বিশ্বজুড়ে সুফিবাদী দর্শন

104

আ ব ম খোরশিদ আলম খান

ইসলামের দাওয়াতি তথা প্রচারের মিশন কোনো কালেই মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকেনি। প্রিয়নবী (দ.)’র জাহেরি হায়াত ও সাহাবাদের যুগ অতিবাহিত হবার পর ইসলামের প্রচার-প্রসার বহমান রাখেন আল্লাহর নৈকট্যধন্য ও অনুগ্রহপ্রাপ্ত আধ্যাত্মিক সাধক ব্যক্তিত্ব আউলিয়ায়ে কেরাম। তাঁদের উসিলায় ও অবদানে ইসলাম আজ বিশ্বজনীন ব্যাপ্তি লাভ করেছে। তাই, ইসলামের বিজয় নিশান বিশ্ব জনপদে প্রসারিত হবার পেছনে আল্লাহর ওলীদের ত্যাগ ও অবদানকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কেয়ামত পর্যন্ত বেলায়তের রাস্তা খোলা। শানে বেলায়ত তথা আউলিয়ায়ে কেরামের আধ্যাত্মিকতার বদৌলতে যুগে যুগে মানুষ ইসলামের দিকে ফিরে আসছে। পথহারা লক্ষ্যভ্রষ্ট দিশাহীন মানুষের আধ্যাত্মিক রাহ্বার তথা দিশারীই হলেন আউলিয়ায়ে কেরাম। তেমনি ঊনবিংশ শতকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্বদেশী ঘরানার-ভাবধারার একটি ত্বরীকা প্রবর্তন করেন গাউছুল আ’যম আল্লামা শাহ্সূফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) এবং এই ত্বরীক্বার পরিপূর্ণতা দান করেন গাউছুল আ’যম হযরতুল আল্লামা শাহ্সূফী সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবাভান্ডারী (ক.)। সকল ত্বরীকা ও ইসলামী দর্শনের নির্যাস ত্বরীকায়ে মাইজভান্ডারী মাধ্যমে দিশাহীন মানবজাতিকে আলোকিত পথের সন্ধান দেন মাইজভান্ডার শরীফের যুগল গাউছুল আ’যম। তাঁদেরই পদাংক অনুসরণ করে তাঁদের রক্ত ও আদর্শের উত্তরাধিকারী শায়খুল ইসলাম হযরত গাউছুল ওয়ারা শাহ্সূফী মাওলানা সৈয়দ মইনুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী ওয়াল হোসাইনী আল্-মাইজভান্ডারী(ক.)’র মাধ্যমে ত্বরীকায়ে মাইজভান্ডারীয়ার প্রচার-প্রসার বিশ্বজনীন রূপ লাভ করে। দীর্ঘ বর্ণাঢ্য সফল কর্মময় জীবনে হুজুর কেবলা (ক.) অসীম আত্মত্যাগের মাধ্যমে মাইজভান্ডারী ত্বরীকা ও দর্শন সর্বত্র প্রসারিত করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমায় ত্বরীকায়ে মাইজভান্ডারীয়ার আবেদন ও গ্রহণযোগ্যতা বহুমাত্রিক রূপ পায়। এর ধারাবাহিকতায় হযরত শাহ্সূফী সৈয়দ মইনুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী (ক.)’র প্রদর্শিত ও অনুসৃত সুন্নিয়ত, ত্বরীকত ও মানবসেবার মিশন জারি রেখেছেন তাঁরই পবিত্র শোণিতধারা ও খেলাফতপ্রাপ্ত স্থলাভিষিক্ত আওলাদ শাহ্সূফী হযরত মাওলানা সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী (মা.জি.আ.)। বুজুর্গ পিতা ও আপন মুর্শিদের পদাংক অনুসরণ করে তিনি কেবল বাংলাদেশে নয়; বিশ্বের নানা দেশে কষ্টসাধ্য সফর করে মাইজভান্ডারী ত্বরীকা ও দর্শনকে বিশ্ব পরিমন্ডলে সর্বোত্তম উপায়ে তুলে ধরে আসছেন। নিজ পিতা মুর্শিদে বরহককে তাঁর জীবদ্দশায় এ মহান উত্তরাধিকারী ছায়ার মতো অনুকরণ করতেন। শরীয়ত-ত্বরীকতের মহান জিম্মাদারি ও খেলাফতের দায়িত্ব ন্যস্ত করতে বুজুর্গ পিতা দীর্ঘকাল ধরে আপন পুত্রকে কাছে রেখে নকশ কদমে চলতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে প্রিয়নবী (দ.)’র সান্নিধ্য- সোহবতে কাটিয়ে দিয়ে কামালিয়তের উপযুক্ততা অর্জন করতেন; ঠিক তেমনি বুজুর্গ পিতার পাশে ও কাছে প্রতিমুহূর্ত অতিবাহিত করে এবং পিতার খেদমতে নিজেকে সঁপে দিয়ে আধ্যাত্মিকতার ছবক নিয়েছিলেন হযরত শাহ্সূফী সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী (মা.জি.আ.)। কারো নৈকট্য অর্জন করতে হলে আগে তাঁর সোহবত তথা সান্নিধ্যে আসতে হবে। সোহবত তথা সান্নিধ্য ছাড়া মুর্শিদ কর্তৃক খেলাফতের সৌভাগ্য অর্জন করা কঠিন। মুর্শিদ কেবলা বাবা হযরত সৈয়দ মইনুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী (ক.) এজন্যই আপন পুত্রকে নিজ দরবারের খেলাফত ও জিম্মাদারি অর্পণ করার জন্য শৈশব বয়স থেকেই নিজের পাশে রেখে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ত্বরীক্বতের সাধনা বড় সাধনা। সাধনা ছাড়া এবং আপন পীর মুর্শিদের অনুসরণ-অনুকরণ ছাড়া আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভ করা যায় না। তাই, পিতা কর্তৃক স্বীয় আওলাদকে আধ্যাত্মিকতার বিশাল দায়িত্ব অর্পণ করার আগে যোগ্য করে গড়ে তোলার সতত প্রয়াস চালিয়ে যান। হঠাৎ করে তিনি পুত্রকে ত্বরীকতের দায়িত্ব ন্যস্ত করেননি। পিতা কর্তৃক অনুগ্রহধন্য হয়ে এবং ফয়জ-বরকত লাভ করে মাইজভান্ডারী ত্বরীকা ও সিলসিলার যথাযথ খেদমত আন্জাম দিচ্ছেন হযরত সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী (মা.জি.আ.)। তাঁর প্রজ্ঞা, জ্ঞান, বিচক্ষণতা, দূরদর্শীতা, ধীশক্তি, ইলম ও আমলের ক্ষেত্রে অনন্য সাধারণ গুণের কথা সর্বজন বিদিত। শরীয়ত-ত্বরীকতের জিম্মাদারি তিনি পরিপূর্ণভাবে পালন করে আসছেন। ভক্ত জনতাকে শরীয়ত-ত্বরীকতের দিশা দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। সুন্নতি জীবনাচার, অতুলনীয় চরিত্র মাধুর্য, অনুপম আচার ব্যবহার ও ভক্ত মুরিদের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও আবেদন আজ প্রশ্নাতীত। ভক্ত ফরিয়াদি জনতার দুঃখ-দুর্দশা অভাব অভিযোগ মোচনে হুজুর কেবলা (মা.জি.আ.)কে সব সময় অগ্রবর্তী ভূমিকায় দেখা যায়। আশেক ভক্তদেরকে তিনি শুধু জাগতিক সমস্যা থেকে নিভৃতির পথ দেখান তা নয়; বরং আধ্যাত্মিকভাবে সবাইকে পরিশুদ্ধ নির্মল নিষ্কলুষ জীবনের পথ দেখিয়ে আসছেন। তিনি শুধু দেশের গন্ডিতেই সিমাবদ্ধ নয়। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও ছুটে গিয়ে স্বীয় জিম্মাদারি নিষ্ঠার সঙ্গে পালনে সচেষ্ট রয়েছেন। তাঁর ব্যতিক্রমী উজ্জ্বল চরিত্র মাধুর্য ও ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে অনেক মানুষ ফিরে আসছে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে। বিভ্রান্ত, দিশাহীন লক্ষ্যভ্রষ্ট মানুষ দলে দলে ত্বরীকায়ে মাইজভান্ডারী দিকে ঝুঁকে পড়ছে এ মহান বুজুর্গ ব্যক্তিত্বের বাস্তব পদক্ষেপ ও ব্যক্তিত্বের মহিমা গুণের উসিলায়। আওলাদে রাসূলদের (দ.) প্রত্যক্ষ প্রচেষ্টায় যুগে যুগে দেশে দেশে ইসলামের ব্যাপ্তি ঘটেছে। তেমনি প্রিয়নবী (দ.)’র রক্ত ও আদর্শের উত্তরাধিকারী হযরত সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানীর কল্যাণে দেশ-বিদেশে ইসলামের প্রচার দিন দিন ব্যাপকতা লাভ করছে। মাইজভাÐারী ত্বরীকা ও দর্শন তিনি সাংগঠনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে দেশে-বিদেশে সার্থকভাবে তুলে ধরে অনন্য কীর্তির স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।
হযরত শাহ্সূফী সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী মাইজভান্ডারী মাশায়েখে কেরামের প্রদর্শিত পথে, বিশেষত আপন বুজুর্গ পিতা ও মুর্শিদ কেবলার অসমাপ্ত দ্বীন, সুন্নিয়ত ও মাইজভান্ডারী দর্শনের দাওয়াতি মিশন বহমান রেখেছেন। এ লক্ষ্যে তাঁর ত্যাগ, কর্মকীর্তি ও অবদান অসামান্য। লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি সুদৃঢ়, কর্মপদ্ধতি তাঁর সূ², চিন্তাধারা তাঁর স্বচ্ছ ও গভীর, গন্তব্যে পৌঁছতে তাঁর সাধনা অত্যন্ত নিখাদ। এজন্যই তাঁর খ্যাতি ও কীর্তির কথা আজ সর্বমহলে ছড়িয়ে পড়েছে। কর্ম ও ব্যক্তিত্ব গুণে তিনি সুন্নিয়ত আকাশের ধ্রুব নক্ষত্র হিসেবে নিজের অবস্থান সমুজ্জ্বল করেছেন।
সূফিবাদই ইসলামের মূল নির্যাস। একটি শান্তিপূর্ণ সহনশীল মানবিক বিশ্ব গড়াই সূফি সাধকদের জীবন সাধনার মূল লক্ষ্য। গত ১৫-১৭ ফেব্রুয়ারি (২০২০) তুরস্কে তিন দিনব্যাপী যে আন্তর্জাতিক সূফি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো, এর অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী (মা.জি.আ.)। বাংলাদেশের পক্ষে তিনি সূফি ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে এতে তাঁর দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য বেশ প্রশংসিত হয় সুধী মহলে। সূফিবাদি দর্শন ও চিন্তাধারার আলোকে সারা বিশ্বে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে অসাধারণ কর্মকীর্তির স্বাক্ষর রাখায় এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে হুজুর কেবলাকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়। এ সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যে তিনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমারের নিপীড়ন-দমনের কথা তুলে ধরে মুসলিম বিশ্বসহ সকল দেশ ও বিশ্ব নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মুসলিম দেশগুলোকে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার ডাক দেন তিনি। তুরস্কসহ সকল দেশকে রোহিঙ্গা মুসলিম ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর এবং মিয়ানমারের ওপর বৈশ্বিক চাপ প্রয়োগের ওপর সবিশেষ জোর দেন। গত ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি তুরস্কের রাজধানী আনকারায় ধর্ম মন্ত্রণালয়ের রিলিজিয়ার্স এফেয়ার্স হাই কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ড. একরেম কেলেসের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় করেন। হুজুর কেবলার মতো একজন বরেণ্য আওলাদে রাসূলের (দ.) সান্নিধ্য পেয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন এবং তুরস্কের ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ উপহার দেন ড. একরেম কেলেস। হুজুর কেবলা তুরস্কে অবস্থিত প্রসিদ্ধ সাহাবি হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রাদ্বি.) এর মাজার ও মসজিদ কমপ্লেক্সে অতিথি হিসেবে পরিদর্শন করেন এবং এই মসজিদে জোহরের নামাজের ইমামতি করেন। এখানেও তাঁকে সংবর্ধিত করা হয়। শুধু তুরস্কে নয়, নানা সময়ে আরো বহু দেশে হযরত সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী সংবর্ধিত হচ্ছেন এবং বিশ্ববাসীর সপ্রশংসার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হচ্ছেন। তাঁর নূরানি অবয়ব ও সুষমা মাধুর্য দেখে যে কেউ মুহূর্তে আবিষ্ট হচ্ছেন। একজন আওলাদে রাসূল (দ.) হিসেবে তিনি দেশ-বিদেশে সর্বমহলে নন্দিত ও বরণীয়। তাঁর বংশীয় ঔজ্জ্বল্য সত্যি অনন্য। আমরা বহুমাত্রিক এ কীর্তিমান ব্যক্তিত্বের কৃপাধন্য হয়ে যেন সার্বিক জীবন পরিচালনা করতে পারিÑ এ প্রত্যাশা রইল।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক