বিমানের বেশক’জন স্টাফ গোয়েন্দা নজরদারিতে

84

বিদায়ী বছরের মধ্য অক্টোবর পর চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দুবাই থেকে আসা যাত্রীরা ব্যাগেজ রুলের আওতায় শুল্ক পরিশোধের প্রায় চার টন স্বর্ণের বার ছাড় করিয়ে নেন। বৈধ পথে রেকর্ড পরিমাণ স্বর্ণের বার আমদানির মধ্যেই গত ২২ ফেব্রæয়ারি দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটের দু’টি সিটের নিচে প্যানেলের ভেতর বিশেষ কায়দায় টেপ মোড়ানো অবস্থায় পৃথক প্যাকেটে করে ফের অবৈধ পথে নিয়ে আসা হয় দেড়শ’ পিস স্বর্ণের বার। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও কাষ্টমস কর্মকর্তারা চালানটি জব্দ করলেও দাবিদার মিলেনি।
বিমানবন্দরে কর্তব্যরত জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা ও কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, ফ্লাইটে করে আসা কোনো যাত্রীর পক্ষে সিটের নিচে প্যানেলের ভেতরে সুরক্ষিত জায়গায় লুকিয়ে এভাবে স্বর্ণের বার নিয়ে আসা সম্ভব নয়। দাবিদারহীন বা পরিত্যক্ত অবস্থায় ১৭ কেজি চারশ’ গ্রাম ওজনের জব্দকৃত এসব স্বর্ণের বার চোরাচালানের সাথে বাংলাদেশ বিমানের একাধিক কর্মচারী জড়িত থাকতে পারে। সন্দেহের তালিকায় থাকা মেকানিক্যাল বিভাগের এক কর্মচারী ও এক ক্লিনারকে এরইমধ্যে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা অভিযোগ এড়িয়ে গেলেও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা সন্দেহমুক্ত হতে পারছেন না। তাই ওই দু’জনসহ বিমানের বেশ ক’জন কর্মচারীকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
অপরদিকে, বিমানবন্দর দিয়ে বৈধ কিংবা অবৈধ পথে নিয়ে আসা স্বর্ণের বারগুলো আবার দেশের অলংকার শিল্প খাত বা বাজারে আসছে না। মূলতঃ মধ্যপ্রাচ্যের আরব আমিরাতের দুবাই এবং আবুধাবি থেকে নিয়ে আসা স্বর্ণের চালানগুলো বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করে পাচার হচ্ছে প্রতিবেশি দেশ ভারতে। আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র আরব আমিরাত ও ভারতে বসে আড়ালে থেকে চোরাচালানের এই কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে। এক্ষেত্রে, অস্ত্র ও ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের বিনিময় মূল্য হিসেবেও স্বর্ণের বার লেনদেনের তথ্য পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দারা। এ ব্যাপারে নিজস্ব অনুসন্ধানের পাশাপাশি পুলিশকেও তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
বিমানবন্দর শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক বাবুল ইকবাল এ বিষয়ে পূর্বদেশকে বলেন, মূলত অস্ত্র এবং ইয়াবার মত মাদকের বিনিময় মূল্য হিসাবেই এসব স্বর্ণের বার ব্যবহার করা হচ্ছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তাই অবৈধ স্বর্ণের বার জব্দের পাশাপাশি বৈধ পথে ছাড় করা স্বর্ণের গন্তব্য আসলে কোথায় সেটাও অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে পুলিশকেও তদন্ত করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, বিদায়ী বছরের ১ ও ১৫ অক্টোবর যাত্রীসহ অবৈধ স্বর্ণের বারের পৃথক দু’টি চালান জব্দের পর বিমানবন্দর কাস্টমসে ব্যাগেজ রুলের আওতায় স্বর্ণের বার ছাড় করানোর হিড়িক পড়ে। ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত রেকর্ড চার মেট্রিক টন স্বর্ণের বার শুল্ক পরিশোধের মাধ্যমে ছাড় করিয়ে নেন দুবাই ও আবুধাবি ফেরত যাত্রীরা। এই সময়ের মধ্যে বিমানবন্দরে আর কোনো অবৈধ স্বর্ণের চালান জব্দ হয়নি। সর্বশেষ গত ২২ ফেব্রæয়ারি সকালে আবুধাবি থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দরে অবতরণ করা বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট বিজি ওয়ান-টু-এইটে বিপুল পরিমাণ অবৈধ স্বর্ণের বার রয়েছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালায় কাস্টমস ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। তল্লাশির এক পর্যায়ে ওই ফ্লাইটের দুই সিটের নিচে প্যানেলের ভেতরে টেপ মোড়ানো অবস্থায় বিশেষ কায়দায় রাখা দু’টি প্যাকেট থেকে ১৭ কেজি চারশ’ গ্রাম ওজনের দেড়শ’ পিস অবৈধ স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়। আনুমানিক ১০ কোটি টাকা বাজারমূল্যের এসব স্বর্ণের বারের কোনো দাবিদার পাওয়া যায়নি। দাবিদার না পেলেও ফ্লাইটের ভেতরে এমন সুরক্ষিত জায়গায় এভাবে স্বর্ণ পাচারের সাথে বিমানের কেউ না কেউ জড়িত বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। এ কারণে প্রাথমিকভাবে সন্দেহের তালিকার শীর্ষে থাকা বিমানের দুই কর্মচারীকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। তারা নিজেদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও ওই দু’জনসহ কয়েকজনকে নিবিড় গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, বিমানের ভেতরের কেউ জড়িত না থাকলে এমন সুরক্ষিত জায়গায় অভিনব কায়দায় স্বর্ণের বার নিয়ে আসা সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে দেশে দেশে জারি করা লকডাউন বা অবরুদ্ধ অবস্থা ধীরে ধীরে শিথিল হওয়ার পর মূলতঃ গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকেই শাহ আমানতসহ দেশের বিমাবন্দরগুলো থেকে আন্তর্জাতিক রুটে সীমিত আকারে যাত্রীবাহী বিমান চলাচল শুরু হয়। বিমান চলাচল শুরু হওয়ার পর গত বছরের ১ ও ১৫ অক্টোবর বিমানবন্দরে দায়িত্বরত জাতীয় গেয়েন্দা সংস্থা ও শুল্ক কর্তৃপক্ষ বিমানের পৃথক দু’টি ফ্লাইট থেকে অবৈধ পথে নিয়ে আসা ২৪২ পিস স্বর্ণের দু’টি চালান জব্দ করে। এরপর থেকেই বিমানবন্দর কাস্টমসে শুল্ক পরিশোধ করে স্বর্ণের বার ছাড় করানোর হিড়িক পড়ে। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে যেখানে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে শুল্ক পরিশোধ করে বা বৈধ পথে সবমিলিয়ে একশ’ চার কেজির কিছু বেশি স্বর্ণের বার ছাড় করানো হয়েছিল, সেখানে গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র চার মাসে বিদেশফেরত যাত্রীরা চার মেট্রিক টন স্বর্ণের বার শুল্ক পরিশোধের মাধ্যমে ছাড় করান। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বৈধ উপায়ে স্বর্ণের বার আমদানির পরিমাণ এক লাফে প্রায় ৪৫ গুণ বেড়েছে।