ্যা গুণিতক হারে বাড়ছে।
এশিয়ার সর্ববৃহৎ ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুর্নবাসন প্রতিষ্ঠান যেটি পঙ্গু হাসপাতাল নামে সমধিক পরিচিত, এই এক হাসপাতালেই বছরে প্রায় ২ লাখ রোগী দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসে। এখানে রোগী ভর্তি হওয়ার স্রোত গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্তর হিসাবে নয়। নিয়মিত কালনিরবধি। এখানে ভালোমানের চিকিৎসা পাওয়ার সততা আর সৌন্দর্য ভাগ্যের ব্যাপার। পেলে মনে হয় ‘হাতের মোয়া’ পেয়েছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানে জাতীয় মানদÐের চিকিৎসা প্রদানের পরও বছরে ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী পঙ্গুত্ব বরণ করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতে হয়-এর সবটাই মনুষ্যসৃষ্ট কারণের ফলাফলে। এখানে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের বেশিরভাগই চাষী, মুটে, মজুর, মাঝি, মাল্লা, দারোয়ান, সুইপার নিম্ন বেতনভুক্ত চাকুরীজীবী। এরপর রয়েছে সারা দেশের বৃহৎপরিসরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগ, প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতাল, ট্রমা হাসপাতাল যা রুট লেভেল পর্যন্ত বিস্তৃত। সামর্থ্যবানদের-তো বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত সুরম্য অট্টালিকার দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার আলোঝলমলে হাসপাতালসমূহ কাছে টানেই। অবশ্য দুর্ঘটনা কবলিত ‘আলালের দুলালরা’ অপরাজেয় শক্তির এইসব হাসপাতালে যেতে কোনো কার্পণ্য করে না। বরং অপার গুরুত্ব অনুধাবন করে। সারা দেশব্যাপী বিস্তৃত দুর্ঘটনাজনিত এইসব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান কী পরিমাণ মানুষ পঙ্গুত্বের অভিশাপে নীলকন্ঠী-নীলমণি হয় তার কোনো হিসাব নেই। কেউ রাখেও না।
সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ছাড়াও আরেক প্রাসঙ্গিক চিন্তার দুর্ঘটনা অগ্নিকাণ্ড। এখানেও নানা সংকট ও সংশয়ের মধ্যে অগ্নি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আসা রোগীদের মধ্যে প্রতিদিন প্রায় ১৬ জন রোগী মারা যায়। বছরে অগ্নিদুর্ঘটনায় তিরোধান ঘটা মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। প্রাণে বেঁচে যাওয়া বেচারারা বড় অসহায় জীবনযাপন করে। সর্বোচ্চ ও মহতী এই চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান অগ্নি-আহত মানুষদের আশার বাতিঘর হলেও এখানেই প্রতিবছর প্রায় ১২ হাজার মানুষের পঙ্গুত্ববরণের সংকটময় ইতিহাস আছে।
পরিশ্রম-ত্যাগ ও সংযমী চিকিৎসার আরেক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতাল। যে কোনো ধাঁচের দুর্ঘটনায় স্নায়ুয়ুতন্ত্রের আঘাত নিরাময়ের নির্ভরশীল এই হাসপাতাল। মানবদেহের চলৎশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে স্নায়ুতন্ত্র। এখানে সামান্যতম আঘাত পঙ্গুত্বের সাথে ‘মিতালি’ গড়তে পারে। বিপুলা এই পৃথিবীতে  স্নায়ুবিক আঘাত কারো কারো মুখে ‘বিষ ঢেলে’ দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, অবস শব্দটি কারো জীবনে এসে ভিড় করতে দেখা যায়। এই কারণেই যে কোনো দুর্ঘটনা যেন বিস্তৃত হতে না পারে তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নয় কেবল- বিশ্বজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আঘাতজনিত পঙ্গু হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতাকে অন্যতম বেদনার কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে- প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১২ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় ‘সড়ক দুর্ঘটনা’। আক্কেল গুড়ুম হওয়ার মতো তথ্যে তাঁরা দেখিয়েছে প্রতিবছর ৫ কোটির বেশি মানুষ আহত হয়। গুরুতর আহতদের অধিকাংশই পঙ্গুত্ব নামক বিষম কষ্টকর জীবন বহন করছে।
