বিমানবন্দরে ল্যাব সংকটে অনিশ্চিত বিদেশযাত্রা

35

ফারুক আবদুল্লাহ

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর ল্যাব না থাকায় ৫ হাজার প্রবাসীর বিদেশ যাত্রা চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। দ্রুত সময়ে বিদেশগামী যাত্রীদের সংকট নিরসনে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পার্কিং গ্রাউন্ডে ল্যাব স্থাপনে স্থানও নির্ধারণ করা হয়। অথচ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো পিসিআর ল্যাব স্থাপন না হওয়ায় সে সংকট কাটছে না। এতে হুমকির মুখে পড়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার।
অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌদি আরবের পরেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২০১২ সাল থেকে কয়েক বছর শ্রমবাজার বন্ধ থাকার পর আবার খুললেও সুবিধা পাচ্ছেন না প্রবাসীরা। বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষার ল্যাব স্থাপনের দাবি দীর্ঘদিনের। পাশের দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল এমনকি উগান্ডা বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর ল্যাব অনেক আগেই স্থাপন করে কর্মী পাঠানো শুরু করেছে। অথচ বাংলাদেশে ফ্লাইট চলাচল বন্ধের আগপর্যন্ত বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব বসানোর বিষয়টি নীতি-নির্ধারকদের মাথাও আসেনি। যার কারণে শ্রমবাজার প্রতিযোগিতায় আরও পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।
বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমবাজারগুলোর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যের আটটি শ্রমবাজার থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ২৪৫ কোটি ডলার। চলতি বছরের জুলাই মাসে এসেছে ১০৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর আগস্টে এসেছে ১০২ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। শ্রমবাজারের কর্মীরা কোনো কারণে সংকটে পড়লে তার প্রভাব পড়তে পারে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে।
এদিকে গত ৬ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী দুই-তিন দিনের মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব বসানোর নির্দেশ দেন। দ্রুত সময়ে বিদেশগামী যাত্রীদের সংকট নিরসনে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পার্কিং গ্রাউন্ডে স্থানও নির্ধারণ করা হয়। এরপর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। এখনো পর্যন্ত বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষার পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হয়নি। এতে চট্টগ্রামে ৫ হাজারসহ সারাদেশের ২০ হাজার প্রবাসীর বিদেশযাত্রা চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। অনেক প্রবাসীর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আবার অনেকেই টিকিট করে বিদেশে যেতে পারছেন না। এছাড়া অনেকেই যাত্রা বিলম্ব হওয়ায় চাকরি হারানোর আশঙ্কায় রয়েছেন।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ ১৫টি দেশ থেকে শর্তসাপেক্ষে সম্প্রতি ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির নতুন নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় অনুমোদনের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে হবে। ভ্রমণ শুরুর আগে টিকা নেওয়া এবং ভ্রমণের সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা আগে পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষা করে করোনার নেগেটিভ সনদ পেতে হবে। এছাড়া যাত্রা শুরুর আগমুহূর্তে আবারও করোনার র‌্যাপিড টেস্ট বা পিসিআর টেস্ট করাতে হবে। তবে দেশের কোনো বিমানবন্দরে পিসিআর পরীক্ষার সুবিধা না থাকায় নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার পরও আটকে পড়া প্রবাসীদের আমিরাত যাত্রা সম্ভব হচ্ছে না। এতে তারা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় অনেক আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব আছে। এসব হাসপাতালে উন্নতমানের পিসিআর ল্যাব আছে। বিমানবন্দরে তাদের ল্যাব চালানোর সক্ষমতাও আছে। ওপেন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে ভালো ল্যাবকে অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।
বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা জানান, শাহ আমানত বিমানবন্দরে স্বাভাবিক সময়ে বছরে ১৬ লাখ যাত্রী আসা-যাওয়া করেন। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে দেশে করোনা মহামারি চলছে। করোনাকালীন এমন পরিস্থিতির পরেও দেশের বিমানবন্দরগুলোতে ল্যাব স্থাপন না হওয়া দুঃখজনক। এছাড়া শাহ আমানত বিমানবন্দরে হেলথের কোনও স্থায়ী সেটআপ নেই। একজন চিকিৎসক ও চুক্তিভিত্তিক ৬ জন চিকিৎসক রয়েছেন। কোনও যাত্রী করোনা আক্রান্ত হলে তাকে আলাদাভাবে রাখার নেই ব্যবস্থা। এতে অন্যরা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. শরীফ বলেন, আগে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এই ধরনের ল্যাব স্থাপনের চেষ্টা চলতেছে। তবে সবচেয়ে বেশি জরুরি জনবল সংকট নিরসন করা। কারণ শাহ আমানত বিমানবন্দরে হেলথের কোনও স্থায়ী সেটআপ নেই।
বিআইটিআইডি ল্যাবের প্রধান অধ্যাপক ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, আমাদের এখানে র‌্যাপিড পিসিআর মেশিনে করোনা পরীক্ষা ম্যানুয়ালি করা হয়ে থাকে। এতে অনেক সময় ব্যয় হয়। তবে পিসিআিরের নতুন মেশিন এসেছে। এই মেশিনে অটোমেটিক প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে করোনা পরীক্ষা ৬ ঘণ্টার কম সময়ে সম্ভব। যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দরগুলোতে ব্যবহার হচ্ছে।
এদিকে চট্টগ্রামসহ দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষায় র‌্যাপিড পিসিআর ল্যাব স্থাপনে প্রায় মাসখানেক ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন প্রবাসীরা। এই অনিশ্চয়তার অবসানে সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন তারা।
বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ইউএই প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শিবলী আল সাদিক বলেন, আজকে হাজার হাজার প্রবাসী মাঠে আন্দোলন করছে এটা কখনো কাম্য ছিল না। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অতি দ্রুত সময়ে র‌্যাপিড পিসিআর টেস্ট ল্যাব স্থাপন করতে পারে। ল্যাব স্থাপনের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি বিদেশে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুন্ন করছে। আমরা জানতে পেরেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী র‌্যাপিড পিসিআর ল্যাব বসানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আশাকরি তা বাস্তবায়ন হলে প্রবাসীদের যে দাবি ছিল তা পূরণ হবে।
দীর্ঘ ২৩ বছর ব্যবসা পরিচালনা করছেন চট্টগ্রামের ইকবাল হায়দার সিকদার। তিনি বলেন, আমি দেশে এসেছি ৫ মাস ৯ দিন হচ্ছে। তিনমাসের বেশি দেশে থাকি না। এয়াপোর্টের জটিলতার কারণে দেশে আটকে পড়েছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও তা দ্রুত সময়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এতে চাকরি হারাচ্ছেন অনেকেই। ভিসার মেয়ার চলে যাচ্ছে। পারিবারিকভাবে অসহায় হয়ে পড়ছে। সরকার আন্তরিক হলে ৭ দিনের মধ্যে সবকিছু করা সম্ভব। এছাড়া প্রবাসীদের অনেক ক্ষোভ আছে। সবতো আর বলা যায় না। আমরা পরিস্থিতির শিকার।
চট্টগ্রাম জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল আলম মজুমদার বলেন, চট্টগ্রামে ১৫ লাখের মতো প্রবাসী রয়েছেন। এদের মধ্যে আনুমানিক ৫ হাজার সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসী। দেশের বিমানবন্দরগুলোতে পিসিআর ল্যাব না থাকায় এসব প্রবাসী দেশে এসে আটকা পড়েছেন। ইতোমধ্যে ঢাকা বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব বসানোর কার্যক্রম চলছে বলে শুনেছি। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরসহ সিলেট বিমানবন্দরে ল্যাব স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ পিসিআর ল্যাবে একটি টেস্ট করাতে হলে ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় লাগে। এতো প্রবাসীর একসাথে টেস্ট করাও সহজ বিষয় না। এছাড়া এর জন্য জনবল ও অবকাঠামো আমাদের বিমানবন্দরগুলোতে নেই। তবে ঢাকায় খুব দ্রুত সময়ে ল্যাব স্থাপন হলে সংকট অনেকটাই কমে আসবে।