বিশ্বময় মুজিববর্ষ

65

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বাঙালির মণিকোঠায় স্থান পাননি। তিনি ছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ও আপন সত্তার মতো। তিনি রাজনৈতিক দার্শনিক, নীতি ও আদর্শের পথিকৃৎ। তার জন্মের পূর্বে এবং পরে যারা এই উপমহাদেশের জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং রাজনীতির নানা ক্ষেত্রে অবদান রেখে ইতিহাসে সমাদৃত হয়েছেন, তাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দর্শন ও ভাবনার জায়গায় পার্থক্য ছিল। বাঙালির টেম্পামেন্ট মনে ও হৃদয়ে ধারণ করে রাজনীতি করতেন বঙ্গবন্ধু। এজন্য তাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলা হয়। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসও তাই অনুসরণ করতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র লিখেছিলেন ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে ….’। কবি আবদুল হাকিম তার কবিতায় বাঙালি হতে আহŸান করেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশ প্রেম আর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের তেজোদীপ্ত কাব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সাহসী ও মানবিক করে তুলেছিল। জীবনানন্দ দাশের মা কুসুম কুমারী দাশ লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে হবে কবে….. কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’। বঙ্গবন্ধু জীবনানন্দ দাশকে খুব বেশি ভালবাসতেন। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও রাজনীতিতে এদের প্রভাব রয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে আরো বলতে হয় রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু যাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত হয়েছিলেন তাদের জীবনী আলোচনায় দেখা যায় তাদের চেয়ে অনেক উঁচু মাত্রায় দর্শন বঙ্গবন্ধু জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। উদাহরণ দেখা যায়, মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) দীর্ঘ সময় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে এসে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী যত আন্দোলন তন্মধ্যে ‘চম্পাবন আন্দোলন’ (১৯৭১), ‘আইন অমান্য ও ভারত ছাড় আন্দোলন’ (১৯৪২) মহাত্ম গান্ধী করেছিলেন, তার মধ্যে দু-একটি ছাড়া কোনো আন্দোলনই সফলভাবে যবনিকা পায়নি। বারবার রাজনৈতিক কৌশল, নির্দেশনা পরিবর্তন করতে হয়েছে। এমনকি ব্রিটিশরা ও কংগ্রেসের (১৮৮৫) রাজনীতিকে ‘আবেদন, নিবেদন, প্রতিবেদন, কাঠামোভিত্তিক রাজনৈতিক দল মনে করতেন। অরবিন্দু ঘোষ, বিনায়ক দামোদার াসাভারকার প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশটদের জেল-জুলুম সহ্য করতে না পেরে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি মহাত্মা গান্ধীজী নিজেও আশ্রমে থাকতেন।
আরো বলা যায়, পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬-১৯৪৮) বলেছিলেন ‘দ্বি জাতি তত্ত¡’ কিন্তু তিনি প্রচার করেছেন ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক রাষ্ট্র হবে। হয়েছিলও তাই। রাজনৈতিক জীবনে ধর্ম-কর্ম করেছেন, এমনটা তার আত্মজীবনীতে নেই। কিন্তু টুপি পরতেন সবসময়। তার পরিহিত টুপির খ্যাতি ছিল ‘জিন্নাহ টুপি’ হিসেবে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগ (১৯০৬) রাজনৈতিক দলটি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিম উদ্দিন প্রমুখ রাজনীতিবিদদের পকেটের দলে পরিণত হয়েছিল।
বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলার আপামর মানুষের একজন। তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি। প্রসঙ্গ আরো বলা যায় শেরে-ই বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বড় মাপের রাজনীতিবিদ ছিলেন। কিন্তু বাঙালির মুক্তির জন্য তেমন ত্যাগ স্বীকার করতে পারেননি। ফজলুল হক সাহেব প্রথম ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ নামে রাজনৈতিক দল করেছিলেন। পরে ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’ নামে তিনি দল পরিচালনা করেন। দু’টো রাজনৈতিক দলের কোনোটিই জনগণের জন্য তেমন অবদান রাখতে পারেনি। তিনি ইংরেজিতে কথা বলতেন, এমনকি উর্দুতেও খুবই পারদর্শী ছিলেন। জানা যায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলা ভাষা ব্যবহার করতেন কদাচিৎ। ইংরেজি সাহেবদের মতোই তার চাল-চলন ছিল। তিনি রাজনীতি করতেন কলকাতা ও পাঞ্জাবে। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাংলা ভাষা বলতেন কৃষকদের মুক্তির জন্য। ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তি ধর্ম হলেও তিনি কৃষক শ্রেণির দাবি-দাওয়া নিয়েই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু। তাঁর দ্বিতীয় রাজনৈতিক দল ন্যাপ (১৯৫৭)। এ দলটি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। বাঙালির আরাধ্যধন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আদর্শের ও রাজনীতির বিকাশ কখনও পরিবর্তন করেননি। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ এর প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলেন। দীর্ঘ সময় এ দলের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদাত বরণের আগ-মুহ‚র্ত পর্যন্ত একই দলের সভাপতি ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলার গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার নিসর্গ প্রকৃতির সন্তান। মাটি আর মানুষের জন্য যিনি বেড়ে উঠেছিলেন, তিনি আজ বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির পিতা। আগামী ১৭ মার্চ ২০২০ খ্রি. থেকে ১৭ মার্চ ২০২১ খ্রি. সময়ে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মুজিব বর্ষ পালিত হবে। স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশের মানচিত্রে যাঁর নেতৃত্বে তিনি আজ বিশ্ব স্বীকৃত। এই বিশ্বনেতার জন্মশত বার্ষিক উদযাপন শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। বিশ্বের ১৯৫টি দেশে পালিত হবে মুজিববর্ষ। গত ২৫ নভেম্বর ২০১৯ খ্রি. সোমবার ইউনেসকোর সদর দপ্তর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর ৪০তম সাধারণ অধিবেশনে ইউনেসকোর সাধারণ পরিষদের সভাপতি আলাতে সেনজাইজারের সভাপতিত্বে ইউনেসকো মহাপরিচালক মিজ অদ্রে আজুল এবং বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি’র উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত প্লেনারি সেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ইউনেসকোর সঙ্গে যৌথভাবে উদযাপনের প্রস্তাবনা সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিমÐলে বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন আরো ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ ৫৫ বছরের দীর্ঘ ইতিহাসের পরতে পরতে খোকা থেকে শেখ মুজিব, শেখ মুজিব থেকে শেখ সাহেব, শেখ সাহেব থেকে বঙ্গবন্ধু সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার সবটুকু বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ জানতে পারবে। যে সকল চক্রান্তকারী ষড়যন্ত্রী চক্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করে ইতিহাসের পাতা থেকে-বাঙালির হৃদয় থেকে, বিশ্বের বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, তারা আবারো পরাজিত হলো। যতদিন পৃথিবী টিকে থাকবে-ততদিন থাকবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।