বিমান হামলায় ধরাশায়ী হানাদার বাহিনী

3

জামাল উদ্দিন

৫ ডিসেম্বর ১৯৭১; এদিন বিধ্বস্ত হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অধিকাংশ বিমান। ভারতীয় যুদ্ধ বিমানগুলো সারাদিন অবাধে আকাশে উড়ে এবং পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। অকেজো করে দেয় তাদের বিমান ঘাঁটিগুলো।
ভারতীয় বিমান বাহিনীর হিসেব মতে, ১২ ঘণ্টায় ২৩২ বারে তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটিতে ৫০ টনের মত বোমা ফেলা হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কনভয়ের ওপর ভারতীয় বিমান আক্রমণ চালায়। এতে পাকিস্তান বাহিনীর ৯০টি গাড়ি ধ্বংস হয়। এছাড়া পাকিস্তানি সৈন্য বোঝাই কয়েকটি লঞ্চ ও স্টিমার ধ্বংস হয়।
বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডের সফল আক্রমণে ধ্বংস হয় পাকিস্তানি সাবমেরিন ‘গাজী’। সাবমেরিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তান ধার হিসেবে নিয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয়ে এটি একটি বড় আঘাত হিসেবে দেখা দেয়।
এদিনে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সব নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে বন্দর ত্যাগের পরামর্শ দেন। পাকিস্তানিরা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতেও তাদের অপারগতা প্রকাশ করে। প্রধান হুশিয়ারি ছিল চট্টগ্রাম বন্দর সম্পর্কে। বলা হয়, আপনারা সবাই চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে চলে যান। আপনাদের স্বার্থ ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমরা শনিবার তেমন বোমা বর্ষণ করিনি। আজ আপনাদের বের হয়ে আসার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। কাল আমরা প্রচন্ডভাবে আক্রমণ চালাব। সুতরাং কাল থেকে আপনাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারব না। এ সতর্ক বাণীতে দুটি কাজ হয়- এক, বিশ্বের সব দেশ বুঝল বাংলাদেশের বন্দরগুলো রক্ষা করার কোন ক্ষমতা আর পাকিস্তান বাহিনীর নেই। দুই, ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ ও বিমানগুলো সব বন্দরকে ঘায়েল করার সুযোগ পেল।
এদিকে তখন স্থল মিত্রবাহিনীও এগিয়ে চলেছে। পাকিস্তান বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন। ভারতীয় বাহিনী প্রধান সড়কগুলো দিয়ে না এগিয়ে বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান সড়কের কতগুলো জায়গায় অবরোধ সৃষ্টি করে। তাই ঢাকার সঙ্গে কুমিলা, চট্টগ্রাম এবং সিলেট-নাটোরের সঙ্গে, ঢাকা এবং রংপুর আর যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শুধু ঢাকার সঙ্গে যশোর ও খুলনার যোগাযোগ ব্যবস্থা তখনো অব্যাহত ছিল। কতগুলো ঘাঁটিতে সেদিন লড়াইও হয়। একটি বড় লড়াই হয় লাকসামে। আরেকটা লড়াই হয় ঝিনাইদহের কাছে কোট চাঁদপুরে। দুটি লড়াইয়ে পাক বাহিনী ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়। এর ফলে বিধ্বস্ত অবস্থায় তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংস দিয়ে অবরোধ করে। এখানে পাকিস্তান বাহিনী মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে। ফলে আখাউড়া সম্পূর্ণরূপে শত্রæমুক্ত হয়।
এ যুদ্ধে সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহী আমীর হোসেন, রেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান, সিপাহী রুহুল আমীন (বীরশ্রেষ্ঠ), সিপাহী সাহাব উদ্দিন ও সিপাহী মুস্তাফিজুর রহমান শহীদ হন। আখাউড়া মুক্ত হবার পর কিছু পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এদিন ১৬০ জন পাকিস্তানি সৈন্য মিত্রবাহিনীর হাতে নিহত হয়।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা : এদিন নিরাপত্তা পরিষদের পুনরায় যে অধিবেশন বসে তাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের এক প্রস্তাবে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক ‘রাজনৈতিক নিষ্পত্তি’ প্রয়োজন, যার ফলে বর্তমান সংঘর্ষের অবসান নিশ্চিতভাবেই ঘটবে এবং পাকিস্তান বাহিনীর সহিংসতার দরুন যে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজন একমাত্র পোল্যান্ড প্রস্তাবটি সমর্থন করা। চীন ভেটো দেয় বিপক্ষে। অন্য সকল সদস্য ভোট দানে বিরত থাকে। ঐদিন আরও ৮টি দেশের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে আর একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এবার সোভিয়েত ইউনিয়ন তার দ্বিতীয় ভেটো প্রয়োগ করে।
একই সময়ে ‘তাস’ মারফত এক বিবৃতিতে সোভিয়েত সরকার ‘পূর্ব বাংলার জনগণের আইনগত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে’ সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের দাবি জানান, এ সংঘর্ষ সোভিয়েত সীমান্তের সন্নিকটে সংঘটিত হওয়ায় ‘এর সঙ্গে সোভিয়েত নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত বলে উলেখ করে এবং পরিস্থিতির অবনতি রোধকল্পে বিবদমান পক্ষদ্বয়ের যে কোনটির সঙ্গে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য বিশ্বেও সকল দেশের প্রতি আহŸান জানান।
এদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তপ্ত অবস্থা চিন্তিত করে তোলে প্রবাসী সরকারকে। কারণ এদিনও ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব শ্রী কেবি লাল ‘বাংলাদেশ একটি বাস্তবতা’ বলে উলেখ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপর বলে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন। রাজনৈতিক এ পরিস্থিতি মুক্তিযোদ্ধাদের যাতে দুর্বল না করে তোলে তাই মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন।
পাকিস্তানি গভর্নর ডা. মালিকের সাহায্য আবেদন : এদিকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পুতুল শাসক গভর্নর ডা. মালিক দেশবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। তিনি বলেন, দেশ আক্রান্ত। ভারতীয়দের সহযোগিতায় কিছু ‘বিশ্বাসঘাতক’ দেশ আক্রমণ করেছে। এ দেশের সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করেছে। তাদের সাহায্য করার জন্য প্রতিরক্ষা তহবিল করা হয়েছে। সে তহবিলে মুক্তহস্তে সাহায্য করার জন্য তিনি সবার প্রতি আহব্বান জানান। তবে তার আহব্বানে কেউ যে এগিয়ে আসেননি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
জামাল উদ্দিন : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক ও প্রকাশক