বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২)

27

দেশপ্রেমিক, রাজনীতিবিদ, বাগ্মী, সাংবাদিক, লেখক। ১৮৫৮ সালের ৭ নভেম্বর সিলেটের এক বিত্তশালী কায়স্থ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রামচন্দ্র পাল ছিলেন একজন ছোট জমিদার এবং সিলেট আইনজীবী শ্রেণির একজন সদস্য। বৈষ্ণব মতানুসারী হলেও তিনি ছিলেন হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান এবং ইসলামি চিন্তা-চেতনা দ্বারা প্রভাবান্বিত। পিতামাতার একমাত্র পুত্র বিপিনচন্দ্র পাল সিলেট শহরে জনৈক মৌলভীর নিকট প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে সেখান থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। অতঃপর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজএ ভর্তি হন। কিন্তু ডিগ্রি অর্জনের পূর্বেই তিনি পড়াশোনা ত্যাগ করেন। তাঁর সাহিত্যিক যোগ্যতা ছিল উল্লেখযোগ্য এবং তিনি ব্যাপকভাবে গীতা এবং উপনিষদ চর্চা করেন। ১৮৭৯ সালের প্রথম দিকে একটি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে বিপিনচন্দ্র তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন এবং এ পদমর্যাদায় তিনি সিলেট ও সিলেটের বাইরেও চাকরি করেন। কিছুদিন তিনি কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরিরও সম্পাদক ছিলেন (১৮৯০-৯১)। ছাত্রজীবনে কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রমুখ ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন। কেশবচন্দ্রের প্রভাবে তিনি ব্রাহ্ম মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর আধ্যাত্মিক আদর্শাবলি বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী কর্তৃক প্রভাবিত হয়। শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সাহচর্য তাঁকে স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে।
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী বিপিন পালকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করেন। অবশ্য শীঘ্রই তিনি বালগঙ্গাধর তিলক, লাজপত রায় এবং অরবিন্দ ঘোষ এর চরমপন্থী মতাদর্শে দীক্ষিত হন। কিন্তু তিনি তিলকের হিন্দু জাতীয়তাবাদের আদর্শকে গ্রহণ করতে পারেন নি। তিনি ছিলেন সম্মিলিত ‘দেশপ্রেম’এর একজন প্রবক্তা এবং ভারতের মতো একটি দেশের জন্য তিনি একে যথোপযুক্ত মনে করতেন।
বিপিনচন্দ্র পাল ১৮৮৫ থেকে কংগ্রেসের প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন এবং ১৮৮৬ ও ১৮৮৭-তে কলকাতা এবং মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে কংগ্রেসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশনে যোগদান করেন। মালিকদের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে নিপীড়িত আসামের চা-বাগান শ্রমিকদের পক্ষে আন্দোলন করার জন্য তিনি কংগ্রেসকে বাধ্য করেছিলেন। ১৮৯৮ সালে বিপিন পাল তুলনামূলক ধর্মতত্ত¡ অধ্যয়ন করতে ইংল্যান্ড গমন করেন। কিন্তু এক বছর পর তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং তাঁর সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউ ইন্ডিয়া-র মাধ্যমে স্বরাজ বা স্বাধীনতার আদর্শ প্রচার করতে শুরু করেন। অদম্য উৎসাহী বিপিনচন্দ্র পাল বিশ্বাস ও বিবেকের প্রশ্নে রাজনীতির ক্ষেত্রে কখনই আপস করেন নি। জীবনের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়েই তিনি হিন্দু সমাজের কুসংস্কারসমূহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। নারীশিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ভারতীয় শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক অগ্রদূত এবং নারী-পুরুষের সমানাধিকারের একজন প্রবক্তা। বিখ্যাত বাগ্মী বিপিনচন্দ্র পাল ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় শ্রোতাদের উজ্জীবিত করতে পারতেন। ১৯৩২ সালে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। সূত্র: বাংলাপিডিয়া