বরাবর হতাশ হওয়া সড়ক দুর্ঘটনার আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে সরকারের পাশাপাশি অনেক সংস্থা, সংগঠন নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করছে। চালক ও জনসাধারণকে সচেতন করতে নানা উদ্যোগ ও কর্মসূচি চালু রয়েছে। রয়েছে নিরাপদ সড়ক পরিবহন আইন। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে করা এই আইনে চালককে কঠোর শাস্তির পাশাপাশি দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত, ক্ষেত্রবিশেষ মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারকে আর্থিক সহায়তার কথা বলা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে ‘ঘন মেঘের মাঝে এক টুকরা রোদ’ দেখা যাচ্ছে। দেশের রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত সকল যানবাহনের বৈধ কাগজপত্র নবায়ন করার সময় আলাদা অনুদান আদায় শুরু হয়েছে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক সমুদয় জমা এইসব অনুদান থেকেই ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে। তবে তা পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করতে কত সময় লাগবে কিংবা আদৌ হবে কিনা তা সময় বলে দিবে। এই ধারাটির প্রতি সাধারণ মানুষের দুর্বার ও দুরন্ত আকর্ষণ থাকলেও এর বিরোধীপক্ষের শিকড় বহু গভীরে প্রোথিত।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৬০ ভাগ কারণ মোটরসাইকেল। মোট মৃত্যুর ৪০ ভাগ দায়ী এই বাহন। দেশে নিবন্ধিত ৫৫ লাখ মোটর গাড়ীর মধ্যে ৪০ লাখই মোটরসাইকেল। মোট যানবাহনের ৬৮ শতাংশ। দুর্বৃত্তদের সুবিধা দিতে অবৈধ মতাদর্শের অনিবন্ধিত মোটরসাইকেলের হিসাব এখানে অন্ধকারে। মোটরসাইকেল বিপণন কোম্পানিগুলো বছরে প্রায় ৫ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি করে। বিশাল বাজার। বিষম পরিকল্পনা। উঠতি বয়সি তরুণ প্রজন্মের ভোগের সংস্কৃতির শক্তিমান অংশ। সরকারও শান্ত সাহসে এগিয়ে যাচ্ছে।
২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনায় এগুচ্ছে। যদিও বাস্তবতা বড় কঠিন। দুর্ঘটনার শেষ স্মৃতিতে ছোপ ছোপ দাগ। এই লক্ষ্য সামনে রেখে পরিবহন চালক, মোটরসাইকেল ব্যবহারকারী, পথচারিদের আরো অধিক সচেতন হতেই ‘বিশ্ব পঙ্গু দিবস’। বিশ্বব্যাপী বেশ আন্তরিকতা নিষ্ঠা ও নানাভাবে সমন্বয় গ্রহণের শিক্ষা দিয়ে পালন করলেও আমাদের সংস্কৃতিতে তা তিরোহিত। গুরুত্বহীন। দায়সারা। অথচ এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থোপেডিক হাসপাতাল বাংলাদেশে। তাঁরা কেবল তাঁদের নিয়েই ব্যস্ত। বাস্তবতা এমনই যে অন্যদের দিকে তাঁদের তাকানোর সময় নেই। তাঁরা যদি পঙ্গুত্বের কারণ প্রতিকার, প্রতিরোধ আর আনুসঙ্গিক বিষয় নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস চালাতেন তবে তা হতো প্রাতিষ্ঠানিক। ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হতো দুর্ঘটনা। পঙ্গুত্বের সীমাহীন কষ্টের মাঝেও খুঁজে পেতো নতুন সূর্যোদয়ের আভা।
লেখক : সমাজকর্মী