বিভিন্ন ঐশ্বীগ্রন্থে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

71

 

বিশ্ব শান্তির প্রবর্তক সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী ও রাস‚ল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এর পবিত্র শুভাগমনের মাস,তারিখ ও সময় সম্পর্কে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও সিরাত লেখক এ কথাই একমত যে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ অতি প্রত্যুষে আমাদের প্রিয় নবী (সা.) এ ধরাবুকে পবিত্র মক্কা নগরীতে বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ ও মাতার নাম আমিনা। এই সময়, এই দিন ও এই মাস মুসলিম জাতির নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপ‚র্ণ। মুসলিম বিশ্ব এ দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্যাপন করে আসছে। ইবনে হিশাম তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে উল্লেখ করেন- আল্লাহর হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত সায়্যিদুনা আমিনার মক্কায় পাহাড়ের উপত্যকায় অবস্থিত বাড়িতে আমূল ফীলে হাতি বাহিনী মক্কা শরীফে যেদিন এসেছিল তার ৫০ দিন পর এ জগতের বুকে আগমন করেন, ১২ রবিউল আউয়াল সুবহে সাদিকের সময়।
কায়েস ইবনে মাখরামা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন- আমি ও রাসুলুল্লাহ (সা.) আবরাহার হামলার বছর জন্মগ্রহণ করি। তাই আমরা সমবয়সী। ইবনে আব্বাস ও জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন- আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হস্তি-বর্ষে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার জন্মগ্রহণ করেছেন। সোমবার তাঁর মিরাজ (আকাশ গমন) সংঘটিত হয়েছে; ওই দিনই তিনি হিজরত করেছেন; আর তাঁর ইন্তেকালও হয়েছে ওইদিন। অধিকাংশের নিকট এটিই হল প্রসিদ্ধ মত।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন- নবি করীম (সা.) সোমবার জন্ম গ্রহণ করেছন, সোমবারে নবুয়াত লাভ করেছেন, তাঁর ইন্তেকালের দিনও ছিল সোমবার, মদিনায় হিজরতের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে সোমবার বের হয়েছেন, যেদিন তিনি মদিনায় পৌঁছেছিলেন সেদিনটিও ছিল সোমবার, আর সোমবারেই তিনি হাজরে আসওয়াদ (কাবা চত্বরের কালো পাথর) উত্তোলন করেছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর আবির্ভাব মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। তাঁর শুভ আগমনে মানবতার মুক্তির নতুন সূর্য উদিত হয়েছিল। স্বর্গীয় আলোকে আলোকিত হয়েছিল সারা পৃথিবী, আনন্দে পুলকিত হল নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মুখ, সর্বত্র নেমে আসে শান্তি। তিনি আবির্ভূত হয়ে বিশ্ব সমাস ও রাষ্ট্রে এমন পরিবর্তন সাধন করেন যা মানব ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে চির স্মরণীয় হয়ে আছে।
প্রাণপ্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর শুভ জন্মে নওশেরওয়ানের সিংহাসন নড়ে উঠেছিল। পারস্যের অগ্নিকুন্ড হঠাৎ নিভে গিয়েছিল। লুটিয়ে পড়েছিল পারস্য সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী কিসরার রাজ প্রসাদের ১৪টি মিনার। শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল শ্বেত সাগরের জলরাশি, নহর বয়ে গিয়েছিল সিরিয়ার মরুতে। কাবা ঘরের হুবল নামক মূর্তিটি উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিল। ঐ রাতে কোরাইশদের একটি মূর্তির মুখ দিয়ে কথা বেরিয়েছিল এবং সেটা বলেছিল, “একটি পবিত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে। তাঁর জ্যোতিতে পৃথিবীর প‚র্ব ও পশ্চিমের বিস্তীর্ণ এলাকা আলোকিত হয়ে গেছে। তাঁর উদ্দেশ্যে সকল মূর্তি উপুড় হয়ে পড়েছে।” তাঁর আগমন বার্তা শুধু মানবক‚লে নয়, সমস্ত সৃষ্টি জগতে দোলা দিয়েছিল। কবি গোলাম মোস্তফার ভাষায় -এক অপ‚র্ব নুরে আসমান জমিন উজালা হয়ে গিয়েছে। সেই আলোকে চন্দ্র, স‚র্য, গ্রহ,তারা ঝলমল করছিলছ।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কাব্য দ্যোতনায় অসংখ্যবার নবি (সা.) এর জন্ম ও আগমনকে আহলান সাহলান মারহাবান জানিয়েছেন- ক) আসিতেছেন হাবিবে খোদা/ আরশ পাকে তাই উঠেছে শোর,/ চাঁদ পিয়াসে ছুটে আসে/ আকাশ পানে যেমন চকোর। (খ) সাহারাতে ফুটলোরে রঙিন গুলে লালা/ সেই ফুলেরই খোশবুত আজ দুনিয়া মাতোয়ারা..। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত যত নবী (আঃ) দুনিয়ায় এসেছেন এবং তাঁদের উপর যত আসমানী কিতাব ও সহিফা নাজিল হয়েছে এর সবগুলোতে রাসূল হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (সা.) -এর আগমনবার্তা ঘোষণা করা হয়েছে। পৃথিবীতে যত ধর্মমত ও ধর্মগ্রন্থ আছে সেখানেও নবী (সাঃ) এর উচ্চ প্রশংসাসহ তাঁর আগমনের খবর দেয়া হয়েছে। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও তাঁর সুযোগ্য পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) দুজন মিলে পবিত্র কা’বাঘর নির্মাণের কাজ শেষ করার পর হারাম শরিফ ও সে স্থানের বাসিন্দাদের জন্য দুআ করেন। দুআয় তাঁরা যা বলেছেন তা পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ১২৮-১২৯ নম্বর আয়াতে বিধৃত হয়েছে, “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে তোমার একান্ত অনুগত কর এবং আমাদের বংশধর থেকে তোমার এক অনুগত উম্মত কর। আমাদেরকে ইবাদতের নিয়ম পদ্ধতি দেখায়ে দাও এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হও। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মধ্য হতে তাদের নিকট এক রাস‚ল প্রেরণ কর যে তোমার আয়াত সম‚হ তাদের নিকট তেলাওয়াত করবে; তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। নিশ্চয় আপনি তো পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।”
তাওরাত হচ্ছে মূসা (আঃ) এর উপরে নাজিলকৃত আল্লাহর কিতাব। পরবর্তীকালে এটিকে নানা বিষয়ে পরিবর্তন করে বাইবেল বা “ওল্ড টেস্টামেন্ট” নামে সংকলন করা হয়েছে। সেই তাওরাতে উল্লেখ আছে – আল্লাহ বলেন, আমি তাদের ভাইদের মধ্য থেকে তোমার (ম‚সার) মতই একজন পয়গম্বর উত্থিত করব এবং তাঁর মুখে আমার বাণী প্রকাশ করব। তিনি তোমাদেরকে তাই শুনাবেন যা আমি আদেশ করব। ইঞ্জিল মূলত বর্তমানে খ্রিস্টানদের বাইবেল নিউ টেস্টামেন্ট সংকলন। সেই কিতাবে যিশু বলেছেন, যখন এই ‘সত্য আতœা’ আসবেন তখন তিনি তোমাদেরকে সর্বপ্রকার সত্যপথে চালিত করবেন; কারণ তিনি নিজের কথা কিছু বলবেন না। কিন্তু যা তিনি ( আল্লাহর কাছ থেকে) শুনবেন তাই বলবেন এবং তিনি ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা দেখাবেন। ‘সত্য’ আতœা দ্বারা যিশু বুঝাতে চান যে, সেই সহায় হবেন সকল নবীর সরদার সাইয়্যেদুল মুরসালিন। হযরত ঈসা (আঃ) যে সুসংবাদ দিয়েছিলেন পবিত্র কোরআনে এসেছে, সুরা সফ ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে -“এবং স্মরণ কর যখন মরিয়ম পুত্র ঈসা (আ:) বলেছিলেন, হে ইসরাঈল বংশীয়গণ নিশ্চয়ই আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ। আমার সামনে যে তাওরাত কিতাব আছে আমি তার সত্যতার প্রমাণকারী এবং এরূপ একজন প্রেরিত পুরুষের সুসংবাদদাতা যিনি আমার পরে আসবেন, যার নাম হবে আহমদ।”
বাইবেলের সলোমনের পরমগীত পুস্তিকায় বিশ্ব নবীর আবির্ভাব সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে নাম উল্লেখ করে ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছে। হযরত সোলায়মান (আঃ) ভবিষ্যতের নবীর নাম উল্লেখ করেছেন ‘মহামাদইম’ নামে।
বোখারীর রেওয়ায়েতে আতা ইবনে ইয়াসার বলেন- “আমি একবার আমর ইবনুল আস (রাঃ) এর সাথে দেখা করলাম এবং বললাম -রাসুলুল্লাহ (স.ঃ)-এর গুণ বর্ণনা করুন। তিনি বললেন ঃ ‘শুন! কোরআনে উল্লিখিত তাঁর কতক গুণের উল্লেখ তওরাতেও আছে – হে নবী! আমি আপনাকে শাহেদ (সাক্ষ্যদাতা), মুবাশশির (সুসংবাদদাতা), এবং নযীর (সতর্ককারী)রূপে প্রেরণ করেছি। আপনি উম্মীদের আশ্রয়স্থল, আমার বান্দা ও রস‚ল। আমি আপনার নাম ‘মুতাওয়াক্কিল’ (ভরসাকারী) রেখেছি। আপনি অসচ্চরিত্র ও কঠোর নন এবং বাজারেও ঘুরাফিরা করেন না। আপনি মন্দের জবাবে মন্দ করেন না; বরং মাফ করে দেন। আল্লাহ আপনাকে তুলে নিবেন না, যে পর্যন্ত আপনার জাতি পথভ্রষ্টতা মুক্ত না হয়ে যায় এবং তারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ না বলে। আল্লাহ আপনার মাধ্যমে অন্ধ চক্ষুসম‚হকে দৃষ্টিশক্তি, বধির কর্ণসমূহকে শ্রবণশক্তি এবং পথভ্রান্ত অন্তর সমূহকে সৎ পথের দিশা দান করবেন।”
অতএব, তাওরাত ও ইঞ্জিলে একজন সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর আগমন সম্বন্ধীয় যে সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী বিদ্যামান তা একমাত্র আমাদের সর্দার নবীকুল শিরোমণি রহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মুজতবা (সা.) – এর শুভাগমনের মাধ্যমেই অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণতা লাভ করেছে।
যে জাতি রাসূল (সা.) এর পথ ধরবে, যে জাতি তাঁর অমিয় বাণী মধু মনে করে পান করবে, সে জাতি সরল ও সুন্দর হবে। বাদলের ধারা যেমন বিশুষ্ক ভ‚মিকে সরস করে তোলে, বসন্তের মৃদু সমীরণ যেমন নির্বাক কোকিলের কন্ঠে সুরের ধ্বনি তুলে দেয়, শরতের নীল আকাশ যেমন তাবুকের প্রাণে দোলা দিয়ে সৃষ্টি রহস্যের দ্বার উন্মোচন করবার উপকরণ যোগায়, পরশমণির স্পর্শে এসে লোহা- তামা-সীসা যেমন স্বর্ণে রূপান্তরিত হয়- তেমনি এ মহামানবের মধুর বাণীতে দুনিয়ার সমস্ত ঘুমন্ত জাতিও নতুন প্রাণশক্তি ফিরে পায়। যে কোন শ্রেণির যে কোন মানুষ তাঁর পথ অনুসরণ করলে মহাকল্যাণের অধিকারী হবে। এর মধ্যে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। মনীষীদের মতে, রাস‚লুল্লাহ (সা.) এর সুন্দর গঠন সৌন্দর্যময় অবয়বের কিছু গুণাবলি ও জীবনী পাঠ করলে অন্যান্য উপকারিতার মধ্যে গুরুত্বপ‚র্ণ একটি উপকারিতা হল, মহানবী (সা.) এর প্রতি ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে। বলাই বাহুল্য, মহান আল্লাহকে ভালবাসতে হলে নবী করীম (সা.)কেও ভালবাসতে হবে। আরেকটি উপকারিতা হল, নিজের জীবনে রসূলুল্লাহ(সাঃ)-এঁর জীবনের শিক্ষাগুলোর কিছু গুণ কোননা-কোন দিকে প্রয়োগ ও গ্রহণের অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।

লেখক : কলেজ অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক