মো. দিদারুল আলম
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সর্বশেষ যোগ্যতা হিসেবে মাস্টার্স পাসকৃত শিক্ষার্থীদের প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়, যা বিশ্বের কোথাও নেই। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী সদ্য পাস করে কোনো একাডেমিক ও গবেষণার প্রশিক্ষণ ছাড়াই সরাসরি ক্লাসে পাঠদান শুরু করে। অথচ প্রয়োজন ছিল অন্তত এক সপ্তাহ কিংবা পনেরদিন পর্যন্ত ক্লাস নিতে দেওয়া, স্বীকৃত জার্নালে কমপক্ষে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করা। বিশেষ করে অনটেস্ট পাঠদান বিষয়ে শিক্ষার্থী ও বিভাগীয় শিক্ষকদের মূল্যায়নের উপর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা উচিৎ। প্রার্থী এক্ষেত্রে সন্তোষজনক ক্লাস করতে না পারলে সরাসরি তাকে জানিয়ে দেওয়া উচিত আপনার রেজাল্ট ভালো কিন্তু ভালোভাবে ক্লাস নিতে পারেন না। এখন দেখা যায়, নানা তদ্বির ও রাজনৈতিক কারণে অনেককে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে অনেকেই সন্তোষজনক ক্লাস নিতে পারেন না। এ ধরনের শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন শেষ না হওয়া পর্যন্ত সহ্য করতে হয় এবং এখন তা করতে হচ্ছে।
প্রায়ই দেখা যায়, একজন প্রভাষক যোগদান করার পরপরই তার উচ্চশিক্ষার জন্য খুঁজতে থাকেন ভালো একটি স্কলারশিপ। সুযোগ পেলেই চলে যান এমএস কিংবা পিএইচডি করার জন্য। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়মানুসারে শিক্ষাছুটি নিয়ে বিদেশে কাটিয়ে দেন ছয়-সাত বছর। এরপর ভালো সুযোগ পেলে দেশে বা বিদেশে বিভিন্ন ধরনের চুক্তিভিত্তিক চাকরির নিমিত্তে পাঁচ বছর বা ততোধিক সময়ের জন্য লিয়েন/প্রেষণে ছুটি কাটাতে থাকেন। এভাবে দেখা যায়, অনেক শিক্ষক তাঁর শিক্ষকতা জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় নিজ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম থেকে বিরত থাকেন।
ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগে এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলকে বিবেচনায় না নিতে বলা হয়েছে। অথচ সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, শিক্ষক পদে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৭.০০ [উল্লেখ্য শিক্ষার্থী হতে লাগে ৮.০০]। অনার্স-মাস্টার্স উভয়টিতে সিজিপিএ ৩.৩০। যারা ডিভিশন পদ্ধতিতে পাস করেছেন তাদের অনার্স-মাস্টার্স উভয়টিতে দ্বিতীয় শ্রেণি হলে চলবে। তবে অবশ্যই এসএসসি ও এইচএসসিতে প্রথম বিভাগ থাকতে হবে। অনার্স-মাস্টার্সে যারা সর্বোচ্চ সিজিপিএ কিংবা প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন, তারা আবেদনের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে যদি এসএসসি ও এইচএসসিতে প্রথম বিভাগ না থাকে। শিক্ষক নিয়োগে এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল ইউজিসি বলছে যে, এসএসসি ও এইচএসসি অপেক্ষা অনার্স-মাস্টার্স এর ফলাফলই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কলা অনুষদভুক্ত বাংলা ও ইংরেজি বিভাগে অনার্স-মাস্টার্স এর যে কোনো একটিতে সিজিপিএ /জিপিএ ৩.২৫ এবং অন্যটিতে ৩.৫০ থাকার শর্ত আরোপ করলেও এই নীতিমালা লংঘন করা হয়েছে। ইউজিসি যেখানে স্কোর বেশি চেয়েছে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কম চেয়েছে যেখানে স্কোর চাওয়াই হয়নি সেখানে দুটি প্রথম বিভাগ চেয়েছে। ইউজিসির নীতিমালা চবি কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় নেয়নি। তারা কি পছন্দের কাউকে নিয়াগ দেওয়ার জন্য এই বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ?
দুঃখজনক বিষয় হলো এমফিল, পিএইচডি এবং স্বীকৃত জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ এসবের কোনো গুরুত্বকে স্বীকার করে সামান্যও ছাড় দেওয়া হয়নি। ইউজিসি বলেছে অনার্স-মাস্টার্স এ ৩.২৫ ও ৩.৫০ এর কম চাইতে পারবে না বেশি চাইতে পারবে অথচ এখানে ৩.৩০ চেয়ে কম চাইতে পারলো তাঁরা অভিজ্ঞতাহীন ব্যক্তিদের শিক্ষক নিয়োগের কারণে শিক্ষকেরা নিজেরাই হিমশিম খান। তারা একই বিভাগ থেকে মাত্রই ছাত্রাবস্থা শেষ করেছেন, পড়ানোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। প্রফেশনাল ট্রেইনিং ছাড়া এই শিক্ষকেরা যখন শিক্ষার্থীদের সামনে যান, অনেক কাজই করে বসেন যেটা বয়সজনিত বিবেচনায় মানা গেলেও, শিক্ষকদের কাছে থেকে আশা করা যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখানে যোগ্য শিক্ষকরাও গবেষণা বাদ দিয়ে রাজনীতি করছে। কারণ তারাও জেনে গেছে পরিশ্রম করে গবেষণা না করে রাজনীতি করতে পারলে অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। নিজে পরিশ্রম না করার কারণে অন্যদের পরিশ্রমও এদের চক্ষুশূল। সিস্টেমের বিভিন্ন গলদে এদের মধ্যে যে সম্ভাবনা ছিল, তা পুরোটাই শেষ হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়া শিক্ষকদের অনেকেরই ১০/২০ বছওে কোনো গবেষণা নেই। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে সেই পরিচয় দেখিয়ে বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে গিয়ে আর ফেরত আসছেন না। কিন্তু ঝামেলা হচ্ছে, এরা বছরের পর বছর শিক্ষাছুটি নিয়ে বেতন নিচ্ছে। এদের অনেককে পরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই চাকরি থেকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে।
শিক্ষক নিয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মেধাবী ও আদর্শবান শিক্ষক নিয়োগ না হলে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর পত্রপত্রিকায় পাওয়া যায়। যদিও বিষয়গুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক, আর্থিক ও ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত, তবে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনার মাধ্যমে বিষয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
যা হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের বিকল্প নেই। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের এ পেশায় আগ্রহ বেশি দেখা যায়। তবে অনেক সময় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরা বঞ্চিত হন তাদের পছন্দের এই পেশায় আসতে। অনেকে অন্য কোনো চাকরিতে মনোনিবেশ করতে না পেরে হতাশা নিয়ে পাড়ি দেন উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে। সেখানে তারা মূল্যায়ন ও উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে মেধা ও মননশীলতা দিয়ে কাজ করে অবদান রাখছেন অন্যান্য দেশে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক