বিভিন্ন সূচকে বর্তমানে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে আছে

200


প্রতারণা ও ধোকাবাজি সেই ১৯৪৭ সাল বা তার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। আমাদের নেতা শেরবাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র ইংরেজিতে States শব্দটি লাগিয়েছিলেন। পরবর্তিকালে বর্তমান পাকিস্তানের নেতারা States শব্দটির ‘S’ উঠিয়ে দিয়ে এক পাকিস্তান বানিয়ে আমাদেরকে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ বানিয়ে এবং পাকিস্তানকে কেন্দ্রের রাজধানী বানিয়ে আমাদের ওপর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের সম্পদ পাকিস্তানে নিয়ে আমাদের ওপর চরম শোষণ, অত্যাচার, অবিচার, জুলুম নির্যাতন চালায়। ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে ৬ দফা ভিত্তিক নির্বাচনে গণরায় নিয়ে বাংলাদেশের স্থপতি আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বর্তমান বাংলাদেশ অসীম ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করে।
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, তখন অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এর ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে জনঘনত্বপূর্ণ এই দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে না। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। যিনি আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন, বাংলাদেশকে অভিহিত করেছিলেন তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে সহায়তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গড়িমসির ক্ষেত্রে কিসিঞ্জারের এই ভবিষ্যতবাণী কাজ করে থাকতে পারে। তদুপরি স্নায়ুযুদ্ধকালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে নিক্সন কিসিঞ্জার তাদের পরাজয় হিসেবে দেখেছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রা শুরু ১৯৭২ সালে। সে সময়ে অর্থনীতির প্রতিটি সুচকে পাকিস্তান এগিয়েছিল। আজ ৪৮ বছর পর প্রায় প্রতিটি সূচকেই পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে। এটাই আমাদের স্বাধীনতার বড় অর্জন। যেকোনো দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ধরা হয় মানবসম্পদ ; যাতে আমরা শুধু পাকিস্তান নয়, অনেক ক্ষেত্রে ভারত থেকেও এগিয়ে আছি। নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, মা ও শিশুমৃত্যুর হার কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করেছেন। ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে চিহ্নিত করেছে ‘বিস্ময়কর ধারা’ হিসেবে।
একটি তুলনামূলক পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় ছিল ১২০ মার্কিন ডলার, আর পাকিস্তানের ছিল ১৮০ ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় ১ হাজার ৮২৭ ডলার, পাকিস্তানের ১ হাজার ৬৪১ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৩ হাজার ৬৬০ কোটি ডলারের পণ্য। পাকিস্তান রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের পণ্য। অথচ ১৯৭২-৭৩ অর্থ বছরে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার এবং পাকিস্তানের রপ্তানি ছিল ৭৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ ৪৮ বছর আগে আমাদের রপ্তানি পাকিস্তানের অর্ধেকের কম। আর এখন আমাদের রপ্তানি পাকিস্তানের দেড় গুণের বেশি। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। মহা শক্তিধর চীনের পরই। বাংলাদেশের মুদ্রার মানও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি। ১৯৭২ সালে যা বেশ কম ছিল। বর্তমানে ১ মার্কিন ডলারের সমান বাংলাদেশের ৮৪ টাকা আর পাকিস্তানের ১২৪ রুপি। ২০১৯ সালের ২০ মার্চের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৩ হাজার ১৬৯ কোটি ৮০ লাখ ডলঅর। আর পাকিস্তানের (২০১৯ সালের জানুয়ারি) ১ হাজার ৪৮৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ আমাদের মজুত পাকিস্তানের দ্বিগুণেরও বেশি।
১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর, পাকিস্তানের ৫৪ বছর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর। পাকিস্তানের ৬৬ বছর। গড় আয়ুতে আমরা ভারতের থেকেও এগিয়ে আছি। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের মানবসম্পদ সূচকে দেখা যায়। ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৬তম আর পাকিস্তান ১৩৪ তম। এটিতে ভারতও আমাদের পেছনে ১১৫তম।
এইচএসডিসির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ পৃথিবীর ২৬তম বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ব সূচকে ৪২তম। বাংলাদেশ এগিয়ে আছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও। ১৯৭১ সালে যেখানেে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৫০ লাখ এবং পাকিস্তানের ৬ কোটি ৫০ লাখ, সেখানে বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি আর পাকিস্তানের ২০ কোটি ৭০ লাখ।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ এ বছর বিশ্বের শীর্ষ পাঁচে থাকবে। মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ ভালো করেছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার, শিশুদের স্কুলে পাঠ গ্রহণের সময়কাল, শিক্ষার মান, প্রাপ্ত বয়স্কদের অন্তত ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত বেচে থাকা, শিশুদের সঠিক আকারে বেড়ে ওঠাসহ বেশকয়েকটি সূচক দিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। আদর্শ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা পেলে একটি শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে শতকরা উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারে। বাংলাদেশের একজন শিশু বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গড়ে ৪৮ শতাংশ উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারবে আর পাকিস্তানের শিশুরা ৩৯ শতাংশ।
ওয়াল্ড ইকোনোমিক ফোরামের বার্ষিক প্রতিবেদনমতে, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশ অনেকটাই পেছনে ফেলেছে ভারত ও পাকিস্তানকে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিদ্ব›দ্বী অর্থনীতিগুলোর মধ্যে ভারতের অবস্থান ৬২, পাকিস্তানের ৫২ ও শ্রীলংকার ৪০।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আরও যেসব ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। তার মধ্যে রয়েছে জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমন। বাংলাদেশ জঙ্গি সমস্যাকে প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। অন্যদিওকে বহু বছর ধরেই পাকিস্তান জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের নিরাপদ স্থান হিসাবে পরিচিত, একদা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি তালেবান ছাড়াও প্রায় ডজনখানেক জঙ্গিগোষ্ঠী দেশটিতে সক্রিয়। শুধু ভারত নয় অপর দুই প্রতিবেশী আফগানিস্তান ও ইরানও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ উসকে দেওয়ার অভিযোগ করে আসছে। একই দিনে দ্য নেশন পত্রিকার সাংবাদিক মালিক মুহম্মদ আশরাফ লিখেছেন, পাকিস্তান হলো সেই দুর্ভাগ্যজনক দেশগুলোর একটি। যেখানে সামরিক ও বেসামরিক স্বৈরশাসকেরা ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে জনগণকে বোকা বানিয়েছেন এবং নিজেদের দায়মুক্তি নিয়েছেন। অনিবার্যভাবে তাদের উদ্দেশ্য ক্ষমতা গ্রাস করা এবং নিজেদের ভাগ্য তৈরি ; একই সঙ্গে তাদের ভাগ্য তৈরিতে সহায়তা করা, যারা তাদের গণবিরোধী শাসনপদ্ধতির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষা করতে চান।
এবার একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ এবং তা হলে বাংলা নববর্ষ সম্পর্কে টিকা টিপুনি ‘পান্তা-ইলিশ নিয়ে নববর্ষ উদ্যাপন করা নিয়ে ঠাট্টা-মশকারিও কম হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ২টি বিজ্ঞাপনের নমুনা ছাপা হয়েছে রম্যপত্রে (ক) বুয়া চাই, পান্তা বানাতে এক্সপার্ট এরকম বুয়া চাই। পয়লা বৈশাখের দিন পান্তা ভাত বানিয়ে খাওয়াতে হবে। অভিজ্ঞতা থাকলে অগ্রাধিকার। বেতন আলোচনা সাপেক্ষে। হালখাতার রেওয়াজ আজও আছে, তবে পয়লা বৈশাখে অনেকেই আগের বছরের দেনা শোধ না করার পুরনো লাল খাতাটা দিয়ে নতুন বছরেও কাজ চালাতে হয়। তাই পুরনো ঢাকার একজন ব্যবসায়ী আফসোস করে বললেন, ‘পয়লা বৈশাখ পার অইয়া যায়। মাগার লাল খাতা শেষ হয় না।’ এ অবস্থায় একজন ক্ষুব্ধ দোকানির হালখাতার দাওয়াত নামা ; ‘বারবার বলার পরেও আপনি বাকি টাকা দিচ্ছেন না। পযলা বৈশাখ হালখাতার দিনও যদি টাকা পরিশোধ না করেন, তাহলে আপনার টেংরি ভাইঙ্গা লুলা কইরা ফালামো।’

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট